বেলিংহামের গোলেই ইউরোতে টিকে আছে ইংল্যান্ড
বেলিংহামের গোলেই ইউরোতে টিকে আছে ইংল্যান্ড

ইংল্যান্ডের সাউথগেট–যুগ বাঁচিয়েছেন ‘হেই জুড’ বেলিংহাম

টিক টিক টিক—পরশু রাতে গেলসেনকির্চেনের আউফশালকে স্টেডিয়ামে ডাগআউটে দাঁড়ানো গ্যারেথ সাউথগেটের হৃৎস্পন্দন বোধ হয় এভাবেই ঘড়ির কাঁটার শব্দের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। ইংল্যান্ড–স্লোভাকিয়া ম্যাচে যোগ করা সময়ে যে চলছিল সাউথগেটের বিদায়ের ক্ষণগণনাও! রেফারির শেষ বাঁশি শুধু ইংল্যান্ডের বিদায় নিশ্চিত করবে না, একই সঙ্গে যে শেষ হবে সাউথগেটের ইংল্যান্ড–অধ্যায়ও!

এমন পরিস্থিতিতে সব প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে পারতেন একজন। ইংলিশ হয়েও যিনি ঠিক ইংলিশ নন। রিয়াল মাদ্রিদের হারার আগে হার না মানা ফুটবলের যে চেতনা, সেটি যে এখন তাঁর রক্তেও! ‘থ্রি লায়নস’ জার্সিতে সেই চেতনাতেই শেষ পর্যন্ত উদ্ভাসিত হলেন জুড বেলিংহাম। স্লোভাকিয়ার চীনের প্রাচীর হয়ে ওঠা রক্ষণ–দেয়াল ভাঙতে যখন অলৌকিক কিছুর দিকে তাকিয়ে ইংলিশরা, তখন সেই অলৌকিকতা নিয়ে হাজির হলেন ‘হেই জুড’খ্যাত বেলিংহাম। তাঁর গোলে ম্যাচে ফেরার পর হ্যারি কেইনের গোলে জয় নিয়ে মাঠ ছেড়েছে ইংল্যান্ড। তবে মূল কৃতিত্বটা বেলিংহামেরই।

অবিশ্বাস্য এক ওভারহেড কিকে স্লোভাকদের দাঁতে দাঁত চেপে সামলে যাওয়া রক্ষণ–প্রাচীর এক মুহূর্তে গুঁড়িয়ে দেন এই মিডফিল্ডার। বেলিংহামের সেই মাটিঘেঁষা ওভারহেক কিক ইংল্যান্ডকে ইউরো স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখার সঙ্গে টিকিয়ে দিয়েছে সাউথগেটের চাকরিও।

ইউরো শুরুর আগে সাউথগেট নিজেই বলেছিলেন, ট্রফি জিততে না পারলে ইংল্যান্ডের কোচ হয়ে থাকার আর কোনো সুযোগ তাঁর নেই। ২০১৬ সালে দায়িত্ব নেওয়ার পর চারটি বড় টুর্নামেন্টে  ইংল্যান্ডের ডাগআউটে দাঁড়িয়েছেন সাউথগেট। যেখানে একবার বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল এবং অন্যবার ইউরোর ফাইনালেও দলকে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু কাছে গিয়েও শেষ পর্যন্ত জেতা হয়নি শিরোপা। পরশু রাতেই সেই বেদনা চিরন্তন হয়ে যেতে পারত সাউথগেটের জন্য। কিন্তু বেলিংহামের একটি জাদুকরি মুহূর্ত অন্তত আরও এক ম্যাচের জন্য দীর্ঘায়িত করেছে সাউথগেটের শিরোপা–স্বপ্নকে।

ম্যাচ শেষে বেলিংহামকে জড়িয়ে ধরেছেন সাউথগেট

কোচ হিসেবে সাউথগেটের ওপর ইংলিশ ফুটবলের সমর্থক এবং পণ্ডিতরা কখনোই আস্থা রাখতে পারেননি। তাঁর কৌশলগত অবস্থানও বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। চলমান ইউরোও এর ব্যতিক্রম নয়। এই মুহূর্তে বিশ্বের অন্যতম সেরা মিডফিল্ড ও আক্রমণভাগ নিয়েও উদ্দেশ্যহীন ও এলেমেলো ফুটবল খেলে যাচ্ছে ইংল্যান্ড। সেরা একাদশ কেমন হবে, কিংবা দলের সেরা ফরমেশন কী, সেটাই যেন এখনো খুঁজে পাননি এই ইংলিশ কোচ। এমন পারফরম্যান্সের কারণে খেপেছেন সমর্থকেরাও।

