এটাই কি বিশ্বকাপের ইতিহাসের সেরা ফাইনাল? হয়তো। এটাই কি বিশ্বকাপ ইতিহাসের সেরা ম্যাচ? হয়তো।
এ যেন নিয়তিরই লিখন! লিওনেল মেসির হাতে বিশ্বকাপ যাবে, কিন্তু সেটা যেনতেনভাবে নয়। নাটকের পর নাটক, স্নায়ুর চূড়ান্ত পরীক্ষা শেষে সম্ভবত বিশ্বকাপ ইতিহাসে সবচেয়ে অবিশ্বাস্য চিত্রনাট্যের সমাপ্তিটা হবে মেসির হাতে ট্রফি ওঠার মধ্য দিয়ে। যে ট্রফি দিয়ে ফুরিয়েছে আর্জেন্টিনার ৩৬ বছরের বিশ্বজয়ের অপেক্ষা। কে জানে হয়তো এর মধ্য দিয়ে শেষ হবে সর্বকালের সেরা ফুটবলার নিয়ে বিতর্কও। যে অধরা ট্রফিটা ছিল না বলে মেসিকে সেরা মানতে রাজি ছিলেন না অনেকে, কাল সেই ট্রফিটাও মেসির হয়ে গেল।
মেসির জোড়া গোল, এমবাপ্পের হ্যাটট্রিক, দি মারিয়ার গোল মিলিয়ে নির্ধারিত ও অতিরিক্ত সময় শেষে ৩-৩ সমতা। তারপর টাইব্রেকারে ৪-২ ব্যবধানে জিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা।
এমবাপ্পেও পারলেন না। হ্যাটট্রিক করলেন, প্রায় ছিটকে যাওয়া ম্যাচ থেকে অবিশ্বাস্যভাবে ফ্রান্সকে নিয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত টাইব্রেকারে ফ্রান্সের টানা দ্বিতীয় বিশ্বকাপ জয়ের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে গেলেন এমিলিয়ানো ‘দিবু’ মার্তিনেজ। টাইব্রেকারে ফ্রান্সের প্রথম শট ঠেকিয়ে গেলেন, পরের শটটাও মিস করল ফ্রান্স। কে জানে, বিশ্বকাপ ট্রফিতে তখনই আর্জেন্টিনার নাম লেখা হয়ে গেল আসলে।
অথচ প্রথম এক ঘণ্টা শেষে কে ভেবেছিল এই ম্যাচটা অতিরিক্ত সময়ে যাবে! কে ভেবেছিল টাইব্রেকারে যেতে হবে এই ফাইনালের ফল পেতে। তখন পর্যন্ত ম্যাচে তো ফ্রান্স বলতে গেলে নেই-ই বলা যায়। শুধু ২ গোল খেয়ে পিছিয়েই নয়, মনে হচ্ছে ওরা খেলছেই না। ফাইনাল একটা দলের মধ্যেই হচ্ছে। এটাই কি বিশ্বকাপের সবচেয়ে একতরফা ম্যাচ হতে যাচ্ছে কি না, সেই আলোচনাও ততক্ষণে শুরু হয়ে গেছে।
টাইব্রেকারে আর্জেন্টিনার ৪ নম্বর কিক নেওয়া গঞ্জালো মন্তিয়েলের শট যখন ফ্রান্সের জালে গেল, লুসাইল স্টেডিয়ামে সঙ্গে সঙ্গে একটা গগনবিদারী গর্জন। মন্তিয়েল জার্সিতে মুখ ঢেকে কাঁদতে শুরু করলেন। মাঠে থাকা আর্জেন্টাইন খেলোয়াড়েরাও সঙ্গে সঙ্গে উচ্ছ্বাসের পরপরই আবেগাপ্লুত হয়ে গেলেন। চোখ থেকে জল পড়তে লাগল প্রায় সবার।
কাঁদলেন মেসিও। এমন একটা দিনের অপেক্ষাতেই তো ছিলেন তিনি সেই ২০০৬ বিশ্বকাপ থেকে। কিন্তু বিশ্বকাপ তাঁকে বারবার হতাশ করে ফিরিয়েছে। আট বছর আগে মারাকানায় খুব কাছে গিয়েও ফাইনালে হারতে হয়েছিল জার্মানির অতিরিক্ত সময়ে দেওয়া গোলে। কিন্তু কাল রাতে আর মেসি খালি হাতে ফিরে যেতে রাজি ছিলেন না। আর মেসি যদি রাজি না থাকেন, তাঁকে ফেরানোর সাধ্য কার!
