বুদ্ধিমানের জন্য নাকি ইশারাই যথেষ্ট—চ্যাম্পিয়নস লিগের গ্রুপ পর্বের খেলা যাঁরা মনোযোগ দিয়ে দেখেছেন, তাঁরা নিশ্চয় তখনই ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিলেন। এবারের চ্যাম্পিয়নস লিগ যে ‘আন্ডারডগ’দের উত্থানের মঞ্চ হতে যাচ্ছে, সেই ইশারার কথাই বলা হচ্ছে। বঞ্চিতদের উত্থানটা গ্রুপ পর্বেই দেখা গিয়েছিল। লিভারপুলকে পেছনে ফেলে নাপোলির গ্রুপসেরা হওয়া, বার্সেলোনার গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায়, পিএসজি–জুভেন্টাসের গ্রুপে বেনফিকার সেরা হওয়া এবং গ্রুপ পর্ব থেকেই জুভদের বিদায় নেওয়া।
এসবকে ইশারা না বলে কেউ চাইলে অবশ্য চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর কথাও বলতে পারেন। ভোরের সূর্য দিনের পূর্বাভাসটা যেভাবে দিয়েছিল, ফাইনাল পর্যন্ত পথটাও রচিত হয়েছে সে নিয়ম মেনেই। কোয়ার্টার ফাইনালের লাইনআপ সেই কথাই জানাচ্ছে। এবার নিশ্চিতভাবে এমন একটা দল চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনাল খেলতে যাচ্ছে, মৌসুম শুরুর আগে যাদের পক্ষে হয়তো তাদের অন্ধ সমর্থকেরাও বাজি ধরতে চাইতেন না। বিপরীতে যারা ফেবারিট হিসেবে টুর্নামেন্ট শুরু করেছিল, তেমন শিরোপাপ্রত্যাশী দুটি দল কাটা পড়তে যাচ্ছে শেষ আটেই।
কোয়ার্টারের ড্রয়ে অল ইংলিশ সেমিফাইনালের সম্ভাবনা যেমন আছে, তেমনি আছে শেষ আটে দুই ইংলিশ পরাশক্তি থেমেও যাওয়ার হুমকিও। আছে সেমিফাইনালে মিলান ডার্বির সম্ভাবনাও। সে জন্য অবশ্য এসি মিলানকে টপকাতে হবে লিগ প্রতিদ্বন্দ্বী নাপোলির বাধা। আর ইন্টারের বাধার নাম বেনফিকা। নিজেদের ইতিহাস–সেরা ছন্দে থেকেই শেষ আটের টিকিট কেটেছে নাপোলি ও বেনফিকা।
রিয়াল–চেলসির শোধ–প্রতিশোধের লড়াই
চ্যাম্পিয়নস লিগ যদি ক্লাব ফুটবলের রাজত্বের নাম হয়, তবে সেখানকার রাজা রিয়াল মাদ্রিদ। এই মঞ্চে তাদের অবস্থা হচ্ছে ‘ভেনি, ভিডি, ভিসি’ অর্থাৎ এলাম, দেখলাম এবং জয় করলাম। ইউরোপ–শ্রেষ্ঠত্বের ১৪টি শিরোপা আছে তাদের দখলে। এমনকি দ্বিতীয় স্থানে থাকা এসি মিলানের শিরোপা সংখ্যা রিয়ালের অর্ধেক ৭টি। তবে ওই যে বলা হয় না, ‘পরিসংখ্যান এক আস্ত গাধা’। চেলসির সঙ্গে মুখোমুখি লড়াইয়ের পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে কথাটা আরেকটু স্পষ্ট হবে।
