গল্পটা হলুদ-নীল কার্নিভাল পেরোনোর। রূপকথাও হার মেনে যায় কখনো কখনো। কে জানে, এসব গল্পই হয়তো একদিন রূপকথার অংশ হবে! এই গল্প এতটাই রোমাঞ্চকর যে রিওর উৎসব কিংবা ‘সিটি অব গড’ সিনেমার সেলুলয়েডজুড়ে চলতে থাকা রুদ্ধশ্বাস উপাখ্যানগুলোও ম্লান মনে হয়। যেখানে মানুষ অতীত ও বর্তমানের সব স্মৃতি ভুলে অপেক্ষা করে একটি অলৌকিক গোলকের। চামড়ার সেই গোল বলটিই শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠে মানুষগুলোর স্বপ্ন।
এই স্বপ্ন থেকে জেগে ওঠে জোগো বনিতো কিংবা সাম্বার ছন্দ। জিঙ্গার তালে তালে গোটা দুনিয়া তাঁদের সঙ্গে মেতে ওঠে সেই নাচে। নাচ শেষে হাসি মুখেই আবার বাড়ি ফিরে যান মানুষগুলো, ঘুমিয়ে পড়েন সেই বলকে জড়িয়ে। পরদিন আবার একই নিয়মে জেগে ওঠেন। আবার সেই বল নিয়ে সাম্বা কিংবা জোগো বনিতো, যা আর কখনোই শেষ হয় না। কারণ, ফুটবল তাঁদের কাছে নিছক কোনো খেলা নয়। এটি তাঁদের জন্য ধর্ম, অহম ও অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা চিরন্তন এক পরিচয়। যা শুরু হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু আর শেষ হয়নি, হবেও না। ব্রাজিল ও ফুটবলের সম্পর্কটা এমনই চিরন্তন।
ফুটবলকে ব্রাজিলিয়ানরা কীভাবে দেখেন, সেটা দেশটির কিংবদন্তি ফুটবলার সক্রেটিসের কাছ থেকেই শোনা যাক, ‘ফুটবল এমন একটি খেলা, যার সৃষ্টি হচ্ছে স্বতঃস্ফূর্ততা, বুদ্ধিবৃত্তি, বিলাসিতা, স্বাধীনতা এবং আমাদের সবচেয়ে আদি প্রবৃত্তিগুলোর অংশ, যেমন নাচ থেকে।’
১৩০ বছর আগে স্কটিশ অভিবাসী টমাস ডনোয়ের মাধ্যমে ফুটবলের সঙ্গে পরিচয় হয় ব্রাজিলিয়ানদের। কিন্তু সেই পরিচয়ই শেষ কথা নয়! ফুটবল নামক খেলাটির সঙ্গে তাদের পরিচয়ের শুরুটা তখন হতে পারে, কিন্তু সাম্বা ও জিঙ্গার ভেতর দিয়ে আমাজান পাড়ের মানুষেরা ফুটবলের নির্যাসকে বয়ে চলেছে আরও অনেক আগে থেকে। তাই খেলাটাকে যখন তাঁদের সামনে রাখা হয়, তাঁরা নিজস্ব ছন্দের ভেতর দিয়ে সহজেই সেটাকে আত্তীকরণ করে নিতে পেরেছিল।
আর তাঁদের স্পর্শে ফুটবল নামের সেই খেলাটি মুহূর্তের মধ্যে পৌঁছে যায় শিল্পের সর্বোচ্চ স্তরে। যে কারণে ১৯৫০ বিশ্বকাপে শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে গোল বাঁচাতে না পারা ব্রাজিলিয়ান গোলরক্ষক মোয়াকির বারবোসাকে ‘অভিশপ্ত’ হয়ে কাটাতে হয় গোটা জীবন। আবার তিনটি বিশ্বকাপ জেতানো পেলেকে অমরত্ব দিয়ে মর্যাদা দেওয়া হয় ‘ক্রাইস্ট দ্য রিডিমার’–এর পর্যায়ে। ব্রাজিলে ফুটবল নামের খেলাটির প্রভাব এমনই।
কিন্তু এতক্ষণ যা বলা হলো, সেসব শুধুই অতীতের চাদরে মোড়া জং ধরা এক গল্প। যে গল্পে প্রায় দুই দশকের বেশি সময় ধরে একটু একটু করে ধুলা জমতে শুরু করেছে। যেন মেঘের জাল গুটিয়ে আকাশে ফিরে গেছেন অভিজ্ঞ মল্লার। ব্রাজিলের ফুটবল এখন যেন হারানো সেই ঐতিহ্য ফিরে পেতে গুমরে কাঁদছে। ২০০২ সালের পর থেকে প্রতিটি বিশ্বকাপে যে কান্না হলুদ–জ্বরের সমার্থক হয়ে আছে। কারণ, ব্রাজিলিয়ান ফুটবলে বিশ্বকাপই সাফল্যের শেষ কথা।