এই বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার কোচ লিওনেল স্কালোনি কৌশলের খেলায় অনেক চমক দেখিয়েছেন। তবে কাল আনহেল দি মারিয়াকে উইংয়ের বা পাশে নামানোর সিদ্ধান্তটা একেবারে মাস্টারস্ট্রোক। ওদিকে জুলস কুন্দে মূলত সেন্টারব্যাক, বিশ্বকাপে তাঁকে রাইটব্যাক হিসেবে খেলাচ্ছেন ফ্রান্সের কোচ দিদিয়ের দেশম। কিন্তু নিজের জায়গা থেকে কিছুটা ভেতরে চলে আসার প্রবণতা আছে কুন্দের। আগের ম্যাচগুলোতে এটা বড় কোনো সমস্যা হয়ে দেখা দেয়নি। কিন্তু গতকাল দিল। বাঁ পাশে একেবারে ফাঁকা প্যাসেজ পেয়ে গেলেন দি মারিয়া। আর্জেন্টিনাও তাই ওই পাশ দিয়েই আক্রমণের চেষ্টা করে গেছে। ফল পেতেও বেশি দেরি হয়নি।
২১ মিনিটে বাঁ প্রান্ত দিয়ে বল নিয়ে ফ্রান্সের বক্সে ঢোকার চেষ্টা করেন দি মারিয়া। ফরাসি উইঙ্গার উসমান দেম্বেলে পেছন থেকে তাঁকে ট্যাকল করতে গিয়ে ফেলে দেন, পেনাল্টি পায় আর্জেন্টিনা। স্পটকিক থেকে ফ্রান্সের গোলকিপার উগো লরিসকে ফাঁকি দিয়ে ডান দিক দিয়ে নেওয়া শটে গোল করেন মেসি।
গোল্ডেন বুটের জন্য বিশ্বকাপজুড়ে চলা মেসি-এমবাপ্পের অবিশ্বাস্য লড়াইটাও নতুন মাত্রা পায় আসলে সেখান থেকে। ফাইনালের আগে মেসি ও কিলিয়ান এমবাপ্পে দুজনেরই ছিল সমান ৫টি করে গোল। ৬ নম্বর গোল করে মেসি পেছনে ফেলে দেন ফরাসি ফরোয়ার্ডকে। তখন কে জানত, এমবাপ্পে এই পিছিয়ে থাকা মেনে নেবেন না। হ্যাটট্রিক করে গুনে গুনে দুই গোল করে মেসিকে ঠিকই পেরিয়ে যাবে সোনার জুতার লড়াইয়ে। সেটা অবশ্য বেশ পরের গল্প।
এই ম্যাচে দি মারিয়ার গল্প যে তখনো শেষ হয়নি। ৩৬ মিনিটে আর্জেন্টিনার দ্বিতীয় গোলটি যে এল তাঁর পা থেকেই। ফরাসি রক্ষণ ফাঁকা পেয়ে ডান প্রান্তে অ্যালেক্সিস ম্যাক অ্যালিস্টারকে পাস বাড়ান মেসি। ম্যাক অ্যালিস্টার বাঁ প্রান্তে বল বাড়ান আরও ভালো অবস্থানে থাকা দি মারিয়াকে। ফ্রান্সের গোলকিপার লরিস দি মারিয়াকে আটকাতে এগিয়ে গেলেও ঠান্ডা মাথার ফিনিশিংয়ে বল জালে চালান করেন দি মারিয়া।
কিন্তু ফুটবল ম্যাচ কত দ্রুত রং বদলাতে পারে, সেটা দেখাতেই যেন লুসাইল তৈরি হয়ে ছিল কাল। দেশমের বদলি কাজে দিল আলাদিনের চেরাগের মতো। বিরতির আগেই নামিয়েছিলেন রান্দাল কোলো মুয়ানিকে, ৭১ মিনিটে নামেন এদুয়ার্দ কামাভিঙ্গা। ৮০ মিনিটে কোলো মুয়ানিকে ঠেকাতে গিয়েই ডি-বক্সে ফাউল করে পেনাল্টি দেন আর্জেন্টাইন ডিফেন্ডার নিকোলাস ওতামেন্দি। স্পট কিক থেকে গোল করে ব্যবধান কমান কিলিয়ান এমবাপ্পে। কিন্তু আসল কাজটা করেন পরের মিনিটেই। মেসির কাছ থেকে বল কেড়ে নিয়ে এমবাপ্পেকে পাস বাড়িয়েছিলেন কিংসলে কোমান। মার্কাস থুরামের সঙ্গে ওয়ান-টু খেলে এমবাপ্পে নিলেন অসাধারণ এক শট। ২-২। ওই গোলে শুধু মেসিকে ছাড়িয়ে গোল্ডেন বুটের লড়াইয়েই এগিয়ে গেলেন না এমবাপ্পে, ফ্রান্সকে একেবারে চাঙা করে তুললেন। তখন কে জানত, মেসি পিছিয়ে পড়ে থাকবেন না।
অতিরিক্ত সময়ে আরও এক গোল করে আবার এমবাপ্পেকে ধরলেন। কিন্তু ১১৮ মিনিটে পাওয়া পেনাল্টি থেকে গোল করে এমবাপ্পে আবার তাঁকে ছাড়িয়ে গেলেন। শেষ পর্যন্ত গোল্ডেন বুট এমবাপ্পেই পাচ্ছেন। কিন্তু বিশ্বকাপের ট্রফিটা নিতে পারলেন না মেসির কাছ থেকে।