চ্যাম্পিয়নস লিগের মঞ্চে এখন পর্যন্ত চারবার মুখোমুখি হয়ে দুবার জিতেছে চেলসি, একটি ম্যাচ জিতেছে রিয়াল এবং অন্যটি ড্র হয়েছে। তবে ম্যাচগুলোর প্রভাব হিসাব করলে দুই দলের অবস্থান অবশ্য সমানে সমান। গত মৌসুমে শিরোপা জয়ের পথে চেলসিকে দুই লেগ মিলিয়ে ৫–৪ গোলে হারিয়েছিল রিয়াল। প্রথম ম্যাচে ৩–১ গোলে জেতার পর নাটকীয়তায় ভরপুর পরের ম্যাচে ৩–২ গোলে হেরেও শেষ চারে উঠেছিল রিয়াল।
সেই ম্যাচে ৮০ মিনিট পর্যন্ত ৩–০ গোলে পিছিয়ে ছিল রিয়াল। পরে ঘুরে দাঁড়ানোর অনবদ্য এক গল্প লিখে সেমির টিকিট পায় ‘লস ব্লাঙ্কোস’ শিবির। তার আগের মৌসুমে অবশ্য সেমিফাইনালে রিয়ালকে দুই লেগ মিলিয়ে ৩–১ গোলে হারিয়ে ফাইনালে উঠেছিল রিয়াল। পরে ম্যান সিটিকে হারিয়ে শিরোপা জিতেছিল চেলসিই। সব মিলিয়ে হিসাবটা এখন ১–১–এ আছে। শোধ–প্রতিশোধের লড়াইয়ে এবার কে কাকে ছাড়িয়ে যায়, সেটাই দেখার অপেক্ষা।
ডার্বির নাম ‘পেপ গার্দিওলা’
এই ম্যাচটিকে পেপ গার্দিওলার পুনর্মিলনী মঞ্চ হিসেবেই দেখা যায়। কেউ চাইলে আবার ‘গার্দিওলা ডার্বি’ও বলতে পারে। একসময় বায়ার্ন মিউনিখের ডাগআউট সামলেছেন গার্দিওলা। সেই বায়ার্নকে ছেড়ে পরে আসেন ম্যান সিটিতে। তবে সিটিতে আসার পর আর কখনো সাবেক ক্লাবের মুখোমুখি হওয়ার মতো ‘বিব্রতকর’ অবস্থায় পড়তে হয়নি গার্দিওলাকে। এর আগে বার্সেলোনার কোচ হিসেবে ২০০৮–০৯ সালের কোয়ার্টার ফাইনালে বায়ার্নের মুখোমুখি হয়েছিলেন গার্দিওলা। শিরোপা জেতার পথে সেবার বায়ার্নকে হারিয়েছিল গার্দিওলার বার্সা।
এবার কি গার্দিওলা পারবেন ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে? সঙ্গে অবশ্য সাময়িক ‘ইউরোপিয়ান অভিশাপ’ কাটানোর চ্যালেঞ্জও আছে। সিটির হয়ে একের পর ইউরোপিয়ান–ব্যর্থতা যে গার্দিওলার শ্রেষ্ঠত্বকেও হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। আর ইউরোপের সাফল্য দিয়ে তাঁকে বিবেচনা করা হবে, সেটি তো গার্দিওলা নিজেও স্বীকার করে নিয়েছেন।
গার্দিওলা সিটিতে আসার পর আর কখনো দুই দল মুখোমুখি না হলেও, গার্দিওলা আসার আগে সব মিলিয়ে ৬ বার একের বিপক্ষে খেলতে নামে এই দুই দল। যেখানে ৩–৩–এ সমতা বিরাজ করছে। তবে ৬টি ম্যাচই ছিল গ্রুপ পর্বে। এবারই প্রথম চ্যাম্পিয়নস লিগের নকআউটে মুখোমুখি হবে এই দুই দল। শিরোপাপ্রত্যাশী দুটি দলের যেকোনো একটি নিশ্চিতভাবে কাটা পড়বে শেষ চারে যাওয়ার আগেই।
মিলানের ফেরা নাকি নাপোলির ‘ম্যারাডোনা ম্যাজিক’
এসি মিলান যেন ইউরোপিয়ান ক্লাব ফুটবলের এক দুঃখের নাম। একসময় ইউরোপীয় শ্রেষ্ঠত্বকে নিজেদের মুঠোয় পুরে রাখত মিলানের লাল অংশের অধিপতিরা। কিন্তু ২০০৭ সালের পর কক্ষপথ থেকে ছিটকে যেতে শুরু করে তারা। সাতবার ইউরোপীয় শ্রেষ্ঠত্বের খেতাব জয়ের পর লম্বা সময় পর্যন্ত মিলান ছিল ঝরে যাওয়া এক নক্ষত্রের নাম। কিন্তু গত কয়েক মৌসুম ধরে ফের জেগে ওঠার ইঙ্গিত দিচ্ছে তারা।