দুই বছর ধরে ব্রাজিলের ফুটবল যে দুঃসময় পার করছে, তা সম্ভবত নজিরবিহীন। এতটা হতশ্রী ও দিশাহীন সময় বোধ হয় ব্রাজিলের ফুটবল কখনো পার করেনি। কোচ নিয়ে সংকট, ফেডারেশনে দুর্নীতি–অনিয়ম, সেরা খেলোয়াড়ের চোটে পড়ে ছিটকে যাওয়া। আর এই হতশ্রী সময়টাকে একটা ম্যাচ দিয়ে যদি স্পষ্ট করতে হয় তবে সেটি হচ্ছে মারাকানায় ব্রাজিল–আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপের বাছাইয়ের ম্যাচটি।
মাঠে ও মাঠের বাইরে চূড়ান্ত বিশৃঙ্খল ও ভুলে যাওয়ার মতো ফুটবল সেদিন খেলেছিল ব্রাজিল। দুই দলের সমর্থকদের মারামারিতে এমনকি খেলোয়াড়েরাও জড়িয়ে পড়েছিলেন। এরপর মাঠের খেলায় ১–০ গোলে হেরে ব্যর্থতার ষোলোকলাও পূর্ণ করে ব্রাজিল। এত কিছুর পরও অন্ধকার টানেলের শেষে আলো তো আর মিথ্যা নয়। যেমন মিথ্যা নয় মেঘের আড়ালে সূর্যের হেসে ওঠার ধারণাও। সেই নিয়ম মেনে ব্রাজিল ফুটবলও নিশ্চয় ফিরবে চেনা পথে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কবে? এবারের কোপা আমেরিকা কি ব্রাজিলকে ফেরাবে তার চেনা পথে? সে প্রশ্নের উত্তর এখনই পাওয়া কঠিন।
ফলে সময়ের হাতে উত্তরটুকু তুলে রেখে ব্রাজিল দলের বর্তমান অবস্থাটুকু একবার খতিয়ে দেখা যাক। ব্রাজিলিয়ান ফুটবলে বিপর্যয়ের শুরুটা মূলত কাতার বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায়ের মধ্য দিয়ে। এরপর কোচের পদ থেকে তিতের সরে যাওয়া, সেই শূন্যস্থান পূরণে কার্লো আনচেলত্তির জন্য বৃথা অপেক্ষা ও ফার্নান্দো দিনিজের ব্যর্থতার পর দরিভাল জুনিয়রে শরণাপন্ন হওয়ার ঘটনাগুলো তো জানাই। তবে সব ভুলে ব্রাজিল সমর্থকেরা এখন দরিভালের কাঁধেই চাপিয়েছে স্বপ্নের জোয়াল।
দরিভালের মধ্য দিয়ে ‘সেলেসাও’ ফুটবলে নতুন জন্ম দেখতে চান তাঁরা। শুরুর চার ম্যাচের ২টিতে জয় ও ২টিতে ড্র দিয়ে এরই মধ্যে ইতিবাচক কিছু করার ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছেন দরিভাল। পথটা যে এখনো অনেক দীর্ঘ ও বন্ধুর। তবে এবারের কোপা আমেরিকা হতে পারে দরিভালের জন্য নিজেকে প্রমাণ করার মোক্ষম মঞ্চ, যার শুরুটা হবে আগামীকাল সকাল ৭টায় কোস্টারিকার বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে। দরিভালের হাতে এ মুহূর্তে বিশ্বের অন্যতম সেরা কিছু ফুটবলারও আছেন। অপেক্ষা শুধু প্রয়োজনের সময় ঐক্যবদ্ধভাবে জ্বলে ওঠার।
ব্রাজিল দলকে উজ্জীবিত রাখার পাশাপাশি দরিভাল কীভাবে খেলাবেন, সেদিকেও চোখ থাকবে ফুটবলপ্রেমীদের। ২০০২ সালে পেশাদার কোচ হিসেবে অভিষিক্ত দরিভাল গত ২১ বছরে ভারপ্রাপ্ত ও স্থায়ী হিসেবে মোট ২০টি ক্লাবের দায়িত্ব পালন করেছেন। শুধু ২০০৫ সালেই ছিলেন ৪টি দলের কোচ। মাঝে অসুস্থতার জন্য কিছু সময় কোচিং থেকে বিরতিও নিয়েছিলেন। ক্লাব বদলানোর মতো কৌশলেও খুব একটা স্থির নন দরিভাল।
কোনো নির্দিষ্ট কৌশল আঁকড়ে দলকে খেলানোর পরিবর্তে খেলোয়াড়দের শক্তি–সামর্থ্য অনুযায়ী দল পরিচালনা করেন ক্যানসারজয়ী এ কোচ। যে কারণে ফরমেশনেও অদল–বদল আনতে দেখা যায় তাঁকে। ব্রাজিল দলের কোচ হওয়ার আগে ৪-৪-২ ফরমেশনে এবং কখনো কখনো এই ফরমেশনকে ভেঙে দলকে খেলিয়েছেন। আবার অনেক সময় দলের প্রয়োজনে ৪-২-৩-১ ফরমেশনেও দল সাজিয়েছেন দরিভাল। তবে সাম্প্রতিক সময়ে প্রীতি ম্যাচগুলো বিবেচনায় রাখলে কোপায় দরিভালের ব্রাজিলকে ৪–৩–৩ ফরমেশনে খেলতে দেখা যেতে পারে।
