আধুনিক ফুটবলের যাত্রা নাকি শিল্প থেকে যন্ত্রের পথে। এই যান্ত্রিকতা ফুটবলারদের শরীরকেও পরিণত করেছে যন্ত্রে। ফুটবলের এই সর্বগ্রাসী মূর্তির সামনে খেলোয়াড়দের সারাক্ষণই পারফর্ম করতে হয়। টিকে থাকতে নিজেদের শরীরকে নিয়ে যেতে হয় রোবটের পর্যায়ে, যা ক্রমেই অনুভূতিহীন হয়ে পরিণত হয় ফলদায়ী একটি মেশিনে।
মৌসুমজুড়েই তাই পেপ গার্দিওলা, ইয়ুর্গেন ক্লপ, কার্লো আনচেলত্তিদের মতো কোচদের গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে হয়। কথা বলতে হয় খেলোয়াড়দের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে। কিন্তু কে শোনে কার কথা!
কোচদের সেসব আওয়াজ ফুটবলের পেশাদারত্বের আতশবাজির আড়ালে ঢাকা পড়ে যায়। আধুনিক ফুটবল এতই চাহিদাসম্পন্ন হয়ে উঠেছে, মৌসুম শেষেও বিশ্রাম নেওয়ার সময়ও খেলোয়াড়দের মাঠে নামতে হয়, খেলতে হয়। নতুন মৌসুম শুরুর আগে স্বল্প সময়ের এই ফুটবলকে বলা হয় প্রাক্-মৌসুম প্রস্তুতিকাল। এ সময়ে একেক ক্লাব একেকভাবে নিজেদের প্রস্তুত করে। বেশির ভাগ ক্লাবই ভিন্ন দেশে গিয়ে ট্যুর ম্যাচ খেলে। প্রশ্ন হচ্ছে এই প্রাক্-মৌসুমে প্রস্তুতি কি আদৌ জরুরি? নতুন মৌসুম শুরুর আগে এই ফুটবল খেলার প্রয়োজন কী?
এমনিতে সাদা চোখে প্রাক্-মৌসুম প্রস্তুতিকে মনে হতে পারে খেলোয়াড় ‘শোষণের’ আরেকটি হাতিয়ার। কিংবা একে কেউ চাইলে বিদেশ গিয়ে দলবেঁধে ‘চড়ুইভাতি’ করাও বলতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে প্রাক্-মৌসুম একেবারেই ফেলনা নয়। ফুটবলীয় দিক বিবেচনায় নতুন মৌসুম শুরুর আগে এর গুরুত্বও অনেক।
একটি মৌসুম শেষে খেলোয়াড়েরা চলে যান ছুটি কাটাতে। কেউ পরিবার নিয়ে, কেউ আবার বন্ধুদের নিয়ে বেশ আয়েশিভাবে এই সময়টা পার করেন। খুব কম খেলোয়াড়ই এ সময়ে নিজেদের ফিটনেসের প্রতি যথাযথ গুরুত্ব দিতে পারেন। এর ফলে যা হওয়ার তাই হয়। বেশির ভাগ খেলোয়াড়ই নিজেদের ফিটনেস হারিয়ে ফেলেন কিংবা সেরা অবস্থানে আর থাকতে পারেন না।
ফলে মাঠে ফেরার পর দৃষ্টিকটু নানা চিত্র দেখা যায়। গরমে অনুশীলন করতে গিয়ে অনেক খেলোয়াড়কে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতে দেখা যায়। কেউ আবার নিজেদের দৌড় শেষ করতে পারেন না বা অল্পতেই হাঁপিয়ে যাচ্ছেন। আবার কাউকে দেখা যায় কোচের দেওয়া কাজগুলো ঠিকঠাক করতে পারছেন না। এ পরিস্থিতিতে নিজেদের রণকৌশল ঠিক করতে গিয়ে কাহিল হয়ে পড়েন কোচরাও।
