এলাম, দেখলাম এবং জয় করলাম—অতি ব্যবহারে ক্লিশে হয়ে পড়া এই কথা দিয়েই ব্রাজিলের হয়ে দরিভাল জুনিয়রের অভিষেককে বুঝিয়ে দেওয়া যায়। ব্রাজিলের ফুটবলে ঘোরতর সংকটকালে গত জানুয়ারিতে কোচের দায়িত্ব নেন এই ব্রাজিলিয়ান। জাতীয় দলের দায়িত্ব নেওয়ার আগে ব্রাজিলের বাইরে খুব বেশি পরিচিতি ছিল না দরিভালের। গতকাল ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচটি বর্ষীয়ান এ কোচের জন্যও ছিল নিজেকে চেনানোর। সেই প্রাথমিক পরীক্ষায় তিনি উতরেও গেলেন দারুণভাবে। টানা হারের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে ইংল্যান্ডকে ১-০ গোলে হারিয়েছে ব্রাজিল।
ওয়েম্বলিতে গতকাল ডাগআউটে দাঁড়ানোর আগপর্যন্ত কোনো কিছুই দরিভালের পক্ষে ছিল না। সাও পাওলোর সাবেক এই কোচ দায়িত্ব নেওয়ার আগে ব্রাজিল দল আক্ষরিক অর্থে এলোমেলো অবস্থায় ছিল। কোচ নিয়ে টানাপোড়েন, ফেডারেশনের অভ্যন্তরীণ সংকট, টানা তিন হারে বিশ্বকাপের আঞ্চলিক বাছাইয়ে ছয়ে নেমে যাওয়া এবং একের পর এক চোটে খেলোয়াড়দের ছিটকে যাওয়া—এমন পরিস্থিতিতে আশাবাদী হওয়ার উপাদান ছিল কমই।
তবু চ্যালেঞ্জটা নিয়েছিলেন দরিভাল। যত যা–ই হোক, ব্রাজিল দলের দায়িত্ব নেওয়ার ডাক কজনই আর উপেক্ষা করতে পারেন! দরিভালও পারেননি। সিদ্ধান্তটা যে তিনি ভুল নেননি, প্রথম ম্যাচেই দিলেন সে প্রমাণ। ম্যাচে দারুণ কিছু সুযোগ হাতছাড়া না হলে জয়ের ব্যবধানটা আরও বড় করতে পারত ব্রাজিল ব্যবধান বড় না হলেও এই জয় ব্রাজিলের ফুটবলে স্বস্তি ফেরানোর সঙ্গে অনেকগুলো বার্তা দিয়ে গেল।
দরিভাল এ ম্যাচে শুরুর একাদশেই রাখেন ৫ অভিষিক্ত খেলোয়াড়। পরে নামান আরও দুজনকে। অবশ্য এত খেলোয়াড়কে একসঙ্গে অভিষেক করানোর পেছনে যতটা না কৌশলগত সিদ্ধান্ত, তার চেয়ে বেশি ছিল অসহায়ত্ব একের পর এক খেলোয়াড়ের চোটে ব্রাজিল দলটি যেন ছোটখাটো একটি হাসপাতাল। এমনকি একাদশ সাজাতেই হিমশিম খেতে হচ্ছিল দরিভালকে। ফলে উদীয়মানদের ওপরই নিজের প্রথম ম্যাচে আস্থা রাখতে হয়েছে তাঁকে। দরিভালকে তারা মোটেই নিরাশ করেনি।
প্রথম ম্যাচটি দরিভালের জন্য প্রতিপক্ষের দিক থেকেও ছিল চ্যালেঞ্জিং। গ্যারেথ সাউথগেটের ইংল্যান্ড দলে এই মুহূর্তে বিশ্বের অন্যতম সেরা ৪-৫ জন ফুটবলার খেলছেন এমনকি দলের অধিনায়ক হ্যারি কেইনের অনুপস্থিতিও দলের শক্তিতে খুব বেশি তারতম্য ঘটায়নি। বেলিংহাম-ফোডেন-স্টোনসদের এ দল যেকোনো প্রতিপক্ষকে গুঁড়িয়ে দিতে যথেষ্ট। দুই দলের ছন্দ বিবেচনা নিলেও ম্যাচের আগে ইংল্যান্ডই ছিল ফেবারিট। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে তো ম্যাচের আগেই ব্রাজিল কত গোল হজম করবে, সে হিসাব কষতে বসেছিল কিন্তু পাশার দান বদলে দিয়েছে তারুণ্যে উদ্দীপ্ত ব্রাজিল।
ইংল্যান্ড অবশ্য চেষ্টা করেছিল প্রথম মিনিট থেকে প্রেস করতে। এমন কিছুর আশঙ্কা সম্ভবত আগে থেকেই করছিলেন দরিভাল। শুরুতে তাই চাপ হজম করে ইংল্যান্ডের খেলা নষ্ট করাতেই বেশি মনোযোগী ছিল তাঁর দল। ইংলিশ মিডফিল্ডকে অকার্যকর করতে কড়া মার্কিংয়ের সঙ্গে ফাউলও করেছে বেশ।