শুধু ফরমেশনেই নয়, খেলার ধরনেও দেখা যেতে পারে নতুন এক ব্রাজিলকে। গত পঞ্জিকাবর্ষে সাধারণত পজেশন–ভিত্তিক ফুটবল খেলতে দেখা গিয়েছে ব্রাজিলকে। কিন্তু দরিভালের অধীনে সে ধারা থেকে বেরিয়ে এসেছে ব্রাজিল। বিশেষ করে সমশক্তির দলগুলোর বিপক্ষে খেলার সময় ব্রাজিল বলের দখল রাখার পরিবর্তে দ্রুত আক্রমণে যেতে পছন্দ করে। এ সময় ফরোয়ার্ড লাইনে গতির সঞ্চার করে প্রতিপক্ষ রক্ষণে ত্রাস সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়।
যে কারণে সাম্প্রতিক সময়ে অ্যাটাকিং বিল্ড–আপের সময় ব্রাজিলকে ‘ওয়ান টাচ’ ফুটবলের প্রবণতা দেখা গেছে। এ কৌশলে অব দ্য বল পজিশনও (বল যখন প্রতিপক্ষের পায়ে) বেশ গুরুত্বপূর্ণ। দরিভাল এই কাজটি ভালোভাবে করাতে পারেন মূলত তাঁর হাতে থাকা খেলোয়াড়দের কারণে। ভিনিসিয়ুস জুনিয়র, রদ্রিগো, এনদ্রিক কিংবা লুকাস পাকেতারা এ কৌশলের সঙ্গে দারুণভাবে মানিয়ে যান। এখন মাঠে ঠিকঠাক নিজেদের কাজটুকু করার অপেক্ষা।
শুধু ফরোয়ার্ড লাইনের খেলোয়াড়েরাই নন, এই কৌশলে উইং ব্যাকদের অবস্থানও সমান গুরুত্বপূর্ণ। আক্রমণ তৈরির ক্ষেত্রে উইং ব্যাকরা অনেক সময় ওভারল্যাপ করে ওপরে উঠে আসেন। উইঙ্গাররা কখনো কখনো মাঝমাঠে এসেও মিডফিল্ডের শক্তি বৃদ্ধি করেন। এ ছাড়া ব্রাজিল যখন প্রতি–আক্রমণে উঠবে, তখনো প্রতিপক্ষকে সতর্ক থাকতে হবে। প্রতিপক্ষের ছেড়ে দেওয়া সামান্য ফাঁকা জায়গার সঠিক ব্যবহারে ব্রাজিল আক্রমণভাগে যেকোনো একজন খেলোয়াড়ই যথেষ্ট।
তবে ব্রাজিলের বড় দুশ্চিন্তার কারণ হতে পারে নিজেদের রক্ষণ। দরিভালের অধীনে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচটি ছাড়া বাকি তিন ম্যাচেই গোল হজম করেছে তারা। বেশির ভাগ সময়ই ঠিকঠাক প্রতিক্রিয়া দেখাতে ব্যর্থ হচ্ছেন দলের ডিফেন্ডাররা। বিশেষ করে হাই–প্রেসিংয়ের সময় তাল রাখতে ব্যর্থ হচ্ছেন ডিফেন্ডাররা। এই জায়গাটিতে দ্রুত উন্নতি করতে না পারলে মূল্য দিতে হতে পারে ব্রাজিলকে।
এবারের কোপায় ব্রাজিলকে ভালো কিছু করতে হলে নির্ভর করতে হবে মূলত দলীয় ঐক্যের ওপর। বিশেষ করে নেইমার না থাকায় একক খেলোয়াড়ের ওপর ভরসা করার যে ধারা, সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে ব্রাজিলকে। পাশাপাশি ব্রাজিলের হয়ে নিষ্প্রভ থাকার অভিযোগ থেকেও মুক্ত হয়ে দারুণ কিছু করে দেখাতে হবে ভিনিসিয়ুসকে। এবারের কোপায় দলীয় সমন্বয়ের সঙ্গে ভিনিসিয়ুস কীভাবে মানিয়ে নিচ্ছেন, তার ওপর নির্ভর করছে ব্রাজিলের সাফল্য–ব্যর্থতার অনেকটাই।
সব মিলিয়ে ব্রাজিল হয়তো এখনো নিজেদের সেরা ছন্দে নেই, জোগো বনিতো কিংবা জিঙ্গার ছন্দও এখনো দূরের বাতিঘর। কিন্তু শৈল্পিক সৌন্দর্যের চূড়া স্পর্শের পথে যাত্রার সূচনা বিন্দু হতে পারে এবারের কোপা। যেখান থেকে ব্রাজিলের ফুটবল শুরু করবে ফসল তোলা গানের দিকে যাত্রা।