শেষ হাসিটা হাসতে পারবেন লিওনেল মেসি?
শেষ হাসিটা হাসতে পারবেন লিওনেল মেসি?

লেটস এনজয় মেসি

২০১৪ বিশ্বকাপ ফাইনালের দিন যে কথাটা লিখেছিলাম, তা দিয়েই কি শুরু করব লেখাটা! সেই প্রশ্নটা দিয়ে—লিওনেল মেসি কি কাল রাতে ঘুমাতে পেরেছেন?

অবিশ্বাস্য এক ফুটবল–জীবনে অপ্রাপ্তি বলতে একটাই। জীবনে কত গোল করেছেন, কত গোল করিয়েছেন, কত ম্যাচ জিতেছেন, কত ম্যাচ জিতিয়েছেন। আর একটা ম্যাচ, একটা মাত্র ম্যাচ জিততে পারলেই সেই অতৃপ্তি ঘুচে গিয়ে কানায়–কানায় ভরে উঠবে অর্জনের থালা। এমন একটা সম্ভাবনা সামনে নিয়ে কি ঘুমানো যায়! কীভাবে ঘুমাবেন লিওনেল মেসি! নাকি সাধারণ মনুষ্য হয়ে জিনিয়াস নিয়ে অনুমান করার ভুল করে ফেলছি! মেসিরা কি আর আমাদের মতো!

তা ছাড়া আট বছর আগে রিওর সেই রাতেই কি একবার এ অভিজ্ঞতার সঙ্গে পরিচয় হয়ে যায়নি তাঁর! পরদিন ২০১৪ বিশ্বকাপ ফাইনাল, পুরো বিশ্ব তখনো কি একমাত্র ওই অপ্রাপ্তির কথা বলেনি!

আর্জেন্টিনা অধিনায়ক লিওনেল মেসি

সেই ফাইনালে কী হয়েছিল, তা আর নতুন করে বলার দরকার আছে বলে মনে হয় না। মাঝখানে একটা বিশ্বকাপ যাওয়ার পরই যে আবার সুযোগ আসবে, এটা তো আর তখন মেসির জানার কথা নয়। এ কারণেই মারাকানার সেই সন্ধ্যায় উদ্‌গত অশ্রু লুকিয়ে রাখতে এমন কষ্ট হচ্ছিল তাঁর।

সেই ফাইনালের পর কোপায় পরপর দুটি ফাইনালেও পরাজয়ের দুঃখে ২০১৬ সালে যখন অবসরই নিয়ে ফেলেছিলেন, তখনই–বা কে ভেবেছিল আজকের দিনটার কথা। একমাত্র অতৃপ্তিটা ঘুচিয়ে দিতে মেসি আবার বিশ্বকাপ ফাইনালে খেলতে নামবেন। সেই ফাইনালে বাকি সব অদৃশ্য হয়ে যেতে চাইবে। সবকিছু ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠবে একটা প্রশ্নই—পারবেন তো মেসি?

না, এমন কখনো হয়নি আগে। শুধুই একজন খেলোয়াড়ের বর্ণচ্ছটায় বিশ্বকাপ ফাইনালকে এমন আড়াল হয়ে যেতে এর আগে কেউ দেখেনি। ২০০৬ বিশ্বকাপ ফাইনালের আগে জিনেদিন জিদানকে নিয়ে আলোচনা ছিল। বিশ্বকাপের পরেই অবসর নেওয়ার আগাম ঘোষণা দিয়েছিলেন বলে। তবে ফাইনালের পর জিদানকে নিয়ে যত কথা হয়েছিল, ফাইনালের আগে তার ১ শতাংশও নয়। জিদান যে আগেই বিশ্বকাপ জিতে রেখেছিলেন।

এটা একটা কারণ, তবে একমাত্র নয়। ফুটবল ইতিহাসের গ্রেটদের তালিকায় জিদান অবশ্যই থাকবেন, তবে মেসির মতো এমন দিনের পর দিন, বছরের পর বছর আবেগের ভেলায় ভাসাতে পেরেছেন নাকি! দলমত–নির্বিশেষে প্রায় পুরো বিশ্ব এই যে মেসির জন্য প্রার্থনায় বসে গেছে, এটাই–বা এর আগে কোন খেলোয়াড়ের ক্ষেত্রে হয়েছে? ফাইনালটা ফ্রান্স বনাম অবশিষ্ট বিশ্ব হয়ে যাচ্ছে শোনার পর ফ্রান্সের কোচ দিদিয়ের দেশম সংশোধনী দিয়ে বলছেন, ‘ফ্রান্সেরও অনেকে মেসির জন্য ফাইনালে আর্জেন্টিনার জয় চাইবে।‌’

