গোলের পর নাচ ভর করেছিল নেইমারদের শরীরে। আর ম্যাচে পায়ে ভর করেছিল সাম্বার তাল। দুর্দান্ত খেলেছে ব্রাজিল
গোলের পর নাচ ভর করেছিল নেইমারদের শরীরে। আর ম্যাচে পায়ে ভর করেছিল সাম্বার তাল। দুর্দান্ত খেলেছে ব্রাজিল

এই ব্রাজিল ভয়ালসুন্দর

পেলে ফেসবুকে পোস্টটি করেছিলেন ব্রাজিল–দক্ষিণ কোরিয়া ম্যাচের ঘণ্টা তিনেক আগে। নিজের প্রথম বিশ্বকাপের স্মৃতিচারণা করে কিংবদন্তি বলেছিলেন, হাসপাতাল থেকেই ম্যাচটি দেখবেন। বিশ্বকাপ জয়ের এই অভিযাত্রায় তিনিও নেইমারদের সঙ্গে আছেন। খেলতে তো আর পারবেন না, কিন্তু মন তো স্টেডিয়াম ৯৭৪–এ পড়ে থাকবে।

নেইমার–ভিনিসিয়ুসরা ‘কালো মানিক’–এর এই স্ট্যাটাস হয়তো দেখেছেন। পূর্বসূরি যখন অসুস্থ শরীরে হাসপাতালে থেকেও খেলা দেখতে বসেন, তখন তাঁকে একটা উপহার তো দিতেই হয়! রিচার্লিসন–নেইমাররাও হয়তো এমন কিছু ভেবে রেখেছিলেন। আর তাই এই বিশ্বকাপের শেষ ষোলোয় এসে দেখা গেল আসল ব্রাজিলকে।

সেই ব্রাজিল, যাদের পায়ে সুন্দর ফুটবলের ফুল ফোটে!

প্রথমার্ধে সেই ‘ফুল’ ফুটল ৪ বার। ফুলের ব্যাখ্যায় যাওয়ার আগে একটা তথ্য জানিয়ে রাখা উচিত। গ্রুপ পর্বে মাত্র ৩ গোল করেছিল ব্রাজিল, যা ১৯৭৮ বিশ্বকাপের পর গ্রুপ পর্বে ব্রাজিলের সবচেয়ে কম গোলের রেকর্ড। তার ওপর গ্রুপের শেষ ম্যাচে ক্যামেরুনের কাছে হার এবং গোল করতে না পারা—সব মিলিয়ে নেইমারদের মধ্যে একটি বিস্ফোরণ দেখার অপেক্ষা ছিল। সেটাই আজ দেখা গেল ভয়ালসুন্দর পারফরম্যান্সে।

৩৬ মিনিটের মধ্যে ৪ গোল! প্রতিটি গোলই যেন এক–একটি ‘গুলাবি খুশবু’, জোগো বনিতোর গন্ধে ম–ম করে। ২৯ মিনিটে রিচার্লিসনের হঠাৎ রোনালদো হয়ে গোল করা দেখে ধারাভাষ্যকার তো বলেই দিলেন, ‘দিস ইজ ব্রাজিল! দিস ইজ বিউটিফুল গেম!’

ঠান্ডা মাথায় প্রথম গোলটি করছেন ভিনিসিয়ুস

নেইমাররা সেই ‘বিউটিফুল গেম’ ফিরিয়ে আনাতেই ম্যাচটা আসলে প্রথমার্ধেই শেষ হয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত এসেছে ৪–১ গোলের মোহনীয় এক জয়।

৪–২–৩–১ ছকে রিচার্লিসনকে সামনে রেখে আক্রমণ সাজিয়েছিলেন ব্রাজিল কোচ তিতে। নেইমার ও দুই উইংয়ে ভিনিসিয়ুস এবং রাফিনিয়া দৌড়ানোর জায়গা পেয়েছেন শুরু থেকেই। জলের স্রোতোধারা যেভাবে সবকিছু ডিঙিয়ে আপন গতিতে এগিয়ে চলে, নেইমার ও তাঁর সতীর্থরা ঠিক এমন ফুটবলই খেলেছেন। তাতে ৭ মিনিটেই এসেছে প্রথম গোল।

ডান প্রান্ত দিয়ে রাফিনিয়া কোরিয়ান বক্সে ঢুকে ক্রস করেন। নেইমার বলে পা ছোঁয়ানোর চেষ্টা করেও পারেননি। পেছনেই একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন ভিনিসিয়ুস। বলটা পেয়েই ভিনি যেন একটু বুঝে নিলেন, ঠিক কোন দিক দিয়ে মারলে কোনো বাধা ছাড়াই জালে যাবে।

তারপর সেদিক দিয়েই গোল!

