১৩০ বছর আগে জ্যাক সাউথওয়ার্থ ৪০০ পাউন্ডে ব্ল্যাকবার্ন থেকে এভারটনে যোগ দিয়েছিলেন। ধারণা করা হয়, সেটিই ছিল ফুটবলে অর্থের বিনিময়ে প্রথম দলবদল। এরপর টেমসের পানি বহুদূর গড়িয়েছে। শৈল্পিক জায়গা থেকে ফুটবল ধীরে ধীরে সরে গেছে পণ্যের দিকে। সময় যতই গড়িয়েছে, খেলোয়াড়েরা আর নিছক বিনোদনদাতা হয়ে থাকলেন না, হয়ে উঠলেন উন্নত মানের বিক্রয়যোগ্য ‘পণ্য’। খেলার পাশাপাশি এখন তাঁদের আরও অনেক কিছু করতে হয়।
আর প্রতিবছর দুবার নিয়ম করে তাঁদের বিক্রিবাট্টাও চলে। তবে এসব দলবদলে ফুটবলাররা শুধুই পুতুল নন; বরং প্রতিটি দলবদলে তাঁদের আয়ও বাড়ে ত্বরিতগতিতে। এমনকি অনেক সময় মাঠের খেলাও অর্থের হিসাব-নিকাশের কাছে গৌণ হয়ে পড়ে। ফুটবলের এই বাণিজ্যিকীকরণ নিয়ে উরুগুইয়ান ক্রীড়া সাহিত্যিক এদোয়ার্দো গালেয়ানো লিখেছিলেন, ‘আজকের দিনে খেলা পরিণত হয়েছে প্রদর্শনীতে, যাতে থাকে কিছু কুশীলব আর দেখার জন্য অগণিত দর্শক। আর এই প্রদর্শনী দুনিয়ার অন্যতম ব্যবসায় পরিণত হয়েছে, যা করা হয় খেলাটাকে প্রাণবন্ত করার জন্য নয়, বাধা দেওয়ার জন্য।’ সরাসরি বাধা না দিলেও প্রদর্শনীসুলভ মনোভাব নিশ্চিতভাবে বদলে দিয়েছে এই খেলার গতিপথ। ফুটবলের প্রদর্শনীর এ দুনিয়ায় যুক্ত হয়েছে সৌদি আরবও। যারা সদ্য দলবদল শেষ করা ইউরোপকে কঠিন বার্তাও দিয়ে রেখেছে।
১৮৯৩ সালে সাউথওয়ার্থকে ঘিরে যে দলবদল শুরু হয়েছিল, সেটি পরে আর সরল পথে এগোয়নি। বর্তমান সময়ের দলবদলে চোখ রাখলেই পুরো চিত্র স্পষ্ট হবে। গত শতকের মাঝামাঝি সময় থেকেই বদলটা শুরু হয়। তখন থেকেই ইউরোপিয়ান ক্লাব ফুটবল–বাণিজ্যের কেন্দ্রে আসতে শুরু করে। একসময় রমরমা থাকা লাতিন ফুটবলকেও গিলে ফেলে ইউরোপ।
অথচ একটা সময় ছিল, যখন সান্তোসে নিজের প্রায় পুরো ক্যারিয়ার শেষ করেছেন পেলে, যাঁর নামের পাশে লাগানো হয়েছিল ‘বিক্রয়–অযোগ্য’ ট্যাগও। একইভাবে ব্রাজিলের ইতিহাসে আরেক সেরা খেলোয়াড় সক্রেটিসও তাঁর ক্যারিয়ার ব্রাজিলিয়ান লিগে শেষ করেছিলেন। এসব ঘটনা এখন রূপকথার গল্পের মতো। শুনলে মনে হয় কয়েক শতাব্দী আগের ঘটনা। অথচ গত শতাব্দীর মাঝামাঝি ও শেষ দিকে ঘটেছে এসব ঘটনা।
কোনো পরিবর্তনই স্থায়ী নয়। লাতিনকে কোণঠাসা করে যে ইউরোপ গত প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে ফুটবল–বাণিজ্যে ছড়ি ঘোরাচ্ছিল, তাদের এখন রীতিমতো হুমকিতে ফেলে দিয়েছে সৌদি আরব। পেট্রোডলারপুষ্ট সৌদি ক্লাবগুলো মাত্র আট মাসের ব্যবধানে কাঁপিয়ে দিয়েছে ইউরোপিয়ান ফুটবলের ভিত। সৌদি ক্লাবগুলোর এই অর্থপ্রবাহ অব্যাহত থাকলে সামনের কয়েক বছর বড় ধরনের বিপর্যয়ে পড়তে হতে পারে ইউরোপের ক্লাবগুলোকে।
