নেইমার তখনই কেবলই নিজের ডানা মেলতে শুরু করেছেন। খেলেন সান্তোসে। ২০১০ সালে আতলেতিকো গুইয়ানিয়েন্সের বিপক্ষে একটা ম্যাচের ঘটনা। তাঁকে পেনাল্টি নিতে না দিয়ে অন্য একজন পেনাল্টি নিতে পাঠানো সান্তোসের তখনকার কোচের সঙ্গে মাঠেই বিবাদে জড়িয়ে পড়েন নেইমার। খারাপ ব্যবহার করেন কোচের সঙ্গে। এমনকি ড্রেসিংরুমে গিয়েও গালাগাল করেন কোচকে।
যে আচরণের শাস্তি হিসেবে নেইমারকে পরের ম্যাচে বাদ দেওয়ার পাশাপাশি মাসিক বেতনের এক-তৃতীয়াংশ জরিমানাও করেন সান্তোসের কোচ। কিন্তু এ ঘটনার জন্য বড় শাস্তিটা আসলে কোচ নিজেই পান পরে। সান্তোসের বোর্ড সভায় সবাই পক্ষ নেন ১৮ বছর বয়সী নেইমারের, চাকরি হারান ক্লাবকে ৯ মাসের মধ্যে ব্রাজিলিয়ান ঘরোয়া ফুটবলের অন্যতম বড় দুটি ট্রফি ও শতকরা প্রায় ৬৫ ভাগ ম্যাচ জেতানো কোচ।
গল্পটা এত দিন পরে কেন বলা হচ্ছে, সেটা ওই কোচের নামটা শুনলেই পাঠক বুঝতে পারবেন—দরিভাল জুনিয়র। ব্রাজিলের নতুন কোচ হিসেবে দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন সান্তোসের সেই কোচ। আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এখনো আসেনি, তবে ব্রাজিলের সংবাদমাধ্যম দেশটির ফুটবল ফেডারেশনের সূত্র দিয়ে এরই মধ্যে খবরটা নিশ্চিত করে দিয়েছে।
১৩ বছর আগে যে নেইমারের কারণে চাকরি হারিয়েছিলেন, সেই নেইমারকে আবার দরিভাল পাচ্ছেন জাতীয় দলে। সেই ১৮ বছর বয়সী নেইমার এখন ব্রাজিলের সবচেয়ে বড় তারকাই নন, সবচেয়ে প্রভাবশালী ফুটবলারও বলা যায়। কেমন হবে নেইমারের সঙ্গে দরিভালের সম্পর্ক?
এই প্রশ্নটার উত্তর জানার অপেক্ষায় থাকতেই হচ্ছে। তবে দরিভাল কেমন কোচ, সেটা জানা খুব কঠিন কিছু না। ২০০২ সালে পেশাদার কোচ হিসেবে অভিষিক্ত দরিভাল গত ২১ বছরে ভারপ্রাপ্ত ও স্থায়ী হিসেবে মোট ২০টি ক্লাবের দায়িত্ব পালন করেছেন। শুধু ২০০৫ সালে সালেই ছিলেন ৪টি দলের কোচ। মাঝে অসুস্থতার জন্য কিছু সময় কোচিং থেকে বিরতিও নিয়েছিলেন।
যে কারণেই হোক, বারবার দল বদলানো যে দরিভালের স্বভাবজাত, তা অন্তত বলাই যায়। এমনকি এখন ব্রাজিল জাতীয় দলের কোচ হয়ে আসার সময়ও তাঁর সর্বশেষ দল সাও পাওলোর সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ পূর্ণ হয়নি। গত বছরের এপ্রিলে সাও পাওলোর দায়িত্ব নেওয়া এই কোচ এক বছর পেরোনোর আগেই ক্লাবটি ছাড়ছেন।
