ম্যান সিটি কোচ পেপ গার্দিওলা
ম্যান সিটি কোচ পেপ গার্দিওলা

গার্দিওলার ‘পুতুল নাচ’ ও সিটির শেষ ধাপ পেরোনোর অপেক্ষা

গত মৌসুমের চ্যাম্পিয়নস লিগ সেমিফাইনালের কথা নিশ্চয় এখনো ম্যানচেস্টার সিটির সমর্থকদের মন থেকে মুছে যায়নি। সান্তিয়াগো বার্নব্যুর দ্বিতীয় লেগে ৮৯ মিনিট পর ৫-৩ গোল এগিয়ে থেকেও সেদিন শেষ মুহূর্তে তিন গোল খেয়ে ছিটকে গিয়েছিল সিটি। চোখে মুখে অবিশ্বাস নিয়ে শিষ্যদের সান্ত্বনা দিলেও, পেপ গার্দিওলা নিজেই যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না! যা ঘটল তা কি আসলেই ঘটার কথা ছিল! দুই ম্যাচ মিলিয়ে অনেকের চোখে সেরা দল ছিল সিটিই, কিন্তু মঞ্চটা যখন চ্যাম্পিয়নস লিগের রিয়ালের শ্রেষ্ঠত্বই যেন শেষ কথা।

আজ রাতেও শুরুর দিকে সিটি যখন রিয়ালকে কোণঠাসা করে একের পর এক আক্রমণ করে যাচ্ছিল, তখনও মনে হয়নি এই ম্যাচ গার্দিওলার দল খুব অনায়াসে জিততে পারে। ধারাভাষ্যকার তো বলেই দিলেন, চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতার জন্য রিয়ালকে ভালো খেলতে হয় না। তারা বিশেষ কিছু না করেও জিতে যেতে পারে। এমনকি প্রথমার্ধে ২-০ গোলে পিছিয়ে থাকার পরও ‘ক্যামব্যাকের’ স্বপ্ন দেখছিল অনেক রিয়াল সমর্থক।

রিয়ালের সঙ্গে ইউরোপ শ্রেষ্ঠত্বের মঞ্চের সঙ্গে সম্পর্কটা বেশ নিবিড় বলে ভয় ছিল সিটি সমর্থকদের মনেও। এর আগে সেমিফাইনালের লাইনআপ নিশ্চিত হওয়ার পর গার্দিওলা তো বলেই দিয়েছিলেন, চ্যাম্পিয়নস লিগ জিততে হলে রিয়ালকে হারাতেই হবে। সিটি এখনো চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতেনি ঠিকই, কিন্তু চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতার সবচেয়ে বড় শর্তটা ঠিকই ‍পূরণ করেছে। তারা যে রিয়ালকে হারিয়ছে। সিটি অবশ্য সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর দলটিকে শুধু হারায়নি, রীতিমতো উড়িয়েও দিয়েছে। যা সত্যি করেছে ওয়েইন রুনির বিখ্যাত ভবিষ্যৎ বাণীকেও।

তবে রিয়ালকে যতটা অনায়সে হারিয়েছে, এর প্রস্তুতিটা নিশ্চয় অতটা সহজ ছিল না। ম্যাচ জেতার জন্য যা পরিশ্রম করার দরকার ছিল, গার্দিওলা তা মাঠে এসে করার পরিবর্তে মাঠের বাইরেই সেরে নিয়েছেন। ম্যাচজুড়ে খেলোয়াড়েরা শুধু কোচের ঠিক করে দেওয়া পরিকল্পনাটুকু বাস্তবায়ন করেছেন।

কৌশলে আনচেলত্তিকে পাত্তা দেননি গার্দিওলা

এদিন পুরো মাঠটাকে গার্দিওলা যেন পুতুল নাচের মঞ্চ বানিয়ে ফেলেছিলেন। যেখানে অদৃশ্য সুতোটুকু ছিল গার্দিওলার আঙুলের ডগায়। ইশারায় যাকে যেভাবে নাচানোর দরকার ছিল তাঁকে সেভাবেই নাচিয়েছেন। যার যতটুকু নড়ানো দরকার ততটুকুই নড়িয়েছেন। ম্যাচ শেষে গার্দিওলাকে নিয়ে জ্যাক গ্রিলিশের সহজ স্বীকারোক্তি, ‘যে কোচটি এখানে আছেন তিনি একজন জিনিয়াস।’

