আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল মুখোমুখি হলে মেসি–নেইমারের লড়াইও দেখা যাবে
আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল মুখোমুখি হলে মেসি–নেইমারের লড়াইও দেখা যাবে

কাতার থেকে উৎপল শুভ্র

স্বপ্নের সেই ম্যাচের অপেক্ষায় বিশ্বকাপ

হবে তো শেষ পর্যন্ত? নাকি বাগড়া দিয়ে বসবে নেদারল্যান্ডস বা ক্রোয়েশিয়া! ‘বা’ বলছি কেন, দুই দলই তো বাদ সাধতে পারে স্বপ্নের সেই সেমিফাইনালের পথে। যে ম্যাচের জন্য সম্ভবত এই দুই দল ছাড়া বাকি বিশ্বই অধীর অপেক্ষায়। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা!

টানা ১৭ দিন ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ানোর পর যেন একটু দম নিতে থমকে দাঁড়িয়েছে বিশ্বকাপ। মাত্র দুই দিনের জন্যই। আবার যখন তা ছুটতে শুরু করবে, তখন সেমিফাইনালে ওঠার লড়াই। নাটকীয় গ্রুপ পর্বের পর নিষ্ঠুর নকআউটের প্রথম ধাপ পেরিয়ে বিশ্বকাপ এখন আট দলের টুর্নামেন্ট। সেই আট দলের কোয়ার্টার ফাইনাল লাইনআপ সব আয়োজন সম্পন্ন করে রেখেছে স্বপ্নের সেই ম্যাচের। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা!

অপেক্ষাটা অনেক দিনের। নির্দিষ্ট করে বললে ৩২ বছর। আট বছর আগেই যা শেষ হওয়ার সম্ভাবনা জেগেছিল। হয়নি বেলো হরিজন্তের সেই ভুতুড়ে রাতের কারণে। আর্জেন্টিনা ঠিকই ফাইনালে উঠেছিল, কিন্তু ব্রাজিলের বিশ্বকাপে ব্রাজিলই পারেনি। সেমিফাইনালে জার্মানির কাছে ৭-১ গোলে পরাজয়ের সেই ‌‘মিনেরেইজো’র কারণে। মাঝখানে একটা বিশ্বকাপের পরই আবারও সেই রোমাঞ্চের হাতছানি। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা!

কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেছে নেইমারের ব্রাজিল

এই বিশ্বকাপ গ্রুপ পর্বেই যত অঘটনের সাক্ষী, তা আগের সব কটি বিশ্বকাপ মিলিয়ে যত অঘটন, তাকে প্রায় ছুঁয়ে ফেলতে চায়। যেটির ধারা ক্ষীণতর হলেও দ্বিতীয় রাউন্ডেও বহমান থেকেছে। জাপান বিদায় নিলেও চমকের পতাকাটা উড়িয়ে চলেছে মরক্কো। দ্বিতীয় রাউন্ডেই শেষ দিনের দুটি ম্যাচ ঘিরেই বিশ্বকাপে তুমুল আলোড়ন। দুটি দুই কারণে। প্রথমটিতে স্পেনের বিপক্ষে মরক্কোর জয়, দ্বিতীয়টিতে পর্তুগালের প্রথম একাদশ থেকে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর বাদ পড়ার যুগান্তকারী ঘটনা। চমকের স্কেলে কোনটা এগিয়ে থাকবে, তা আপনার বিবেচনা।

আরব বিশ্বে প্রথম বিশ্বকাপ। সেই বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো কোয়ার্টার ফাইনালে আরবের কোনো দেশ। মরক্কোর গল্পটা আসলেই খুব রোমান্টিক। তা আরও চমকপ্রদ হয়ে যাচ্ছে বিশ্বকাপ-পূর্ব ঘটনাপ্রবাহের কারণে। মাস তিনেক আগে দায়িত্ব নিয়েছেন নতুন কোচ। বিশ্বকাপে মরক্কোর প্রথম ম্যাচের দিন হোটেলের লিফটে এক দল মরোক্কানের সঙ্গে সেই কথোপকথন মনে পড়ছে। গ্রুপ পর্বের তিনটা ম্যাচ দেখতে এসেছেন। মরক্কোর বিশ্বকাপ যে ওখানেই শেষ, তা নিয়ে কোনো সংশয়ই নেই তাঁদের মনে। বেলজিয়াম আর ক্রোয়েশিয়ার গ্রুপ থেকে দ্বিতীয় রাউন্ডে ওঠার স্বপ্ন কীভাবে দেখবেন! যেখানে আবার দলের অবস্থা রীতিমতো এলোমেলো। মরক্কোই এখন কোয়ার্টার ফাইনালে। যারা এখনো বিশ্বকাপে অপরাজিত এবং যাদের জালে প্রতিপক্ষের কোনো খেলোয়াড় এখনো বল পাঠাতে পারেননি। কানাডার বিপক্ষে শেষ গ্রুপ ম্যাচে মরক্কোর জালে যে একটি গোল হয়েছে, সেটি তো আত্মঘাতী।

কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেছে আর্জেন্টিনা। সামনে এখন সেমিতে ওঠার লড়াই

