বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত!
হ্যাঁ, ২০৩৪ ফিফা বিশ্বকাপ আয়োজকের ভোটাভুটিতে ‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা’তেই নির্বাচিত হয়েছে সৌদি আরব। ভোট যে হয়নি তা নয়। গতকাল ভার্চ্যুয়াল ফিফা কংগ্রেসে আয়োজক চূড়ান্ত করতে সদস্য দেশগুলোকে ভোট দিতে বলেছিল ফিফা। সেই ভোটে একটাই প্রার্থী, সৌদি আরব। ফিফার পক্ষ থেকে নামটি বলার পর সদস্যরা শুধু হাত তালি দিয়ে সমর্থন জানিয়েছেন। এই সমর্থনই ভোট।
তবে সৌদি আরবের বিশ্বকাপ আয়োজক স্বত্ব পাওয়াকে ভালো মনে করছে না মানবাধিকার সংস্থাগুলো। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ ২১টি মানবাধিকার সংস্থার যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, ‘অধিবাসী, অভিবাসী কর্মী ও দর্শনার্থী সমর্থকদের জন্য সুপরিচিত ও গুরুতর ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও সৌদি আরবকে টুর্নামেন্ট আয়োজনের স্বত্ব প্রদানবিষয়ক ফিফার সিদ্ধান্তটি একটি বড় বিপদের মুহূর্ত চিহ্নিত করছে।’
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের হেড অব লেবার রাইটস অ্যান্ড স্পোর্টসের প্রধান স্টিভ ককবার্ন বলেন, ‘প্রাপ্ত সুস্পষ্ট প্রমাণের ভিত্তিতে ফিফা জানে সৌদি আরবে মৌলিক সংস্কার ছাড়াই শ্রমিকদের শোষণ করা হবে এবং এমনকি মেরেও ফেলা হবে। তবুও তারা এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’
এবারই প্রথম নয়, সৌদি আরব বিশ্বকাপ আয়োজনের আগ্রহ প্রকাশ করার পর থেকেই এ নিয়ে সমালোচনা করে এসেছে সংস্থাগুলো। প্রশ্ন হতে পারে, সমালোচনার পরও ২০৩৪ বিশ্বকাপ আয়োজনের ভোটাভুটিতে সৌদি আরবের প্রতিদ্বন্দ্বী কেউ ছিল না কেন? সৌদি আরব বৈশ্বিক অঙ্গনে নিজেদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে চায়, এটা জানা কথা। কিন্তু শুধু টাকা দিয়েই কি বিশ্বের দুই শটির বেশি ফিফা সদস্যকে ‘হাত’ করেছে সৌদি আরব? নাকি বিশ্বকাপ আয়োজনে অন্য কোনো সমীকরণও আছে?
হ্যাঁ, বড় সমীকরণই আছে। আছে মারপ্যাঁচও। বিশ্বকাপ ফুটবলকে সত্যিকারের বৈশ্বিক রূপ দিতে এর আয়োজক স্বত্ব প্রদানে একটি ‘আবর্তন নীতি’ আছে ফিফার। এই নীতি অনুসারে একটি মহাদেশ টানা দুবার বা এক আসর বিরতি দিয়ে দুটি বিশ্বকাপ আয়োজন করতে পারবে না। অন্তত দুটি আসরের বিরতি থাকতেই হবে।
এই নীতির কারণে ২০৩৪ বিশ্বকাপ আয়োজনের জন্য শুরুতেই বাদ পড়ে উত্তর ও মধ্য আমেরিকা। কারণ ২০২৬ বিশ্বকাপ যৌথভাবে আয়োজন করবে এই অঞ্চলের যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও মেক্সিকো। ফিফার সদস্য কনফেডারেশনের মধ্যে উত্তর-মধ্য আমেরিকার কনক্যাকাফ ছাড়াও আছে দক্ষিণ আমেরিকার কনমেবল, ইউরোপের উয়েফা, এশিয়ার এএফসি, আফ্রিকার সিএএফ এবং ওশেনিয়ার ওএফসি।
২০২৬ বিশ্বকাপের মতো ২০৩০ বিশ্বকাপের আয়োজকেরাও ২০৩৪ বিশ্বকাপের স্বত্ব পাওয়ার যোগ্য নয়। ২০৩০ বিশ্বকাপের জন্য আগেই যৌথভাবে প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে স্পেন, পর্তুগাল ও মরক্কো। এই আসরের জন্য লাতিন আমেরিকার তিন দেশ উরুগুয়ে, আর্জেন্টিনা ও প্যারাগুয়েরও আগ্রহ ছিল। তবে একপর্যায়ে তারা সরে যায়।
ফিফা সিদ্ধান্ত নেয়, স্পেন, পর্তুগাল ও মরক্কোর প্রস্তাবই বেশি উপযুক্ত, তবে ২০৩০ সালে যেহেতু বিশ্বকাপের শতবর্ষ পূর্ণ হতে চলেছে, সেটিরও একটা ছাপ রাখা দরকার। ১৯৩০ সালে প্রথম ফিফা বিশ্বকাপ আয়োজন করেছিল উরুগুয়ে। বিশ্বকাপের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে দেশটিতে ম্যাচ রাখার পরিকল্পনা নেয় ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা। সঙ্গে যুক্ত করা হয় ম্যাচ আয়োজনের আগ্রহ প্রকাশ করা আর্জেন্টিনা, প্যারাগুয়েকেও।