গার্দিওলার এই ‘জিনিয়াস’ মস্তিষ্ক বোঝার জন্য ম্যাচের একটি মুহূর্তের দিকে তাকানো যাক। ৩১ মিনিটে সেটি ছিল প্রথমার্ধে রিয়ালের প্রথম আক্রমণ। বাঁ প্রান্ত নিয়ে ভিনিসিয়ুস জুনিয়র বল নিয়ে প্রতিপক্ষ ডি-বক্সে ঢুকেছিলেন বটে। কিন্তু পুরোটা সময় তাঁর সঙ্গে মেশিনের মতো খেলে বলটা কেড়ে নেন কাইল ওয়াকার। দেখলে মনে হবে, সবটাই যেন ছক কষে করা। কোথাও কোনো ছন্দপতন নেই।

ভিনি যে এভাবে ছুটবেন তা যেমন আগে জানা ছিল, তেমন জানা ছিল তাঁকে ওয়াকারের নজরবন্দি করে রাখাও। এই ম্যাচে পুরো নাটকে গার্দিওলার তৈরি করা পুতুল নাচের চিত্রনাট্যের বিপক্ষে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন শুধু থিবো কোর্তোয়া। বেলজিয়ান গোলরক্ষক রুখে না দাঁড়ালে রিয়ালের অবস্থা আরও দুর্বিষহ হতে পারত।

এদিকে রিয়ালের বিপক্ষে দুর্দান্ত এ জয়ে গার্দিওলা ব্যক্তিগত পরিসংখ্যানের খাতাটাও ভারি করে নিলেন। চতুর্থবারের মতো চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে যে পৌছে গেছেন। দুইবার গেছেন বার্সেলোনার হয়ে, দুইবার ম্যান সিটির হয়ে। কোচ হিসেবে তাঁর চেয়ে বেশি ফাইনালের ডাগআউটে দাঁড়িয়েছেন যাঁকে আজ রাতে বিদায় করেছেন সেই আনচেলত্তি (৫বার)। পাশাপাশি রিয়ালকে তিনবার চ্যাম্পিয়নস লিগের মঞ্চ থেকে বিদায় করা কোচও এখন এই গার্দিওলা।

গার্দিওলার উল্লাস

গার্দিওলার এমন পুতুল নাচের ভেলকি অবশ্য এবারই প্রথম নয়। সিটি কোচ পুরো মৌসুমজুড়ে তা করে দেখিয়েছেন, যা তাদের ট্রেবল জয়ের পথেও দারুণ এগিয়ে রেখেছে। এরপরও বাস্তবতা হচ্ছে ঘরের মাঠে গার্দিওলার সিটি যেন আরও একটু বেশিই অপ্রতিরোধ্য। গ্রিলিশ যেমনটা বলছিলেন, ‘আমার মনে হয়  না খুব বেশি দল রিয়াল মাদ্রিদের সঙ্গে এমনটা করতে পারবে। কিন্তু যখন আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে খেলেছি (করতে পেরেছি)। বিশেষ করে এখানে খেললে নিজেদেরকে অপ্রতিরোধ্য বলেই মনে হয়।’

ঘরের মাঠে খেলার কারণেই কি না, ট্যাকটিকসের দিক থেকেও গার্দিওলার সিটিকে আজ যেন একটু বেশিই অপ্রতিরোধ্য দেখাল। সিটি এমনিতেই বল পায়ে রেখে খেলতে পছন্দ করে। আজও তার ব্যতিক্রম ছিল না। কিন্তু ম্যাচের প্রথম ৩০ মিনিটের দিকে তাকালে বোঝা যাবে সিটির পারফরম্যান্স আসলে কতটা সর্বগ্রাসী ছিল। এ সময় সিটির দখলে বল ছিল ৮০ শতাংশ। রিয়াল নামমাত্রই মাঠে ছিল। আক্রমণ দূরে থাক, বল স্পর্শ করার জন্যও মাথাখুটে মরছিলেন বেনজেমা-ভিনিসিয়ুসরা।

এ ম্যাচে সিটির একচ্ছত্র আধিপত্যের মাঝে রিয়ালের প্রতিটি খেলোয়াড় যেন বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। তারা না পারছিলেন বলের দখল নিতে, না পারছিলেন প্রেসিং করে সিটির আক্রমণের ধারাকে ভেঙে দিতে। শুরুর এই আধাঘণ্টাতেই মূলত ম্যাচের ভাগ্য লিখে দেন গার্দিওলা। ম্যাচের শেষ পর্যন্ত যার এতটুকু নড়চড় হয়নি। যার ফলস্বরূপ শেষ পর্যন্ত চ্যাম্পিয়নস লিগের অমিত শক্তিধর রিয়ালও গার্দিওলার জাদুতে বশ মেনেছে। এখন সিটির শুধু ইন্টারের বাধা পেরোনোর অপেক্ষা। সেটি করতে পারলে বহু আরাধ্যের চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপাটাও আরেকবার ছুঁতে পারবেন গার্দিওলা। যা সিটির হয়ে এই স্প্যানিশ কোচের শিরোপার বৃত্তও পূরণ করবে।