ইউরোপিয়ান ফুটবলের ওপর সৌদি আরবের আঘাতের শুরুটা হয় ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে দিয়ে। রেকর্ড ২১ কোটি ডলার বেতনে ইতিহাসের অন্যতম সেরা এই ফুটবলার ইউরোপকে বিদায় বলে পাড়ি জমান সৌদি আরবে। রোনালদোর সৌদি-যাত্রাকে তখন এবং পরবর্তী আরও কিছু সময় পর্যন্ত বড় কোনো সমস্যা বলে মনে হয়নি। ইউরোপে সবকিছু জেতা রোনালদোর বয়স তখন ৩৯ ছুঁই ছুঁই। রোনালদোর এই বয়সও তাঁর সৌদি-যাত্রাকে অনুমোদনও দিয়েছিল। এরপর সৌদি আরবের রাডারে ছিলেন শুধু মেসি, যাঁর বয়সও ৩৫-এর ওপরে। আর বিশ্বকাপ জেতার পর ফুটবল থেকে মেসির চাওয়া-পাওয়ার তেমন কিছু বাকিও ছিল না।
দলবদল শুরু হওয়া পর্যন্ত রোনালদো ছাড়া শুধু মেসিরই সৌদি আরবে যাওয়ার সম্ভাবনায় উঁকি দিয়েছিল। কিন্তু জুনের শুরুতে সৌদিকে ‘না’ করে মেসি চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে। মেসির সেই দিক পাল্টানোকে এক দিকে সরিয়ে রাখলে গত চার মাসে ফুটবল–দুনিয়া রীতিমতো তোলপাড় করে দিয়েছে সৌদি আরব। করিম বেনজেমা, নেইমার, রবার্তো ফিরমিনো, সাদিও মানে, জর্ডান হেন্ডারসনসহ অসংখ্য তারকা ফুটবলারকে দলে ভিড়িয়েছে তারা, যাঁদের বেশির ভাগই চাইলে ইউরোপে আরও দু–তিন মৌসুম খেলে যেতে পারতেন। কিন্তু অর্থের তীব্র স্রোতের সামনে ইউরোপে খেলার আরও কিছুদিন খেলার স্বপ্ন বা ইচ্ছা খড়কুটোর মতো উড়ে গেছে।
লিভারপুল কোচ ইয়ুর্গেন ক্লপ কদিন আগে বলেছিলেন, ‘অনেক বেশি অর্থ সমস্যা ডেকে আনে।’ তবে এই সমস্যা মূলত ইউরোপের। খেলোয়াড় ধরে রাখতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে ইউরোপের ক্লাবগুলো। গতকাল রাতেও মোহাম্মদ সালাহর জন্য সৌদি ক্লাব আল ইত্তিহাদ ১৫ কোটি পাউন্ডের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের পর আরও ৫ কোটি বাড়াচ্ছে তারা। এমন প্রস্তাবের সাড়া না দিয়ে থাকা বেশ কঠিন। সেটা হোক ক্লাবের বা খেলোয়াড়ের জন্য।
রিয়াদ মাহরেজের ম্যান সিটি ছাড়া নিয়ে কোচ পেপ গার্দিওলা বলেছিলেন, মাহরেজের জন্য সৌদি আরব এত বড় অঙ্কের প্রস্তাব দিয়েছে যে সেটির বিপরীতে কিছু বলা কঠিন। আর অর্থের বিপরীতে ইউরোপিয়ান পরাশক্তিগুলোর এই নীরবতা সৌদি ক্লাবগুলোর জন্য হয়েছে দারুণ সুযোগ। সম্প্রতি উয়েফা প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্দার সেফেরিন অবশ্য বলেছেন, ‘এটা হুমকি নয়। একই ব্যাপার তো আমরা চীনের ক্ষেত্রেও দেখেছি। ওরাও প্রচুর টাকা দিয়ে ক্যারিয়ারের শেষ দিকে থাকা খেলোয়াড়দের কিনে নিয়েছিল। কিন্তু চীনের ফুটবলের তাতে উন্নতি হয়নি। ওদের দেশ এরপর আর বিশ্বকাপেও জায়গা করে নিতে পারেনি।’
সেফেরিন যতই বলুন না কেন, সৌদি আরবের প্রক্রিয়া আর চীনের খেলোয়াড় সংগ্রহের প্রক্রিয়া মোটেই এক নয়। চীন এতটা সুশৃঙ্খলভাবে পুরো প্রক্রিয়া দাঁড় করাতে পারেনি। আর ইউরোপের একাধিক শীর্ষ ক্লাবের মালিক আবার আরব বিশ্বের। গত দুই দশকে ইউরোপিয়ান ফুটবলে নিজেদের ভিত গড়েছে তারা। তাই চীনকে সৌদি আরবের সঙ্গে গুলিয়ে ফেললে আর বাস্তবতাকে অস্বীকার করলে সেফেরিনের জন্য বিপদ বাড়বে ছাড়া কমবে না।
