ভিনিসিয়ুসের ব্যালন ডি’অর না পাওয়া নিয়ে চলছে তুমুল আলোচনা–সমালোচনা
ভিনিসিয়ুসের ব্যালন ডি’অর না পাওয়া নিয়ে চলছে তুমুল আলোচনা–সমালোচনা

ভিনিসিয়ুস কেন ব্যালন ডি’অর জিততে পারলেন না

মঞ্চ প্রস্তুত ছিল। প্রায় এক মাস আগে থেকে গুঞ্জনটাও ছড়িয়ে পড়েছিল। ভিনিসিয়ুস জুনিয়রই জিততে যাচ্ছেন ব্যালন ডি’অর, কথাটা বেদবাক্যের মতো খোদাইও করে দিয়েছিল মার্কাসহ একাধিক ইউরোপিয়ান সংবাদমাধ্যম। রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে লা লিগা ও চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতার কারণেই মূলত এই স্বীকৃতি। সময় যত ঘনিয়ে আসছিল, ব্রাজিল ও রিয়ালের সমর্থকদের উত্তেজনা ততই বাড়ছিল। ১৭ বছর পর কোনো ব্রাজিলিয়ান এই পুরস্কার জিততে যাচ্ছেন, তাই উত্তাপটা একটু বেশি থাকাই তো স্বাভাবিক ছিল।

কিন্তু পুরস্কার দেওয়ার দিন অর্থাৎ গতকাল বিকেলের পর থেকে ধীরে ধীরে বাতাসের গতি পাল্টাতে শুরু করে। সন্ধ্যা পেরোতেই যেন ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়ল মাদ্রিদের উপকূলে। একের পর এক ব্রেকিং নিউজ, ভিনিসিয়ুস নন, ব্যালন ডি’অর জিততে যাচ্ছেন ম্যানচেস্টার সিটির স্প্যানিশ ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার রদ্রি। এ খবর গোটা মাদ্রিদকে ঢেকে দিয়েছিল হতাশার চাদরে।

তাৎক্ষণিকভাবে উৎসবের সব আয়োজন থামিয়ে প্যারিসে যাওয়ার পরিকল্পনাও মাঞ্জানারেস নদীর স্রোতে ভাসিয়ে দেন রিয়াল সভাপতি ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ। সারা রাত ধরে চলতে থাকে আলোচনা–সমালোচনা। সমর্থকেরা তো বটেই, সাবেক–বর্তমান খেলোয়াড়েরাও অংশ নেন এ বিতর্কে।

অনেকেই সরাসরি আঙুল তোলেন আয়োজকদের দিকে। প্রশ্ন হচ্ছে, সব আয়োজন শেষে কেন ভেস্তে গেল ভিনির কাঙ্ক্ষিত ব্যালন ডি’অর? ষড়যন্ত্রতত্ত্বকে এক পাশে সরিয়ে রেখেই দেখা যেতে পারে যৌক্তিক কারণগুলো।

ভিনির চেয়ে রদ্রির এগিয়ে থাকার প্রসঙ্গে শুরুতেই আসবে জাতীয় দলের পারফরম্যান্স। বলা হয়, ‘ভিনিসিয়ুস সাদায় “জেকিল”, হলুদে “হাইড”।’ অর্থাৎ ভিনি রিয়ালের হয়ে যতটা সফল, ব্রাজিলের জার্সিতে তার ধারেকাছেও ঘেঁষতে পারেন না। এ কথার সাক্ষ্য অবশ্য পরিসংখ্যানও দেয়। ২০১৯ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ব্রাজিলের জার্সিতে অভিষেকের পর থেকে ৩৫ ম্যাচে মাত্র ৫ গোল করেছেন ভিনি, সঙ্গে ৫টি অ্যাসিস্ট।

এবার ব্যালন ডি’অর জয়ে ভিনিসিয়ুসকে পেছনে ফেলেছেন রদ্রি

অন্যদিকে রিয়ালের হয়ে ২৭৯ ম্যাচে ৯২ গোলের পাশাপাশি সহায়তা আছে আরও ৬৪ গোলে। অর্থাৎ ব্রাজিলের জার্সিতে নিজের ছায়া হয়েই থাকেন ভিনি। আর গত মৌসুমের কথা বিবেচনা করলেও কথাটা একই রকম সত্য। বিশেষ করে কোপা আমেরিকায় ব্রাজিলের হয়ে ভিনির ব্যর্থতার বিপরীতে ইউরোতে রদ্রির সাফল্যই বড় পার্থক্য গড়ে দিয়েছে।