২০১৪ বিশ্বকাপ ফাইনালেও এমন হয়েছিল। সেমিফাইনালে টাইব্রেকারে হারার পর নেদারল্যান্ডসের উইঙ্গার আরিয়েন রোবেন অনেক গরম–গরম কথা বলেছিলেন। ফাইনালের আগে সেই রোবেনই আবার বলেছেন, ‘বিশ্বকাপটা মেসির প্রাপ্য।‌’ নেইমার বলেছিলেন, ‘খেলাটার ইতিহাসে মেসি এমন গুরুত্বপূর্ণ যে বিশ্বকাপটা ওর পাওনা হয়ে গেছে‌।’

তখনই নেইমার এ কথা বলে থাকলে মাঝের প্রায় সাড়ে আট বছরে তো তা আরও বেশি সত্যি। ২০১৪ ফাইনালের আগে আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে ৯২ ম্যাচে মেসির ৪২ গোল। আর আজকের ফাইনালে খেলতে নামার আগে যা হয়ে গেছে ১৭১ ম্যাচে ৯৬। তখন ব্যালন ডি’অর ছিল চারটি, এখন সাতটি। বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলার রেকর্ডটা শুধুই নিজের করে নিচ্ছেন আজ। সঙ্গে গোল্ডেন বল, গোল্ডেন বুট—সবকিছুই জিতে নেওয়ার সুযোগ। শেষ পর্যন্ত যদি তা হয়, বলতেই হবে, ফুটবল এমন বিদায় দেখেনি কখনো।

লিওনেল মেসি

বিদায় বলতে শুধুই বিশ্বকাপকে বিদায়, হয়তো আন্তর্জাতিক ফুটবলকেও। কিন্তু ক্লাব ফুটবল থেকে সরে দাঁড়ানোর কোনো চিন্তা তো শোনা যায়নি এখনো। মেসিকে হয়তো এরপরও দেখা যাবে মাঠে, তবে আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে আজই শেষবার। আর্জেন্টিনার কোচ লিওনেল স্কালোনি এই বিশ্বকাপে কথাটা আগেও বলেছেন। ফাইনালের আগে বললেন আবারও, ‘লেটস এনজয় মেসি।’

তা মেসি তো ‘এনজয়’ করারই জিনিস। খেলা দেখার অনেক দিন পরও মানুষ কী মনে রাখে? মনে রাখে, মোমেন্টস। বাংলায় ‘মুহূর্ত’ বলা যায়। যদিও তাতে হয়তো ঠিক বোঝানো যায় না। অনেক দিন পর একটা ফুটবল ম্যাচের একটা গোল, একটা অ্যাসিস্ট, একটা ড্রিবলিং, একটা দৌড়...এসবই তো চোখে ভাসে।

এই বিশ্বকাপেই এমন কতগুলো হিরণ্ময় মুহূর্তের জন্ম দিয়েছেন মেসি, একবার মনে করে দেখুন তো! মেক্সিকো আর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ওই ২টি গোল, নেদারল্যান্ডস ম্যাচে মলিনাকে ‘অ্যাসিস্ট অব দ্য ওয়ার্ল্ড কাপ’, ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে ওই সর্পিল দৌড়...পড়তে পড়তে ভাসছে না সব চোখে!

বিশ্বকাপ জিতলেই সর্বকালের সেরা কি না, না জিতলেই–বা কেন নয়—এসব তর্ক বরং থাক। বিশ্বকাপে লিওনেল মেসির শেষ ম্যাচ। বিশ্বকাপ জিতে বিদায় নিতে পারলে ভালো। না পারলেও মনে রাখার মতো অমন আরও কিছু ‘মোমেন্ট’ যেন দিয়ে যেতে পারেন।

লেটস এনজয় মেসি!