আর এ অবস্থায় একজন খেলোয়াড়কে পেশাদার ফুটবল খেলার জন্য মাঠে নামানোর কথা ভাবাটাও কোচদের মনে বিভীষিকার জন্ম দেয়। গত বছর ক্রীড়াভিত্তিক মার্কিন সংবাদমাধ্যম দ্য অ্যাথলেটিককে প্রাক্-মৌসুম প্রস্তুতি কতটা জরুরি, তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এভারটনের সাবেক ডিফেন্ডার পিটার ক্লার্ক বলেছিলেন, ‘আমি দেখেছিলাম (প্রাক্-মৌসুম প্রস্তুতিতে) খেলোয়াড়েরা অসুস্থ হয়ে পড়ছে। আমার দলের এক খেলোয়াড় একবার তার ফিটনেস পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেছিল। তার দৌড়াতেও বেশ কষ্ট হচ্ছিল। এমনকি এক সেশন পর তার পা বেঁকে গেল। কিছুক্ষণ হাঁপাতে শুরু করল।’
ক্লার্কের এ বিবরণই বলে দিচ্ছে, ছুটি কাটিয়ে মাঠে ফেরার পর খেলোয়াড়দের আসলে কেমন পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। আসল খেলায় এমন বিব্রতকর অবস্থা এড়াতেই মূলত এই প্রাক্-মৌসুম প্রস্তুতি। তবে শুরুতে যে খেলোয়াড়দের যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার কথা বলা হয়েছিল, সেই প্রবণতা এখানেও পূর্ণমাত্রায় উপস্থিত থাকে। ক্রীড়াবিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শকে লঙ্ঘন করে অনেক সময় অনুশীলন করান কোচরা।
গত মৌসুমে টটেনহামে তৎকালীন কোচ আন্তোনিও কন্তে খেলোয়াড়দের ৬ হাজার দর্শকের সামনে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার মধ্যে অনুশীলন করিয়ে আলোচনায় এসেছিলেন। সেদিন হ্যারি কেইনসহ দলের অনেক খেলোয়াড়কে হাঁপাতে হাঁপাতে বসে পড়তে দেখা যায়। সন হিউং–মিনের অবস্থা হয়েছিল সবচেয়ে খারাপ। একপর্যায়ে মাঠে শুয়ে তাঁকে গড়াগড়ি খেতে দেখা যায়। আবার প্রাক্–মৌসুম প্রস্তুতিতে চোটে পড়ে লম্বা সময়ের জন্য ছিটকে যেতে হয় অনেক খেলোয়াড়কে। এমনিতেই খেলোয়াড়দের ফিটনেস ভঙ্গুর অবস্থায় থাকে, আর এ অবস্থায় অনুশীলন পরিমিত না হলে ঘটতে পরে বড় কোনো অঘটনও।
এরপরও অনেক বিশ্লেষক অবশ্য মনে করেন, এ ধরনের অনুশীলনের কোনো বিকল্পও নেই। প্রিমিয়ার লিগের ফিটনেস কোচ মাইকেল ওয়াটস একবার বলেছিলেন, ‘প্রাক্-মৌসুম সুযোগ করে দেয় খেলোয়াড়দের ওপর বোঝা বাড়িয়ে তাদের ফিটনেসকে দুর্দান্ত পর্যায়ে নিয়ে যেতে। সবাইকে সঠিক অবস্থায় আনতে আপনার হাতে ৬ সপ্তাহ সময় থাকে। প্রতিটি মানুষই আলাদা। তাই তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী অনুশীলনের পথরেখা ঠিক করতে হয়, যাতে সঠিক পথে অগ্রগতি সম্ভব হয়।’
২৬ বছর ধরে ফুটবল খেলে যাওয়া ৪১ বছর বয়সী ক্লার্ক মনে করেন, খেলোয়াড়দের অবকাশের সময়ে ফিটনেসকে পুরোপুরি ভুলে থাকা উচিত নয়। যদি নিজেরাই অনুশীলনের অভ্যাস ধরে রাখেন, তবে পরিস্থিতি আরও সহনীয় হতে পারে। ক্লার্ক বলেছেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে আমি মৌসুমের পর বেশি সময় অবকাশে থাকি না। আমি নিজের মতো করে অনুশীলন করতে পছন্দ করি। মাঠে ফেরার পর এটা সবকিছু সহজ করে না, তবে কিছুটা সহনীয় করে। সব বন্ধ করে রাখলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যায় না।’