দরিভালের ক্যারিয়ার এমনিতেই নাটকীয়তায় ভরপুর। তাঁর ব্রাজিল জাতীয় দলের কোচ হওয়াও অবশ্য কম নাটকীয় না। ২০২২ সালের কাতার বিশ্বকাপ শেষে ব্রাজিল যখন কোচের সন্ধানে, তখন আলোচনাতেই ছিলেন না দরিভাল। বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ক্রোয়েশিয়ার কাছে টাইব্রেকারে হেরে বিদায়ের পর ব্রাজিলের দায়িত্ব ছাড়েন তখনকার কোচ তিতে। এর পর থেকেই নতুন কোচের সন্ধানে ছিল পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা। নাটক জমে ওঠে সিবিএফের বিদেশি কোচ খোঁজার খবর সামনে আসার পর। এই খবরে ব্রাজিলের সাবেক ফুটবলাররাও বিভক্ত হয়ে পড়েন। রোনালদোর কিংবদন্তি ফুটবলার বিদেশি কোচ নিয়োগের পক্ষে অবস্থান নিলেও আরেক কিংবদন্তি রিভালদো ছিলেন বিপক্ষে।
সিবিএফ অবশ্য বিতর্কে গা না ভাসিয়ে বিদেশি কোচের সন্ধানেই ছিল। শুরুতে জোসে মরিনিও, লুইস এনরিকে ও কার্লো আনচেলত্তির কথা শোনা গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত আলোচনায় টিকে ছিলেন শুধুই আনচেলত্তি। তবে রিয়াল মাদ্রিদের সঙ্গে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত চুক্তি থাকায় আনচেলত্তির ব্রাজিলে আসাটা সহজ ছিল না। এরপরও দুই পক্ষ সমঝোতায় পৌঁছানোর পর ফ্লুমিনেন্সের কোচ ফার্নান্দো দিনিজকে অন্তর্বর্তীকালীন কোচের দায়িত্ব দেওয়া হয় (দিনিজের আগে অন্তর্বর্তীকালীন কোচ ছিলেন র্যামন মেনজেস)।
পাশাপাশি ২০২৪ সালের কোপা আমেরিকায় আনচেলত্তির ব্রাজিলের কোচ হওয়ার বিষয়টিও নিশ্চিত করেছিল বার্তা সংস্থা এএফপি। এটুকু পর্যন্ত সব ঠিকঠাকই ছিল। বিদেশি কোচ নিয়ে তৈরি হওয়া সমালোচনার তোড়ও ধীরে ধীরে কমে এসেছিল। এমনকি আনচেলত্তির অপেক্ষায় থাকার এই সময়ে দিনিজের ব্যর্থতা (৬ ম্যাচে ৩টিতেই হেরেছে দিনিজের দল) নিয়েও কাটাছেঁড়া হয়েছে সামান্যই।
নাটক আবার জমে ওঠে গত ডিসেম্বরে। ৭ ডিসেম্বর আদালতের নির্দেশে সরে যেতে হয় ফুটবল প্রধান এনদালদো রদ্রিগেজকে। এই রদ্রিগেজের সঙ্গেই মূলত চুক্তির বিষয়ে কথা হয়েছিল আনচেলত্তির। কিন্তু ফেডারেশন প্রধানের পদে রদ্রিগেজ না থাকায় ব্রাজিলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন আনচেলত্তি এবং রিয়ালের সঙ্গে ২০২৬ পর্যন্ত চুক্তি নবায়ন করেন। কিন্তু নাটকের শেষ অঙ্ক তখনো বাকি। ৪ জানুয়ারি রদ্রিগেজকে আবার সিবিএফ সভাপতির পদে ফিরিয়ে আনার রায় দেন ব্রাজিলের সর্বোচ্চ আদালত।
পুনর্বহাল হয়েই অন্তর্বর্তীকালীন কোচ দিনিজকে ছাঁটাই করেন রদ্রিগেজ। দিনিজের বিদায়ের ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে দরিভালের কোচ হয়ে আসার গুঞ্জনও ডালপালা মেলে। আর এখন সেটাই সত্য হওয়ার পথে। ২০২৬ বিশ্বকাপ পর্যন্ত ব্রাজিল দলের কোচের দায়িত্ব দেওয়া হবে দরিভালকে। এমনকি দরিভালকে আনতে চুক্তি শেষ না হওয়ায় সাও পাওলোকে ২ মিলিয়ন ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ২২ কোটি টাকা) ক্ষতিপূরণও দেবে সিবিএফ। প্রশ্ন হলো, এত নাটকীয়তার পর একজন কোচকে দলে আনার পর তাঁর কাছ থেকে ব্রাজিলের প্রত্যাশাটা আসলে কী?