বিশেষ করে নিজেদের অ্যাটাকিং থার্ডে বেলিংহামকে থামাতে বারবার ফাউল করেছেন লুকাস পাকেতা। এ জন্য তাঁকে দেখতে হয়েছে হলুদ কার্ডও৷ এমন কৌশলে ইংল্যান্ডের খেলার গতি ব্যাহত করার পাশাপাশি বেলিংহামকেও অনেকটা বোতলবন্দী করে রাখতে সক্ষম হয় পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা।
ম্যাচজুড়ে ব্রাজিলের আঁটসাঁট রক্ষণ-প্রাচীর ভেদ করে খুব কমই সুযোগ তৈরি করতে পেরেছে ইংলিশরা। কয়েকবার কাছাকাছি গেলেও সুবিধা করতে পারেনি তাঁরা। দারুণ সব ট্যাকলের পাশাপাশি প্রতিপক্ষ ফরোয়ার্ডের জন্য শট নেওয়ার জায়গাও বেশ সংকুচিত করে রাখতে পেরেছে ব্রাজিলের ডিফেন্ডাররা। পাশাপাশি কৃতিত্ব দিতে হবে ব্রাজিলের অভিষিক্ত গোলরক্ষক বেন্তোকেও। তিনটি দুর্দান্ত সেইভের পাশাপাশি পোস্টের নিচে তাঁর সতর্ক অবস্থানও দারুণ সহায়তা করেছে ব্রাজিলকে। ২৪ বছর বয়সী এই গোলরক্ষক নিচ থেকে আক্রমণ তৈরিতেও দারুণ ভূমিকা রেখেছেন।
এই ম্যাচে ব্রাজিলের চিরায়ত সৌন্দর্য ‘জোগো বনিতো’র দেখা মেলেনি। নতুন কোচের কাছ থেকে শুরুতেই এমন প্রত্যাশা বাড়াবাড়িও। তবে এই দলকে নিয়ে বহু দূর যাওয়া যে সম্ভব, সে ইঙ্গিত ঠিকই দিয়েছেন দরিভাল। রক্ষণ সামলে ব্রাজিল যখনই আক্রমণে উঠছিল মাঝমাঠের সমন্বয় ছিল চোখে পড়ার মতো। বিশেষ করে পাকেতা-রদ্রিগো-ভিনিসিয়ুস ছিলেন দারুণ গতিময়।
আক্রমণে ওঠার সময় একে অপরের সঙ্গে ওয়ান টাচের পাসগুলোও ছিল দারুণ। বল পায়ে তো বটেই, অফ দ্য বল পজিশনেও বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন ব্রাজিলের আক্রমণভাগের খেলোয়াড়েরা। তবে এটাও ঠিক যে বল পায়ে রাখতে গিয়ে বেশ বেগ পেতে হয়েছে ব্রাজিলকে। ইংলিশ খেলোয়াড়দের প্রেসিংয়ে অনেক সময় খেই হারাতেও দেখা গেছে। কিন্তু এরপরও দমে যায়নি তারুণ্যদীপ্ত দলটি। নিজেদের সুযোগের জন্য অপেক্ষায় ছিল তারা।
তবে যখনই প্রতিপক্ষের অ্যাটাকিং থার্ডের কাছাকাছি যেতে পেরেছে, তাৎক্ষণিকভাবে শট নিয়ে পরীক্ষা নিয়েছে ইংলিশ রক্ষণের। আক্রমণের এ ধারাতেই গোল করার বেশ কিছু সুবর্ণ সুযোগ এসেছিল ব্রাজিলের সামনে। কিন্তু ফিনিশিং ঘাটতির কারণে সুযোগগুলোকে গোলে রূপান্তরিত করতে পারেননি ভিনি-রদ্রিগোরা। তবে একাধিক সুযোগ হাতছাড়া করার পরও শেষ পর্যন্ত হতাশা নিয়ে মাঠ ছাড়তে হয়নি ব্রাজিলকে। ১৭ বছর বয়সী এনদ্রিকের ইতিহাস গড়া গোলে দারুণ এক জয় ঠিকই আদায় করে নিয়েছে তারা।
২০২২ সালে কাতার বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায় পর থেকে দুঃসময়ের ঘেরাটোপে পড়েছিল ব্রাজিলের ফুটবল। এরপর গতকালের আগপর্যন্ত নানা দুর্গতি দেখেছে ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সফল দেশটি। তবে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে জয় দিয়ে নতুন যাত্রার ইঙ্গিত দিলেন দরিভাল। এখন এই সাফল্যকে ভিনি-রদ্রিগোরা ধারাবাহিক করতে পারেন কি না, সেটাই দেখার অপেক্ষা।