শুধু ফিটনেসের জন্য প্রাক্-মৌসুম প্রস্তুতি জরুরি তা নয়, খেলোয়াড়দের কৌশলগত উন্নতি এবং কোচদের রণনীতি ঠিক করার জন্যও প্রাক্-মৌসুমের কোনো বিকল্প নেই। দলে আসা নতুন খেলোয়াড়দের বাজিয়ে নিতে, সমন্বয় ঠিক করতে এবং নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়ার উন্নতির জন্য বিরতিকালীন এই ফুটবল বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এ সময়টাতে কোচরা পরবর্তী মৌসুম সামনে খেলোয়াড়দের নিজের চাহিদার কথাও জানিয়ে দেন। একই সঙ্গে নিজের পরিকল্পনার সঙ্গে কোন খেলোয়াড় তাঁর কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তা–ও ঠিক করে নিতে পারেন।
অন্যদিকে এটি খেলোয়াড়দেরও নিজেদের সৃষ্টিশীলতা, বৈচিত্র্যময়তা, দক্ষতা এবং কৌশলের পরীক্ষা–নিরীক্ষা সেরে নেওয়ার সুযোগ করে দেয়। কোনো খেলোয়াড় যদি বিশেষ মুহূর্তে নতুন কোনো উদ্ভাবনী শটে প্রতিপক্ষকে চমকে দিতে চান, সে অনুশীলন সেরে নেওয়ার জন্য প্রাক্-মৌসুম প্রস্তুতির চেয়ে ভালো সুযোগ আর হয় না। অনেক সময় প্রাক্-মৌসুম প্রস্তুতি পরোক্ষভাবে মৌসুম কেমন হতে যাচ্ছে, সেই ধারণাও দিয়ে দেয়।
গত মৌসুমে প্রাক্-মৌসুম প্রস্তুতিতে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের কাছে ৪–০ গোলে হারের পর লিভারপুল কোচ ইয়ুর্গেন ক্লপ বলেছিলেন, ‘আমি এ ম্যাচে অনেক ভালো পরিস্থিতি, ভালো পারফরম্যান্স দেখেছি কিন্তু কোনো ধারাবাহিকতা দেখিনি। আমরা কখনো তাড়াহুড়ো করেছি, অস্থির হয়ে থেকেছি। কিন্তু ম্যান–মার্কিং পদ্ধতিতে ইউনাইটেড বেশ ভালোভাবেই রক্ষণ সামলেছে। বিশেষ করে মিডফিল্ডে। আমরা ভুল সময়ে বল হারিয়েছি। তাদেরকে সুযোগ কাজে লাগানোর পরিস্থিতি তৈরি করে দিয়েছি। এসব জায়গায় আমাদের নিশ্চিতভাবে উন্নতি করতে হবে। এমনকি আমরা যদি ৪–০ গোলে জিততামও আমাদের তা করতে হতো।’
সময় উল্লেখ করে না দিলে মনে হতে পারে মৌসুম শেষ করেই হয়তো ক্লপ এ কথাগুলো বলছেন। কারণ, প্রাক্-মৌসুম প্রস্তুতির সেই ম্যাচে ক্লপ যেসব দুর্বলতার কথা বলেছেন, গোটা মৌসুমে লিভারপুলকে সেগুলোই ভুগিয়েছে। যে উন্নতি খেলোয়াড়দের কাছে ক্লপ চেয়েছিলেন, সেটা তাঁরা করে দেখাতে পারেননি। যার ফলাফল হচ্ছে, সেরা চারে থেকে মৌসুমও শেষ করতে পারেননি ‘অল রেড’রা। এমনকি খেলা হবে না চ্যাম্পিয়নস লিগেও।
তাই প্রাক্-মৌসুমকে একেবারে হালকাভাবে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। খেলোয়াড়দের ব্যক্তিগত এবং দলীয় প্রস্তুতিতে এটি ফল নির্ধারক হয়ে উঠতে পারে। একই সঙ্গে অবশ্য এটাও মনে রাখা দারকার যে ফুটবলাররা যন্ত্র নন। তাঁদেরকে শিল্পীর পরিবর্তে যন্ত্র হিসেবে ভাবার প্রবণতা থেকেও বেরিয়ে আসা উচিত। নয়তো প্রাক্-মৌসুম প্রস্তুতি হিতে বিপরীত কোনো দুর্ঘটনার জন্ম দিতে পারে।