লিওনেল মেসি
লিওনেল মেসি

‘ভক্ত হিসেবে আমরা মেসিকে বড় ক্লাবে দেখতে চাই’

লিওনেল মেসি কেন সৌদি আরবের ক্লাবের বিপুল অর্থের হাতছানি দূরে ঠেলে শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের মেজর লিগ সকারে খেলতে যাচ্ছেন? গোটা ফুটবল বিশ্বের চর্চার বিষয় এখন এটাই। কেউ মনে করেন, অর্থ এখন আর মেসির কাছে বড় নয়। কারও ধারণা, যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমালে নিজের ও পারিবাবিক জীবনটা উপভোগ করতে পারবেন আধুনিক ফুটবলের মহানায়ক।

আবার কারও বিশ্বাস, ক্যারিয়ারের শেষ প্রান্তে অনেক ফুটবল কিংবদন্তিই যুক্তরাষ্ট্রের এই লিগে নাম লিখিয়েছেন, এটা একটা বহমান ধারা। ফুটবলের রাজা পেলে থেকে শুরু করে আরও অনেকেই আছেন এ তালিকায়, যেখানে সর্বশেষ সংযোজন মাত্রই গত ডিসেম্বরে আর্জেন্টিনাকে ৩৬ বছর পর বিশ্বকাপ জেতানো মেসি

বাংলাদেশের ফুটবলাররা কী মনে করছেন ব্যাপারটা নিয়ে? আবাহনীর স্ট্রাইকার নাবিব নেওয়াজ মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের মেজর লিগ সকার সেভাবে প্রচারে না থাকলেও জমজমাট একটা লিগই। ফলে সেখানে অবশ্যই ভালো প্রতিদ্বন্দ্বী আছে। সেটিই মেসি ভেবেছেন। তা ছাড়া মেক্সিকো, কানাডার সঙ্গে ২০২৬ বিশ্বকাপের যৌথ আয়োজক যুক্তরাষ্ট্রে। মেসি খেললে সেটিই হবে তাঁর শেষ বিশ্বকাপ। নিজের শেষ বিশ্বকাপের আগে যুক্তরাষ্ট্রের ঘরোয়া লিগে খেলে নিজেকে হয়তো তৈরি করবেন।

নাবিব নেওয়াজ বলেন, ‘আগামী বিশ্বকাপ মাথায় রেখেই হয়তো মেসি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সৌদি আরবে অনেক টাকা ঠিক; কিন্তু একটা সাক্ষাৎকারে দেখলাম, মেসি বলেছেন টাকা কোনো ব্যাপার নয়। আসলে তিনি খেলাটা ভালোভাবে চালিয়ে যেতে চান। সে কারণেই গেছেন ইন্টার মায়ামিতে। তাঁর কাছে মনে হয়েছে, এশিয়া আর ইউরোপে খেলা এক নয়। মেসির এখনো ইউরোপ, আমেরিকায় খেলার সামর্থ্য আছে। ফলে এসব চিন্তা করেই তিনি এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।’

ইন্টার মায়ামির সভাপতি ও মালিক ডেভিড বেকহামের সঙ্গে লিওনেল মেসি

মেসি সৌদি আরব গেলে নাবিব খুশি হতেন। কারণ, তখন চাইলে একটা টিকিট কেটে মেসির খেলা দেখে আসতে পারতেন। খেলোয়াড় হিসেবে চান মেসি আরেকটা বিশ্বকাপ খেলুন। ‘বার্সেলোনায় যায়নি বলেও আমি খুশি। কারণ, ক্লাব ছাড়ার সময় মেসির সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেনি বার্সেলোনা। ফলে না গিয়ে ভালোই করেছেন। সৌদি আরব যাচ্ছেন না হয়তো পারিবারিক কারণে। সৌদির জীবনযাত্রা ইউরোপের চেয়ে একটু আলাদা। এটা কে না জানে’, বলেছেন নাবিব নেওয়াজ।

অর্থ, যশ—কোনো কিছুরই অভাব নেই মেসির। তাঁর পারফরম্যান্স ওঠানামা করছে ব্যাপারটা তা–ও নয়। একজন খেলোয়াড় যখন ক্যারিয়ারের শেষ প্রান্তে চলে আসেন, তখন তিনি দলে নিজের স্বাধীনতা চান। এমনটাই মনে করছেন ফুটবলার মামুনুল ইসলাম।

জাতীয় দলের সাবেক এই অধিনায়ক বলছেন, ‘কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে রোনালদো অনেক বড় বড় সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন। যেমন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে ফেরা, যেখানে তিনি আর স্বাধীনতা পাননি। ভেবেছিলেন ক্যারিয়ারটা ইউনাইটেডেই শেষ করবেন। কিন্তু যাওয়ার পর দেখেন ম্যানচেস্টারের পরিবেশ ভিন্ন। যেখানে তাঁর গুরুত্ব সে অর্থে আগের মতো ছিল না। মেসিও হয়তো সেভাবেই ভেবেছেন।’

