দুটি দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই সেই ১৯৭৯ সাল থেকে। কিন্তু কূটনীতি ছাপিয়েও ইরান আর যুক্তরাষ্ট্রের রসায়নটা শত্রুতারই। দুনিয়াতে এই দুই দেশের অবস্থান যেন দুই মেরুতে। এমন একটা পরিস্থিতিতে বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বে এই দুই দলের মোলাকাতই ‘মহারণে’র হাতছানি দিচ্ছে।
কাতার বিশ্বকাপের সূচি যেদিন প্রকাশ হয়েছিল, সেদিন থেকেই এই দুই দেশের ম্যাচ নিয়ে আলোচনা চলছে। এর মধ্যে ইরানে গত দুই মাস ধরে চলমান রাজনৈতিক সহিংসতা, সরকারবিরোধী বিক্ষোভ এই ম্যাচকে ভিন্নমাত্রা দিচ্ছে।
ইরানিরা যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে এই ম্যাচ যে খুব জোশ নিয়ে দেখবে, ব্যাপারটা এখন আর সেই পর্যায়ে নেই। নারীর অধিকার নিয়ে ইরানে যে বিক্ষোভ চলছে, তাতে সরকারের দমননীতি এমনিতেই ইরানি জনগোষ্ঠীকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। ইরানের বহু তারকা, কবি এমনকি খেলোয়াড়েরাও নারীর অধিকার নিয়ে সাধারণ মানুষের এই বিক্ষোভের সঙ্গে একাত্ম। সরকারের দমননীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে অনেককেই গ্রেপ্তার হয়েছেন, অনেকেই হুমকির মুখে পড়েছেন।
বিশ্বকাপে এসে প্রথম ম্যাচেই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে জাতীয় দলের ফুটবলাররা জাতীয় সংগীতের সঙ্গে কণ্ঠ না মিলিয়ে চলমান আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে গোটা ব্যাপারটিকেই ভিন্ন মাত্রা দিয়েছেন। এ অবস্থায় ইরান–যুক্তরাষ্ট্র ম্যাচটি যতটা না মাঠের লড়াই, তার চেয়ে অনেক বেশি রাজনীতির, এর ব্যপ্তি মাঠের বাইরে অনেকটাই বিস্তৃত।
ম্যাচের আগেই যুক্তরাষ্ট্র ফুটবল ফেডারেশনের অফিশিয়াল টুইটার ও ইনস্টাগ্রাম প্ল্যাটফর্ম বিতর্ক ছড়িয়েছে। ম্যাচ নিয়ে যে পোস্ট দেওয়া হয়েছে, তাতে ইরানের জাতীয় পতাকা বিকৃত করার অভিযোগ তুলেছে ইরানি ফুটবল ফেডারেশন। যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য নির্বিকার। তারা বলছে ইরানের চলমান আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়েই নাকি এই পোস্ট। ব্যাপারটা নিয়ে ইরান এতটাই ক্ষুব্ধ যে ফিফার কাছে যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বকাপ থেকে বহিষ্কার করারও আবেদন তারা জানিয়ে ফেলেছে।
কাল ম্যাচ নিয়ে সংবাদ সম্মেলনটা ছিল রীতিমতো উত্তপ্ত। ইরানি সাংবাদিকেরা এটিকে পরিণত করেছিলেন রাজনৈতিক সংবাদ সম্মেলনে। ডেইলি মেইল জানিয়েছে, সংবাদ সম্মেলনে ফুটবল ছাড়া রাজনীতি নিয়েই প্রশ্ন ছিল বেশি। ইরানি সাংবাদিকদের আক্রমণের তোড়ে অনেকটাই হতভম্ব হয়ে পড়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রর কোচ গ্রেগ বারহল্টার ও অধিনায়ক টাইলার অ্যাডামস। এ দুজন যতই বলার চেষ্টা করুন, ম্যাচটা তাঁদের কাছে আর দশটা ম্যাচের মতোই, ততই ইরানি সাংবাদিকেরা তাঁদের চেপে ধরেছেন।