ম্যাচটা প্রায় আধঘণ্টার মধ্যেই মোটামুটি শেষ হয়ে যাবে, সেটি তখনো বোঝা যায়নি। আঁচ পাওয়া গেল ৫ মিনিট পর। কোরিয়ার বক্সে রিচার্লিসন ফাউলের শিকার হওয়ায় পেনাল্টি পায় ব্রাজিল। স্পটকিক থেকে নেইমারের নেওয়া পেনাল্টি শট খুদে ফুটবলারদের জন্য রেফারেন্স পয়েন্ট। শুধু শরীরের ডজে এত আস্তে শট নিয়েও লক্ষ্যভেদ করা সম্ভব!

গ্যালারির দর্শক যখন এমন ভাবনায় পুলকিত, স্কোরবোর্ডে তখন ব্রাজিল ২–০ গোলে এগিয়ে। কোরিয়ান খেলোয়াড়দের কাঁধ ঝুলে পড়তে শুরু করেছে। সেই সুযোগে ২৯ মিনিটে দেখা গেল ম্যাচের সবচেয়ে সুন্দর গোল।

রিচার্লিসনের গোলের পর। দুর্দান্ত এক গোল

কোরিয়ান বক্সের মাথায় বল নিয়ে গারিঞ্চার মতো কিছুক্ষণ ‘জাগলিং’ করে মারকিনিওসকে পাস দেন রিচার্লিসন। ডিফেন্ডারদের মনোযোগ নিজের ওপর থেকে সরাতে সেটি রিচার্লিসনের কৌশল ছিল, তা বোঝা গেল পরের দুটি পাসে।

মারকিনিওস থিয়াগো সিলভাকে পাস দেওয়ার ফাঁকে রিচার্লিসন পাকা ৯ নম্বরের মতো রক্ষণ ভেঙে দৌড় শুরু করেছেন, আর থিয়াগো সিলভাও চোস্ত মিডফিল্ডারের মতো বলটা তাঁর দৌড়ের পথে বাড়িয়ে দেন। বাঁ পায়ের নিখুঁত শটে রিচার্লিসনের করা গোলটি ‘ফেনোমেনন’কে মনে করিয়ে দেয়। ধারাভাষ্যকারের অবশ্য সেসব মনে করার সময় কোথায়! তিনি বলেছেন আসল কথাটা, ‘প্রবাবলি গেম ওভার!’

দক্ষিণ কোরিয়ার আশা ততক্ষণে ‘খুন’ হলেও ব্রাজিলের গোলের নেশা কাটেনি। ৩৬ মিনিটে তাই আবারও ডান প্রান্ত দিয়ে বল নিয়ে টান দেন রিচার্লিসন। নেইমারকে দেখে পাস বাড়ান। সেখান থেকে বল পান ভিনিসিয়ুস। ঠিক গোলমুখের সামনে দাঁড়ানো পাকেতাকে পাস বাড়ালেন। পাকেতা সারলেন শুধু আনুষ্ঠানিকতা, গোল করার!