সব মিলিয়ে ২০৩০ বিশ্বকাপের জন্য আয়োজকের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৬-এ। কাল রাতে ফিফা কংগ্রেসে এটিই চূড়ান্তভাবে অনুমোদিত হয়েছে। ২০৩০ বিশ্বকাপের তিনটি ছাড়া বাকি সব ম্যাচই আয়োজক করবে স্পেন, পর্তুগাল ও মরক্কো। আর উরুগুয়ে, আর্জেন্টিনা ও প্যারাগুয়ে আয়োজন করবে শুরুর দিকের একটি করে ম্যাচ।
২০৩০ বিশ্বকাপের ৬ আয়োজকের ছকেই নির্ধারিত হয়ে যায় ২০৩৪ বিশ্বকাপের ভবিষ্যৎ। কারণ, ওই ৬ দেশের অবস্থান তিনটি মহাদেশে। উরুগুয়ে, আর্জেন্টিনা ও প্যারাগুয়ে দক্ষিণ আমেরিকার, স্পেন ও পর্তুগাল ইউরোপের আর মরক্কো আফ্রিকার। যে কারণে ২০৩৪ বিশ্বকাপের জন্য উত্তর ও মধ্য আমেরিকার পাশাপাশি এই তিনটি মহাদেশের সব দেশও বিশ্বকাপের আয়োজক হওয়ার সুযোগ হারিয়ে ফেলে। ২০৩৪ বিশ্বকাপের জন্য ‘বিড’ করার সুযোগ থাকে শুধু এএফসি ও ওএফসির।
এর মধ্যে ওএফসিতে বড় কোনো দেশই নেই। নিউজিল্যান্ড বাদে ফিজি, তাহিতি, পাপুয়া নিউগিনির মতো দেশগুলোর আঞ্চলিক টুর্নামেন্ট আয়োজনের সক্ষমতাই কম।
বাকি থাকে এএফসির অধীনে থাকা দেশগুলো। এই এএফসিতে খেলা অস্ট্রেলিয়া এবং ইন্দোনেশিয়া প্রাথমিকভাবে ২০৩৪ বিশ্বকাপের জন্য চিন্তা করেছিল। কিন্তু ২০২৩ সালের অক্টোবরে তারা সরে দাঁড়ায়। ওই মাসেই ফিফা ২০৩৪ বিশ্বকাপ আয়োজনের আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব আহ্বান করে। যোগ্যতা হিসেবে ৪০ হাজার দর্শক ধারণক্ষমতা সম্পন্ন অন্তত ৪টি স্টেডিয়ামসহ বিভিন্ন শর্ত দেওয়া হয়। এ সব শর্ত মেনে একমাত্র দেশ হিসেবে ‘বিড’ করে সৌদি আরব। ২০২৩ সালের ৩১ অক্টোবর ফিফা সভাপতি জিয়ান্নি ইনফান্তিনোর কথায় স্পষ্ট হয়ে যায়, সৌদি আরবই বিশ্বকাপ আয়োজন করতে যাচ্ছে। বাকি শুধু কংগ্রেসের আনুষ্ঠানিকতা।
তবে যেভাবে বর্ণনা করা হলো, ব্যাপারটা এতটা সরলও নয়। গত বছরের নভেম্বরে সৌদি আরবের বিশ্বকাপ আয়োজক হওয়া নিয়ে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে নিউইয়র্ক টাইমস। প্রতিবেদনে বলা হয়, সৌদিকে বিশ্বকাপ পাইয়ে দিতে মূল ভূমিকা রেখেছেন ফিফা সভাপতি ইনফান্তিনো।
তিনি সৌদি সরকারের অনুকূলে কাজ করেন, এবং ২০৩০ বিশ্বকাপ গ্রিসকে সঙ্গে নিয়ে আয়োজনের চেষ্টাও চালান। তবে স্পেন, পর্তুগাল ও মরক্কো ২০৩০ বিশ্বকাপের জন্য ‘বিড’ করার ঘোষণা দিলে পরিকল্পনায় পরিবর্তন এনে ২০৩৪ বিশ্বকাপকে লক্ষ্য করা হয়। কারণ ২০৩০ বিশ্বকাপ আয়োজনে ‘বিড’ করলে বাকি তিন দেশের কাছে হেরে যাওয়ার ভয় ছিল সৌদির।
এ সময় ফিফার নেওয়া দুটি সিদ্ধান্তকে ‘কৌতূহলোদ্দীপক’ আখ্যা দেয় নিউইয়র্ক টাইমস। সেটি হচ্ছে বিশ্বকাপের শতবর্ষপূর্তির কথা বলে উরুগুয়ে, আর্জেন্টিনা ও প্যারাগুয়েতে ২০৩০ আসরের ম্যাচ আয়োজন এবং স্পেন, পর্তুগাল ও মরক্কোকে আয়োজক স্বত্ব প্রদানের সিদ্ধান্ত। এর মাধ্যমে একসঙ্গে তিন মহাদেশকে ২০৩৪ বিশ্বকাপের দৌড় থেকে ‘ছিটকে দেয়’ ফিফা। এমনকি অন্য সময় ‘বিডিং প্রক্রিয়া’য় যথেষ্ট সময় দেওয়া হলেও ২০৩৪-এর বেলায় মাত্র ২৫ দিন সময় দেওয়া হয়। আর বিডিং প্রক্রিয়া শুরুর কয়েক মিনিটের মধ্যেই সৌদি আরব বিশ্বকাপ আয়োজনের আগ্রহ প্রকাশ করেছিল।
বিশ্বকাপ আয়োজকের ভোটাভুটিতে সৌদি আরবের প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকা তাই স্বাভাবিকই!