এমনকি রদ্রি স্পেনের হয়ে শুধু ইউরোই জেতেননি, তিনি প্রতিযোগিতার সেরা খেলোয়াড়ও নির্বাচিত হয়েছেন। অন্যদিকে নেইমারের অবর্তমানে কোপায় ভিনিসিয়ুসের ওপর যে দায়িত্ব অর্পিত হয়েছিল, তা পালন করতেও তিনি ব্যর্থ। জাতীয় দলের জার্সিতে ভিনির এমন হতশ্রী পারফরম্যান্স পুরস্কারেও বড় প্রভাব ফেলেছে।

ভিনিসিয়ুসের না পাওয়ার ক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণের কথা বলেছেন ব্যালন ডি’অরের আয়োজক সাময়িকী ‘ফ্রান্স ফুটবল’–এর প্রধান সম্পাদক ভিনসেন্ট গার্সিয়া। তাঁর মতে, সেরা পাঁচে থাকা ভিনির অন্য দুই রিয়াল সতীর্থ জুড বেলিংহাম ও দানি কারভাহালের উপস্থিতিও ফলকে প্রভাবিত করেছে। গার্সিয়া বলেছেন, ‘গাণিতিকভাবে তারা ভিনির কাছ থেকে কিছু পয়েন্ট ছিনিয়ে নিয়েছে।’ অর্থাৎ বিচারকেরা তাদের তিন–চারজন খেলোয়াড়ের মধ্যে নিজেদের ভোট ভাগাভাগি করে দিয়েছেন। যা ভিনির জয়ে বাধা তৈরি করেছে।

ভিনিসিয়ুস বর্তমানে ফুটবলে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের পোস্টারবয়। শুধু নিজের সঙ্গে হওয়া বর্ণবাদী আচরণেরই নয়, যেকোনো বর্ণবাদী আক্রমণের বিরুদ্ধে সক্রিয় দেখা যায় তাঁকে। এ পথে ভিনিসিয়ুস অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী যেমন পেয়েছেন, তেমনি প্রচুর শত্রুও তৈরি হয়েছে তাঁর। বিশেষ করে ইউরোপে, যেখান থেকে ব্যালন ডি’অরের অনেক ভোট কাস্ট হয়। তাঁর এমন আপসহীন অবস্থানও ভোটের ক্ষেত্রে প্রভাব রাখতে পারে বলে ধারণা করছেন অনেকে।

ব্যালন ডি’অর ট্রফিতে চুমু খাচ্ছেন রদ্রি। দৃশ্যটা ভিনিসিয়ুস জুনিয়র, তাঁর কাছের মানুষ আর রিয়াল মাদ্রিদের জন্য বেশ কষ্টের

পারফরম্যান্সের দিক থেকে ভিনিসিয়ুস চ্যাম্পিয়নস লিগে যতটা উজ্জ্বল, লা লিগায় তা নয়। গত মৌসুমে লা লিগায় প্রায় অর্ধেক সময়ই মাঠের বাইরে ছিলেন এই উইঙ্গার। এক হিসাবে দেখা গেছে, ২০২৩–২৪ মৌসুমে সম্ভাব্য ৩,৪২০ মিনিটের মধ্যে ভিনিসিয়ুস খেলেছেন ১,৮৭২ মিনিট (৫৪%)। অর্থাৎ প্রায় অর্ধেক সময় মাঠে দেখা যায়নি তাঁকে। যা তাঁর সামগ্রিক পরিসংখ্যানেও প্রভাব ফেলেছে। পুরস্কারেও হয়তো এ বিষয়টি নিশ্চিতভাবে প্রভাব রেখেছে।

ভিনিসিয়ুসের ব্যালন ডি’অর না পাওয়ার আরেকটি বড় কারণ হতে পারে পেশাদারি এবং ফেয়ার প্লে–সংক্রান্ত। মাঠে অনেক সময় শৃঙ্খলা ও আচরণজনিত কারণে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে তাঁকে। প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের পাশাপাশি রেফারিদের সঙ্গেও বিরোধে জড়াতে দেখা গেছে। তাঁর এই ভাবমূর্তি হয়তো ভোটারদের প্রভাবিত করেছে, যা উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে এনেছে তাঁর ভোট।

ভিনিসিয়ুস অবশ্য বলেছেন, তিনি আরও ১০ গুণ শক্তি নিয়ে ফিরে আসবেন। যদিও তাঁকে পুরস্কার দেওয়ার জন্য ব্যালন ডি’অর কর্তৃপক্ষ প্রস্তুত কি না, সেই প্রশ্নও সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন। তবে শেষ পর্যন্ত ভবিষ্যতে ট্রফিটা জিতুন বা না জিতুন, ২০২৪–এর ব্যালন ডি’অর প্রসঙ্গ সামনে এলে রদ্রির সঙ্গে না জিততে পারা ভিনির নামটাও চলে আসবে একই সমান্তরালে।