প্রথমার্ধের একেবারে শেষ মুহূর্তেও গোল করার সুযোগ পেয়েছিলেন পাকেতা। ব্রাজিল সমর্থকেরা বলতে পারেন, অমৃতে অরুচি চলে এসেছিল, তাই করেনি! আসলে পাকেতা সুযোগটা নষ্ট করেছেন।

পেনাল্টি থেকে গোল করছেন নেইমার

সেই নষ্টের পরও অবশ্য ইতিহাস ফিরে এসেছে। ১৯৫৪ বিশ্বকাপের ১৬ জুন মেক্সিকোর বিপক্ষে গ্রুপ পর্বে প্রথমার্ধে ৪ গোলে এগিয়ে ছিল ব্রাজিল। ৬৮ বছর পর এই বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো সেই স্মৃতি ফিরিয়ে আনলেন নেইমার–রিচার্লিসনরা। উৎসবটা অবশ্য তার আগেই হয়েছে। প্রতিটি গোলেই গোল হয়ে নেচেছেন পাকেতা–ভিনিসিয়ুসরা। পায়ে ছন্দ আর মেজাজ ফুরফুরে থাকলে তিতের ব্রাজিল কত ভয়ংকর, সেটাই আজ বুঝল দক্ষিণ কোরিয়া। একটু ভুল হলো। কোরিয়া তো প্রায় কোনো কিছু টের পাওয়ার আগেই ম্যাচ হেরে বসেছে। কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রাজিলের প্রতিপক্ষ যেহেতু ক্রোয়েশিয়া, কোরিয়ার এমন হারে তাই লুকা মদরিচদের ভীতিই বেশি।

ছন্দে ফিরেছে ব্রাজিল। নেইমার–কাসেমিরোদের উদ্‌যাপনে উৎসবের ঢেউ

বিরতির পর ব্রাজিল অবশ্য এই ভীতি বেশিক্ষণ সঞ্চার করেনি। প্রথমার্ধে ব্রাজিলের পোস্টে একটি শট রাখতে পারা কোরিয়া সান্ত্বনাসূচক গোলের সুযোগ পেয়েছিল ৪৮ মিনিটে। কিন্তু সন হিউং–মিনের দারুণ শটটি রুখে দিয়ে গা–টা গরম করেন ব্রাজিল গোলকিপার আলিসন। প্রথমার্ধে যিনি প্রায় ‘বেকার’ দাঁড়িয়ে ছিলেন!

ওই সুযোগের ১০ মিনিট পর জটলার ভেতর থেকে গোলের আরও একটি সুযোগ পেয়েছিল কোরিয়া। মারকিনিওস, থিয়াগো সিলভাদের দৃঢ়তায় আর গোল হয়নি। তবে কোরিয়া একেবারে খালি হাতে ফেরেনি। ৭৬ মিনিটে দূরপাল্লার শটে গোল করেন পাইক–সিউং–হো।

দ্বিতীয়ার্ধে ব্রাজিল ছোট ছোট পাসে খেলে আক্রমণ সাজিয়েছে। গোলের সুযোগ যে পায়নি, তা নয়। কিন্তু ব্রাজিল ততক্ষণে খোলসে ঢুকে যেতে শুরু করেছে। সামনে যেহেতু কোয়ার্টার ফাইনাল, চোট এড়াতে এদের মিলিতাও, দানিলো ও ভিনিসিয়ুসকেও তুলে নেন তিতে।

দারুণ খেলেছে দল। এমন আনন্দ রিচার্লিসনদেরই মানায়

শুধু কি তাই, ৮১ মিনিটে গোলকিপার আলিসনকেও তুলে নেন তিতে! মাঠে নামান গোলকিপার ওয়েভেরতনকে। এর মধ্য দিয়ে বিশ্বকাপ স্কোয়াডের ২৬ খেলোয়াড়কেই খেলার সুযোগ করে দিলেন ব্রাজিল কোচ। যেন বাদ যাবে না কোনো ‘শিশু!’

অবশ্য প্রথমার্ধে ব্রাজিলিয়ান ‘বিউটিফুল গেম’-এর সামনে কোরিয়ানদেরই শিশু মনে হয়েছে। তাতে বলুন তো তৃপ্তিটা কার বেশি

হ্যাঁ, হাসপাতালে থেকেও ম্যাচে চোখ রাখা লোকটি। কালো মানিক! তাঁর জন্য ম্যাচ শেষে ব্যানার হাতে মাঠে দাঁড়িয়েছে ব্রাজিল দল। পেলের সুস্থতা কামনায় সেই ব্যানার আর এই ‘বিউটিফুল গেম’–ই তো সেরা প্রার্থনা!