বারবার ক্লাব বদলালেও দরিভালের অর্জনে কিন্তু এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। কোচিং ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ভাগে এসে দারুণ সাফল্য পেয়েছেন এই কোচ। মাঝে কঠিন সময়ও পার করেছেন। আগেই বলা হয়েছে, দরিভাল তাঁর লম্বা সময়ের কোচিং ক্যারিয়ারে বিরতিতেও ছিলেন। ক্যানসার বাসা বেঁধেছিল শরীরে। তবে ২০২২ সালে ফ্ল্যামেঙ্গোর দায়িত্ব নিয়ে দারুণ চমক দেখান দরিভাল। তাঁর হাত ধরেই সে বছরই কোপা ব্রাজিল এবং কোপা লিবার্তাদোরেস জেতে ফ্ল্যামেঙ্গো। এরপর ২০২৩ সালের এপ্রিলে সাও পাওলোর দায়িত্ব নিয়ে জিতেছেন আরও একটি কোপা ব্রাজিল। অর্থাৎ গত দুই বছরে তিনটি ট্রফি জিতেছেন দরিভাল। অথচ তার আগে ৯ বছরের মধ্যে জিতেছিলেন মাত্র ১টি ট্রফি। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত দরিভাল জিতেছেন ৯টি ট্রফি।
কৌশলগত দিক বিবেচনায় দরিভাল বৈপ্লবিক কোনো কিছু হাজির করে চমক দেখানোর মতো কোচ না। মূলত ৪-৪-২ ফরমেশনে এবং কখনো কখনো এই ফরমেশনকে ভেঙে তিনি দলকে মাঠে নামান। অনেক সময় দলের প্রয়োজনে ৪-২-৩-১ ফরমেশনও অনুসরণ করেন। এই ছকে মিড-ব্লক দ্রুত বল পাস দিয়ে আক্রমণে ওঠার চেষ্টা করে। এ সময় ফুলব্যাকরা অ্যাটাকিং থার্ড এসে আক্রমণে নিজেদের ভূমিকা রাখার চেষ্টা করেন। দলের পায়ে যখন বল থাকে না, তখন চারজন ব্যাকলাইনের সামনে দুজন খেলোয়াড় রেখে বল দখলের চেষ্টা করেন। আর বল উদ্ধার করতে পারলে দ্রুত প্রতি আক্রমণে উঠে গোল আদায়ের চেষ্টা করেন।
দরিভালকে দায়িত্ব দেওয়ার পেছনে আরেকটি বড় কারণ তাঁর তারকা সামলানোর দক্ষতা। নেইমারের বিব্রতকর ঘটনা বাদ দিলে তারকা খেলোয়াড়দের মাঠে কীভাবে ব্যবহার করতে হয়, সেটিও তাঁর ভালোই জানা। ফ্ল্যামেঙ্গোতে ভেরতন রিবেরো, আরাকায়েতা, গাবিগোল ও পেদ্রোর মতো ব্রাজিলের ঘরোয়া ফুটবলের তারকাদের সামলেছেন।
দরিভালের কাছে ব্রাজিল দলের সবচেয়ে বড় চাওয়া অবশ্য শিরোপা। ব্রাজিলের ফুটবলে সাফল্য-ব্যর্থতার একমাত্র মানদণ্ড হচ্ছে ট্রফি জেতা এবং না জেতা। আর দায়িত্ব নেওয়ার ছয় মাসের মধ্যেই সেই চ্যালেঞ্জের সামনে পড়তে চলেছেন দরিভাল। তাঁর অধীনেই যুক্তরাষ্ট্রে কোপা আমেরিকা খেলবে ব্রাজিল। সাম্প্রতিক ব্যর্থতা ভুলে সেই টুর্নামেন্টে ব্রাজিলকে ট্রফি এনে দেওয়া দরিভালের জন্য বড় অর্জনই হবে। সাম্প্রতিক সাফল্যের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে দরিভাল সেটি করতে পারেন কি না, সেটাই এখন দেখার অপেক্ষা।
০৯-১২-২০২২: বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে ব্রাজিলের বিদায়। তিতের দায়িত্ব ছাড়ার ঘোষণা
১৭-০১-২০২৩: পদত্যাগপত্রে তিতের স্বাক্ষর
২৫-০৫-২০২৩: রামন মেনেজেসকে অন্তর্বর্তীকালীন কোচ নিয়োগ
০৪-০৭-২০২৩: ফার্নান্দো দিনিজকে অন্তর্বর্তীকালীন কোচ নিয়োগ এবং ২০২৪ সালের কোপা আমেরিকায় কার্লো আনচেলত্তিকে কোচ করার সিদ্ধান্ত
০৭-১২-২০২৩: আদালতের সিদ্ধান্তে সরতে হলো সিবিএফ সভাপতি এনদালদো রদ্রিগেজকে
২৯-১২-২০২৩: ২০২৬ পর্যন্ত রিয়াল মাদ্রিদের সঙ্গে আনচেলত্তির চুক্তি নবায়ন
০৪-০১-২০২৪: সুপ্রিম কোর্ট আবার সিবিএফ প্রধান হিসেবে পুনর্বহাল করল রদ্রিগেজকে
০৫-০১-২০২৪: ছাঁটাই হলেন অন্তর্বর্তীকালীন কোচ ফার্নান্দো দিনিজ
০৭-০১-২০২৪: ব্রাজিলের দায়িত্ব নিতে দরিভালের ক্লাব ছাড়ার ঘোষণা সাও পাওলোর