আনহেল দি মারিয়ার কান্নার যথেষ্ট কারণ ছিল। আর্জেন্টিনার জার্সিতে এটিই যে তাঁর শেষ ম্যাচ। লিওনেল মেসির চোখের কোণে জল থাকাও অস্বাভাবিক নয়। পায়ে চোট নিয়ে আগেভাগে মাঠ ছাড়তে হয়েছে। তবুও যে সতীর্থরা দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করে গেছেন, এনে দিয়েছেন কোপা আমেরিকার ট্রফি, তাতে আনন্দে চোখে জল তো আসতেই পারে। কিন্তু লাওতারো মার্তিনেজ?
চোখ বেয়ে জল নামেনি। জয়ের আনন্দে মুখে হাসিও ফোটেনি। বরং চোখেমুখে কী ইস্পাত-কঠিন এক অনুভূতির প্রকাশ। ঘাসের সবুজ মাঠ আর গ্যালারিতে আর্জেন্টাইনদের হুল্লোড়, হইচই। এর মধ্যেও যেন অনুভূতির বিপরীত প্রান্তে তিনি। কী ম্যাচ শেষের বাঁশি বাজার পর, কী খানিক পর দলের সবাই মিলে বৃত্তাকার হয়ে নাচানাচির সময়েও। এমনকি মঞ্চে উঠে ব্যক্তিগত স্বীকৃতির স্মারক হাতে নেওয়ার মুহূর্তটাতেও!
এই লাওতারোর সাম্প্রতিক অতীতের গল্পটা যাদের জানা, তারা জানেন চোখেমুখে এমন অভিব্যক্তির কারণ। ওই চোখ দুটো যেন ঝলসে দিচ্ছিল কিছু একটা। অমন কঠিন মুখটা যেন গুঁড়িয়ে দিতে চাইছিল কিছু একটা!
কী-সেটা জানতে খুব বেশি নয়, দুই বছর পেছনে ফিরলেই চলবে। ২০২২ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা তাঁকে কাতারে নিয়ে গিয়েছিল দলের প্রধান স্ট্রাইকার হিসেবে। মেসি দলের প্রাণভোমরা হতে পারেন, কিন্তু প্রতিপক্ষের জালে বল পাঠানোর মূল দায়িত্বটা ছিল মার্তিনেজেরই। কিন্তু প্রথম ম্যাচে সৌদি আরবের বিপক্ষে সেটা করতে না পারাতেই গড়বড় হতে শুরু করে সব। মেসির নৈপূণ্যে সেই বিশ্বকাপ শেষ পর্যন্ত আর্জেন্টিনাই জিতেছে। ৩৬ বছরের খরা কাটিয়ে হাতে তুলেছে বিশ্বকাপ ট্রফি। কিন্তু মেসির স্বপ্নের সেই বিশ্বকাপ ব্যক্তি মার্তিনেজের জন্য ছিল দুঃস্বপ্নের।
৬ ম্যাচে মোট ২৪২ মিনিট মাঠে ছিলেন। কোনো গোল তো করতে পারেনইনি, সহায়তাও করতে পারেননি। পরিস্থিতি এমন বাজে ছিল যে প্রথম ম্যাচের পর লিওনেল স্কালোনি তাঁকে আর কোনো ম্যাচে নব্বই মিনিটই খেলাননি। মার্তিনেজের জায়গায় সুযোগ পেয়ে আর্জেন্টাইন ফুটবলে নতুন তারা হিসেবে জ্বলে ওঠেন হুলিয়ান আলভারেজ। আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ ট্রফি নিয়ে ফিরলেও ব্যক্তি মার্তিনেজকে ফিরতে হয় শূন্য হাতে। সঙ্গে আর্জেন্টাইন জার্সিতে নিজের ভবিষ্যতকে বড় প্রশ্নের মুখে রেখে।
সেই লাওতারোই এবারের কোপা আমেরিকায় যেন ভিন্ন কেউ!
প্রথম ম্যাচে কানাডার বিপক্ষে করলেন এক গোল, পরের ম্যাচে চিলির বিপক্ষে আরও একটি। সেদিন ২০১৬ আসরের চ্যাম্পিয়নরা প্রায় রুখেই দিয়েছিল আর্জেন্টিনাকে। কিন্তু মার্তিনেজই ৮৮ মিনিটে গোল করে দলকে উদ্ধার করেন, জেতান ১-০ ব্যবধানে। প্রথম দুই ম্যাচে দুই গোল করেই যেন দেশের জার্সিতে ছন্দ পেয়ে যান ইন্টার মিলান তারকা। পরের ম্যাচে পেরুর বিপক্ষে করেন জোড়া গোল। তবে যে কোনো ‘শাপমোচনের’ গল্প পূর্ণতা পেতে লাগে মধুর সমাপ্তি। আজ মায়ামির হার্ড রক স্টেডিয়ামে কােপা আমেরিকার ফাইনাল যেন সেটিই দেখল।
নব্বই মিনিটের পর অতিরিক্ত সময়ের প্রথমার্ধও গোলশূন্য সমতায় শেষ। কিছুক্ষণ পরই খেলা গড়াবে টাইব্রেকারে, যা অনেকটা ভাগ্য-পরীক্ষাও। আর এমন সময়ই ম্যাচের ১১২ মিনিটে আর্জেন্টিনার গোল, আর সেটি লাওতারো মার্তিনেজেরই! কলম্বিয়া গোলকিপারের মাথার ওপর দিয়ে বলটা জালে পাঠিয়েই পোস্টের পেছন দিয়ে মাঠ লাগোয়া সাইডলাইন ধরে দৌড়ালেন অনেকটা পথ। যেন ভেতরে জমে থাকা চাপ বা অপ্রাপ্তির আক্ষেপই ছড়িয়ে দিতে চাইলেন চারপাশে।
মার্তিনেজের শেষ মুহূর্তের এই গোলেই আর্জেন্টিনা কোপা আমেরিকার চ্যাম্পিয়ন! দুই বছর আগে একাদশে জায়গা পাচ্ছিলেন না, আর এবার ফাইনালে অতিরিক্ত সময়ে বদলি নেমে ট্রফি জেতানো গোল— যেন মোক্ষম শাপমোচনই হল তাঁর।
পুরো টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনার মোট গোল ৯টি, পাঁচটিই মার্তিনেজের! বিশ্বকাপে ২৪২ মিনিটে গোল ছিল না, এবার ২২১ মিনিটেই ৫ গোল!
কোপা আমেরিকায় আসার আগে ইন্টার মিলানের হয়ে লিগ জেতার পথে করেছিলেন ২৪ গোল, যা সিরি আ সর্বোচ্চ। এবার আর্জেন্টিনার হয়ে কোপা আমেরিকা জয়ের পথেও টুর্নামেন্ট-সর্বোচ্চ গোল! লাওতারো মার্তিনেজ শুধু নিজেকেই ছাড়িয়ে যাননি, খুব সম্ভবত ব্যালন ডি’অরের দৌড়েও অনেককেও।