সৌদি লিগ মানের দিক থেকে জাপানের জে লিগের চেয়েও পিছিয়ে। এ কারণে হয়তো মেসির কাছে মনে হয়েছে সৌদিতে যাওয়া ঠিক হবে না। এই স্বাধীনতার জন্যই মায়ামিতে গেছেন মেসি। এমনই বিশ্বাস মামুনুলের।

কিন্তু সৌদি আরবের ক্লাবে গেলেও সেটা কি পেতেন না মেসি? নিশ্চয়ই পেতেন। তাহলে বিপুল অর্থকে প্রাধান্য না দিয়ে কেন ইন্টার মায়ামি? মামুনুল বলেন, ‘যুক্তরাস্ট্রের ফুটবলের মান আর সৌদি আরবের মান এক নয়। এশিয়ার ফুটবল আর ইউরোপ–লাতিন ফুটবল ভিন্ন ভিন্ন ঘরানার। যুক্তরাষ্ট্রের ফুটবল অনেকটা লাতিন ঘরানার। মেসি হয়তো ভেবেছেন, তাঁর যে বয়স, এমন একটা দলে যাবেন, যেখানে পুরোপুরি স্বাধীনতা পাবেন’, বলেছেন মামুনুল।

বার্সেলোনায় মেসির কেন ফেরা হয়নি, তা আর নতুন করে না বললেও চলছে। তবে মামুনুলের বিশ্বাস, মেসির সিদ্ধান্তটা তাঁর নিজের জন্য সঠিকই। এখন আর মেসি কিছু পাওয়ার জন্য খেলেন না। ফুটবল–জীবনে অধরা বিশ্বকাপও হাতে তুলেছেন। ক্যারিয়ারের শেষ প্রান্তে জীবনটা যাতে উপভোগ্য হয়ে ওঠে, এটাই চেয়েছেন মেসি। এমনই বিশ্বাস বর্তমান বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের সদস্য রাকিব হোসেনের। এই ফরোয়ার্ড বলেন, ‘সৌদির চেয়ে ইন্টার মায়ামিই ভালো হবে মেসির জন্য। অনেক বড় বড় তারকাই ক্যারিয়ারের শেষটা যুক্তরাষ্ট্রের লিগে কাটিয়েছেন। কারণ, সেখানে খেলার পাশাপাশি জীবনটা উপভোগ করা যায়। লিগটাও বেশ জমজমাট।’

বাংলাদেশের ফুটবলার নাবিব নেওয়াজ

ডেভিড বেকহামের মতো কিংবদন্তি যুক্ত আছেন ইন্টার মায়ামির সঙ্গে। ক্লাবটির অন্যতম অংশীদার তিনি। সেই বেকহামের সঙ্গে মেসির ভালো একটা সম্পর্ক। বেকহামের সূত্র ধরেই আসলে মেসির যুক্তরাষ্ট্রে খেলার সিদ্ধান্ত। বাংলাদেশ ফুটবল দলের সাবেক গোলরক্ষক ও বর্তমানে কোচ বিপ্লব ভট্টাচার্য নিজের এই মতের পক্ষে যুক্তিও দেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের ফুটবলটা দিন দিন ভালো হচ্ছে। ২০২৬ বিশ্বকাপ আছে সেখানে। আর মায়ামির প্রস্তাবটাও ভালো। বেকহামদের একটা সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার ফল হিসেবেই মেসিকে আসলে মায়ামিতে নেওয়া হয়েছে বলে আমার ধারণা। তারা হয়তো আগামী বিশ্বকাপ সামনে রেখে মেসির মতো একটা তারকাকে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়েছে অনেক অঙ্ক কষেই।’

মেসিকে আসলে এত বছর সর্বোচ্চ পর্যায়ের ক্লাবে দেখে এসেছে বিশ্ব ফুটবল। হঠাৎ করে এখন তিনি এমন একটা লিগে যাচ্ছেন, যেটি আসলে তাঁর জায়গা নয়। বাংলাদেশ জাতীয় দলের বাইরে থাকা গোলকিপার আশরাফুল ইসলাম তেমনটাই মনে করেন, ‘মেসি সর্বোচ্চ পর্যায়ের কোনো লিগে খেলে অবসর নিলে খুশি হতাম। তাঁর মতো খেলোয়াড়ের সেটাই প্রাপ্য। ভক্ত হিসেবে আমরা মেসিকে বড় ক্লাবে দেখতে চাই। এখন ইন্টার মায়ামিতে এখন হয়তো সমর্থক তৈরি হবে। সেটা আলাদা ব্যাপার। তবে খেলোয়াড় হিসেবে এটা আসলে তাঁর জায়গা নয়। তবে এটা তাঁর সিদ্ধান্ত। বুঝেশুনেই নিয়েছেন। তাঁর সিদ্ধান্তকে সম্মান করতে হবে।’