মরক্কোর চমক এখানেই শেষ, নাকি আরব্য রজনীর গল্প আরও বাকি, কে জানে! এটা অবশ্য পর্তুগালের মাথাব্যথা। রোনালদোকে ছাড়া আরও দুর্দান্তরূপে দেখা দেওয়া ফার্নান্দো সান্তোসের দলের কোয়ার্টার ফাইনাল এই মরক্কোর সঙ্গে। ড্রয়ের এই পাশে আরেকটি কোয়ার্টার ফাইনাল লাইনআপ তো আগেই চূড়ান্ত হয়ে গেছে। বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স বনাম ইউরো রানার্সআপ ইংল্যান্ড। সম্ভাব্য সেমিফাইনাল কি তাহলে ফ্রান্স বনাম পর্তুগাল? এই প্রশ্ন নিয়ে ওই চার দেশ আলোড়িত থাকতে পারে, ফুটবল–বিশ্ব ততটা নয়। সেখানে সব আলোচনা আরেকটি সেমিফাইনাল নিয়ে। স্বপ্নের সেই ম্যাচটা হবে তো শেষ পর্যন্ত? ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা!

৩২ বছরে যা হয়নি। বিশ্বকাপে দুই দলের দেখা হয়েছে চারবার। সর্বশেষ সেই ১৯৯০ বিশ্বকাপে। ব্রাজিলকে উত্ত্যক্ত করতে বানানো আর্জেন্টাইনদের গানে যে ম্যাচ ফিরে ফিরে আসে। পুরো ম্যাচে রাজত্ব করা ব্রাজিল হেরে গিয়েছিল ডিয়েগো ম্যারাডোনার এক মুহূর্তের জাদুতে। ক্যানিজিয়ার ফিনিশিংটাও দারুণ ছিল, তবে ম্যারাডোনার ওই পাসটাই তো খুলে দিয়েছিল ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা দ্বৈরথে ক্যানিজিয়ার অমরত্বের পথ। অমরত্বই তো! নইলে কি আর আর্জেন্টাইনরা এখনো তা নিয়ে গান গায়। যে গানে দাবি করে, ব্রাজিল এখনো ওই শোকে কেঁদে চলেছে!

১৯৭৪ থেকে ১৯৯০—এই পাঁচ বিশ্বকাপের মধ্যে যে চারবার দেখা হয়েছে দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর, তার কোনোটাই সেমিফাইনাল ছিল না। এই দুই দল একই বিশ্বকাপের সেমিফাইনালেই তো উঠেছে মাত্র একবার। সেটি ২০১৪ বিশ্বকাপে, যখন এবারের মতোই স্বপ্নের এক ম্যাচের সম্ভাবনা জেগেছিল। সেবার তা হতে দেয়নি জার্মানি। এবার বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে ক্রোয়েশিয়া ও নেদারল্যান্ডস। এই বাধা পেরোতে পারলেই স্বপ্নের সেই ম্যাচ। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা!

সর্বশেষ ১৯৯০ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার মুখোমুখি হয়েছিল ব্রাজিল

আর্জেন্টিনার বাধাটাই কি বেশি কঠিন? ক্রোয়েশিয়া গত বিশ্বকাপের রানার্সআপ হতে পারে, ফুটবলীয় ঐতিহ্যে ডাচরা অনেক অনেক এগিয়ে। ঐতিহ্য-টৈতিহ্যকে যদি পাত্তা দিতে না-ও চান, রেকর্ডকে তো দিতেই হয়। সেই রেকর্ড ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে ব্রাজিলকে যেমন অনেকটা এগিয়ে রাখে, আর্জেন্টিনার বিপক্ষে রাখে নেদারল্যান্ডসকে। এর আগে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে বিশ্বকাপে খেলা দুটি ম্যাচেই জিতেছে ব্রাজিল। সর্বশেষ ২০১৪ বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচে। ৩-১ গোলের যে জয়ে জোড়া গোল ছিল নেইমারের।

আর্জেন্টিনা-নেদারল্যান্ডস ৯টি ম্যাচে আর্জেন্টিনা জিতেছে মাত্র একটিতে। ১৯৭৮ সালে বুয়েনস এইরেসে যে জয় প্রথম বিশ্বকাপ এনে দিয়েছিল তাদের। শুধু বিশ্বকাপ ধরলে দুই দলের ম্যাচ হয়েছে আরও ৪টি। ২টি জিতেছে নেদারল্যান্ডস, বাকি দুটি ড্র।

আর্জেন্টিনা অবশ্য এসব ভুলে বিশ্বকাপে দুই দলের সর্বশেষ ম্যাচটাই মনে রাখতে চাইবে। ২০১৪ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে টাইব্রেকারে নেদারল্যান্ডসকে হারিয়েই তাদের ফাইনালে ওঠা। টাইব্রেকারে জয় রেকর্ড বইয়ে ড্র হিসেবে লেখা থাকে বলে এটি জয়ের স্বীকৃতি পায় না। তাতে কি, আবার ওভাবে জিততেও কি আর আপত্তি করবে আর্জেন্টিনা!