যে দলে লা লিগার সেরা খেলোয়াড় বেলিংহাম, প্রিমিয়ার লিগের সেরা খেলোয়াড় ফিল ফোডেন এবং বুন্দেসলিগার সর্বোচ্চ গোলদাতা হ্যারি কেইন আছেন; সেই দলের হতশ্রী পারফরম্যান্সে হতভম্ভ ফুটবল বিশ্লেষকরাও। অবিশ্বাস্য সব প্রতিভায় ভরপুর দলটির দায়িত্ব পালনের যোগ্যতা সাউথগেটের আছে কি না, সেই প্রশ্নও তুলেছেন অনেকে। এই মুহূর্তে সব প্রশ্ন, সন্দেহ ও সমালোচনার একটা জবাবই আছে সাউথগেটের সামনে। সেটি হচ্ছে ট্রফি জয়।

একমাত্র ট্রফি জিতেই সাউথগেট পারবেন নিজের দায়মুক্তি ঘটাতে। টেলিগ্রাফের এক প্রতিবেদনে সাবেক ইংলিশ তারকা জেমি ক্যারাঘার যেমনটা বলছিলেন, ‘বড় টুর্নামেন্টে একটি দেশের পারফরম্যান্সকে তারা কীভাবে টুনার্মেন্ট শুরু করেছে, তা দিয়ে মনে রাখা হয় না, এটি মনে রাখা হয় তারা কীভাবে শেষ করেছে, সেটা দিয়ে। জুড বেলিংহাম শুধু সাউথগেটের যুগকেই বাঁচিয়ে দেয়নি, ইতিহাসে তাকে কীভাবে মনে রাখা হবে, সেটিও প্রায় ঠিক করে দিয়েছে।’

অথচ বেলিংহামের যে গোলে সাউথগেট হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছেন, সেটিতে কোচের ভূমিকা সামান্য। যোগ করা সময়ের সেই গোলটি ছিল শুধুই একজন প্রতিভাবান ফুটবলারের নিজেকে প্রকাশ করার মুহূর্ত। বেলিংহামের ব্যক্তিগত নৈপুণ্য শেষ পর্যন্ত ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে সাউথগেটের জন্যও। কিন্তু দ্রুত নিজের ভুলগুলো শুধরে না নিলে ইংল্যান্ড কোচের এই দায়মুক্তি সাময়িক ঘটনা হয়েও থাকতে পারে। প্রতিদিন তাঁর চাকরি বাঁচানোর জন্য তো আর নিশ্চয় বেলিংহাম এগিয়ে আসবেন না!

দলকে দিক নির্দেশনা দিচ্ছেন সাউথগেট

সাউথগেটের জন্য সুখবর হচ্ছে, ফাইনাল পর্যন্ত অপেক্ষাকৃত সহজ রাস্তায় পাচ্ছেন তিনি। শেষ আটে ইংল্যান্ডের প্রতিপক্ষ সুইজারল্যান্ড। সুইসরা এবারের ইউরোতে অসাধারণ ফুটবল খেলছে। গ্রুপ পর্বে জার্মানিকে রুখে দেওয়ার পর শেষ ষোলোয় বিদায় করেছে বর্তমান চ্যাম্পিয়ন ইতালিকে। এরপরও দুই দলের শক্তি–সামর্থ্য ও পরিসংখ্যানের নিরিখে ফেবারিট হিসেবেই মাঠে নামবে ইংল্যান্ড।

এরপর সেমিফাইনালে গেলে সেখানেও জার্মানি, স্পেন, পর্তুগাল কিংবা ফ্রান্সের মতো দলের বিপক্ষে খেলতে হবে না তাদের। ফলে ইংল্যান্ডকে ফাইনালে নেওয়ার জন্য বড় পরীক্ষায় পড়তে হবে না সাউথগেটকে। তবে অস্ট্রিয়া, নেদারল্যান্ডস কিংবা সুইজারল্যান্ডের মতো দলও যে ইংল্যান্ডকে নাকানি খাওয়াতে পারে, সে প্রমাণ তো স্লোভাকিয়া, স্লোভেনিয়া ও ডেনমার্কের মতো দলগুলো দিয়েছে।

সাউথগেটকে তাই সবার আগে নিজ দলের শক্তিকে কাজে লাগানোর পথ খুঁজতে বের করতে হবে। বেলিংহাম–কেইন–ফোডেনদের নামে যেখানে প্রতিপক্ষদের থরথর কাঁপার কথা, সেখানে ‘পুঁচকে’ দলগুলোই ‘থ্রি লায়ন্স’দের নিয়ে রীতিমতো ছেলেখেলায় মেতেছে। এ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে সবার আগে সাহসী হতে হবে সাউথগেটকেই। পাশাপাশি খেলোয়াড়দের মধ্যেও এই আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে হবে যে তাঁরা একাই যেকোনো দলকে গুঁড়িয়ে দিতে পারে। আর পরের কাজটা কীভাবে করতে হয়, তা বেলিংহাম–ফোডেনদের চেয়ে ভালো আর কে জানেন!