গতবার লিগ শিরোপাও পুনরুদ্ধার করে মিলান। কিন্তু এসি মিলানের সেমিতে খেলা মোটেই সহজ হবে না। প্রতিপক্ষ খুব চেনা হলেও, সেই দলটি আছে নিজেদের ইতিহাস–সেরা ছন্দে। ডিয়েগো ম্যারাডোনা যুগের পর নাপোলিকে এতটা ক্ষুরধার আরও কখনো দেখা যায়নি। অনেকের মতে এ মৌসুমের সবচেয়ে প্রভাবশালী দলও তারা। কেউ কেউ আবার আর্জেন্টিনার মতো নাপোলিকেও ম্যারাডোনার স্পিরিটে জেগে ওঠা দল হিসেবে দেখছে।
চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সব রসদ নিয়ে এবার আবির্ভূত হয়েছে লুসিয়ানো স্পালেত্তির নাপোলি। দলটির হয়ে দারুণ ছন্দে আছেন দুই তরুণ ‘নতুন ম্যারাডোনা’ খ্যাত খিচা কাভারাস্কেলিয়া ও ভিক্টর ওসিমেন। দুই লেগে এই দুজনকে থামানো হবে মিলানের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এর আগে সিরি ‘আ’র প্রথম লেগে মুখোমুখি হয়ে ২–১ গোলে জিতেছিল নাপোলি। তবে চ্যাম্পিয়নস লিগের মঞ্চে নামার আগে লিগের দ্বিতীয় লেগেও একে অপরকে পরখ করে নেওয়ার সুযোগ পাবে এই দুই দল।
বেনফিকার বাধা ইন্টার নাকি ‘গুটমান’
গত মৌসুমেও চ্যাম্পিয়নস লিগের কোয়ার্টার ফাইনাল খেলেছিল বেনফিকা। উন্নতির সেই ধারাবাহিকতা ধরে রেখে এবারও ইউরোপ–শ্রেষ্ঠত্বের মঞ্চে শেষ আট নিশ্চিত করেছে তারা। তিন মৌসুম পর পর্তুগিজ লিগ শিরোপা পুনরুদ্ধারের পথেও আছে তারা। ক্লাব ব্রুগাকে দুই লেগ মিলিয়ে ৭–১ গোলে উড়িয়ে শেষ আটের টিকিট পেয়েছে বেনফিকা।
বেনফিকার জন্য সবচেয়ে বড় বাধা অবশ্য প্রতিপক্ষ ইন্টার মিলান নয়। তাদের বড় বাধা একটি অভিশাপ। ১৯৬১ ও ১৯৬২ সালে পরপর দুই মৌসুম ইউরোপিয়ান কাপের শিরোপা জেতার পর স্বাভাবিকভাবেই বেতন বাড়ানোর দাবি জানিয়েছিলেন কোচ বেলা গুটমান। কিন্তু কোচের সে দাবি মানেনি ক্লাব কৃর্তপক্ষ। ক্লাব ছাড়ার সময় গুটমান অভিশাপ দিয়ে বলেছিলেন, ‘আগামী এক শ বছরেও বেনফিকা কোনো ইউরোপিয়ান শিরোপা জিততে পারবে না।’
কাকতালীয় হলেও সেদিনের পর থেকে এখন পর্যন্ত আর শিরোপা জিততে পারেনি বেনফিকা। তবে সেই অভিশাপকে ভুল প্রমাণ করার জন্য এর চেয়ে ভালো সুযোগ হয়তো আর হয় না। তবে ইন্টারও বড় মঞ্চের দল। সেরা ছন্দে না থাকলেও, ইউরোপিয়ান শ্রেষ্ঠত্বের খেতাব তারাও জিতেছে তিনবার। সব মিলিয়ে বেনফিকার জন্য তাই চ্যালেঞ্জটা একেবারে সহজ হবে না।