এমন প্রশ্নও তাঁদের দিকে ধেয়ে গেছে, যে তাঁরা একটি ‘বর্ণবাদী’ দেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন কি না! সংবাদ সম্মেলনে ইরানি নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রের ভিসার ব্যাপারটি এসেছে, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রাস্ফীতি নিয়েও প্রশ্ন ছুটে গেছে কোচ ও অধিনায়কের দিকে। বারহল্টার আর অ্যাডামসকে এমন অদ্ভুত জিজ্ঞাসাবাদের মধ্যে থাকতে হয়েছে আধঘণ্টার মতো।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম জানাচ্ছে, এই সংবাদ সম্মেলনে ইরানি সাংবাদিকেরা ফুটবল নিয়ে, আজ রাতের ম্যাচ নিয়ে বলতে গেলে তেমন কোনো প্রশ্নই নাকি করেননি। এক সাংবাদিক তো অধিনায়ক অ্যাডামসকে রীতিমতো শাসানি দিয়েছেন। সেই সাংবাদিকের অভিযোগ—অ্যাডামস ঠিকমতো ইরানের নামটি উচ্চারণ করেননি। মার্কিন উচ্চারণে ইরানকে ‘আইরান’ উচ্চারণ করেই বিপত্তিটা বাধান অ্যাডামস।
ইরানি কোচ কার্লোস কুইরোজ অবশ্য আশা করেছেন, পরের বিশ্বকাপ রাজনীতি খেলার মধ্যে সেভাবে আসবে না। রাজনৈতিক আলাপচারিতাও উঠবে না, বিশ্বকাপে আলোচনার কেন্দ্রে থাকবে ফুটবলই।
২৪ বছর আগে, ১৯৯৮ সালের ফ্রান্স বিশ্বকাপেও এই দুই দল মুখোমুখি হয়েছিল। সেই ম্যাচটিকে ঘিরে উত্তেজনা থাকলেও এবারের মতো অবস্থা ছিল না, এটাই বলাই যায়। লিওঁতে অনুষ্ঠিত সে ম্যাচের আগে অফিশিয়াল ফটোসেশনটি ছিল সৌহার্দ্যে পরিপূর্ণ। আলাদা আলাদা দলগত ছবি না তুলে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের ফুটবলাররা একসঙ্গে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছিলেন। ম্যাচের আগে বিনিময় করেছিলেন বিভিন্ন স্মারক।
দুই দলের খেলোয়াড়েরা পরস্পরকে বরণ করেছিলেন ফুলের মালা দিয়ে। তবে সে ম্যাচেও একটা বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। ফিফার নিয়মানুযায়ী আন্তর্জাতিক ম্যাচে অংশগ্রহণকারী দুটি দলের একটিকে ‘টিম এ’ ও অন্যটিকে ‘টিম বি’ হিসেবে ধরা হয়। কোনটি ‘টিম এ’, কোনটি ‘টিম বি’ সেটি নির্ধারিত হয় ম্যাচের আগে।
যেকোনোভাবেই হোক সে ম্যাচের ‘টিম বি’ ছিল ইরান। ফিফার নিয়মে ‘টিম বি’কে যেহেতু ‘টিম এ’র কাছে গিয়ে হাত মেলাতে হয়, তাই সেখানে বড় বিপত্তিই বেঁধে যায়। ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আলী খামেনি নির্দেশ দিয়েছিলেন ইরানি দল যেন কোনোমতেই আগে যুক্তরাষ্ট্র দলের কাছে গিয়ে হাত না মেলায়।
সে সময় মেহেরদাদ মাসুদি নামের ফিফার এক কর্মকর্তা সমস্যাটার সমাধান করেছিলেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্র দলকে অনুরোধ করেছিলেন, তারা যেন ইরানি দলের সঙ্গে আগে হাত মেলায়। যুক্তরাষ্ট্র সেটি মেনে নেওয়াতে বড় এই সমস্যার সমাধান হয়েছিল দ্রুতই।
মাঠের লড়াইয়ে অবশ্য ইরান ছিল সে ম্যাচে দুর্দান্ত। মেহেদী মাহদাভিকিয়া ও হামিদ রেজা এস্তিলির দুই গোলে যুক্তরাষ্ট্রকে ২–১ গোলে হারিয়েছিল তারা। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে একমাত্র গোলটি করেছিলেন ব্রায়ান ম্যাকব্রাইড।
ম্যাচটা শেষ হয়েছিল কোনো ধরনের বিতর্ক ছাড়াই। হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিল ফিফা, বিশ্বকাপের আয়োজক ফ্রান্স। ১৯৭৮ সালের পর প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে এশিয়ার অন্যতম প্রতিনিধি হয়ে ইরান দেশে ফিরেছিল যুদ্ধজয়ের আনন্দ নিয়ে। যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে ফুটবলে জয়—ইরানের কাছে তো যুদ্ধজয়ই।
২৪ বছর পর আরও একটি ইরান–যুক্তরাষ্ট্র ম্যাচে, দুই যুগ আগের স্মৃতিকে ধারণ করে রাজনীতি আর কূটনীতিকে একপাশে সরাতে পারলেই ফুটবলপ্রেমীরা উপহার পাবে উপভোগ্য এক ফুটবল–লড়াই।