এই তো কদিন আগেই নাইজেরিয়ার সাবেক ফুটবলার মাইকেল এনেমালোকে প্রথম ফুটবল ডিরেক্টর হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে সৌদি প্রো লিগ। যেখানে তাঁর প্রধান কাজ হবে দলবদলের কাজগুলো তদারক করা। এই এনেমালোর হাত ধরেই শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়েছিল চেলসি। খেলোয়াড় কেনা, স্কাউটিং থেকে শুরু করে ফুটবলের দলবদলের ছোটখাটো বিষয়গুলোও এনেমালোর করায়ত্তে আছে। তাঁর হাত ধরেই সম্পন্ন হয়েছে হুয়ান মাতা, থিবো কোর্তোয়া, কেভিন ডি ব্রুইনা, মোহাম্মদ সালাহ, এনগোলো কান্তে, এডেন হ্যাজার্ড এবং সেস ফাব্রেগাসের দলবদল।
এসব খেলোয়াড়ের প্রত্যেকেই পরবর্তী সময়ে ইউরোপে নিজেদের দাপট দেখিয়েছেন। তাঁকে অনেকে ফুটবলে কৃষ্ণাঙ্গদের নেতা হিসেবেও অভিহিত করে থাকেন। কদিন আগে কিলিয়ান এমবাপ্পে, হ্যারি কেইনদের মতো তারকাদের সৌদি আরবে দেখার ইচ্ছার কথা জানিয়েছিলেন এনেমালো। কাজটা যে তাঁর জন্য অসম্ভব নয়, সে প্রমাণ তো তিনি আগেই দিয়েছেন। অবশ্য এরই মধ্যে যেসব খেলোয়াড়কে সৌদি আরব টেনে নিয়েছে, সেই নামগুলোও কম সমীহ–জাগানিয়া নয়।
এমন নয় যে সৌদি আরবের উদ্দেশ্য, গোধূলিবেলায় পা রাখা খেলোয়াড়দের নিয়ে গিয়ে পুনর্বাসনকেন্দ্র খোলা; বরং তারা তরুণ এবং মধ্যগগণে থাকা খেলোয়াড়দের দিকেও হাত বাড়িয়েছে। ২৪ বছর বয়সী কিলিয়ান এমবাপ্পের জন্য আল হিলাল ৩০ কোটি ইউরোর প্রস্তাব দিয়েছিল। আর স্পেনের সম্ভাবনাময় সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার ২১ বছর বয়সী গাব্রি ভেইগাকে তো নিয়েই নিয়েছে আল আহলি। হ্যাঁ, এটা সত্য যে অপেক্ষাকৃত তরুণদের এখনো প্রথম পছন্দ ইউরোপ।
কিন্তু সৌদি আরব যদি এই ধারা আগামী কয়েক মৌসুম ধরে রাখে, তাহলে তরুণদের ভবিষ্যতের বাতিঘরও বদলে যেতে পারে। আর তরুণেরা সব সময় নিজেদের আদর্শদেরই অনুসরণ করে। নতুন প্রজন্মের জন্য যাঁরা আদর্শ ফুটবলার, সেই রোনালদো-নেইমার-বেনজেমারা এখন সৌদি আরবে। তাঁদের টানেও ভবিষ্যতে ইউরোপকে বিদায় বলে সৌদিকে বেছে নিতে পারেন উদীয়মান ফুটবলাররা। আর এমনটা হলে ইউরোপিয়ান ফুটবলের জন্য সামনে বড় ধরনের বিপর্যয় অপেক্ষা করছে। এরই মধ্যে চলতি মৌসুমে দলবদলের খরচের দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে ওঠে এসেছে প্রো লিগ। তাদের ওপরে আছে শুধু ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ।
এ ছাড়া উয়েফার নিজেদের তৈরি করা নীতিগুলোও তাদের জন্য গলার ফাঁস হয়ে উঠতে পারে। যেমন দলবদলের সময়সীমা ও আর্থিক সংগতির নীতির কথা বলা যায়। উয়েফার এসব নিয়মের কড়া প্রয়োগ সৌদি ক্লাবগুলোর কাছে ইউরোপকে নতজানু হওয়ার দিকে ঠেলে দিতে পারে। আগামী দিনগুলোয় এসব নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। ইয়ুর্গেন ক্লপের মতো কোচরাও দলবদলের সময়সীমা একই রকম করার আবেদন জানিয়েছেন। সৌদি আরবকে নিয়ে সতর্ক হতে বলেছেন সিটি কোচ গার্দিওলাও। হ্যাঁ, সতর্ক হওয়ার এখনই সময়। আর নয়তো লাতিন ফুটবলের মতো অতীতের সুখস্মৃতির জাবর কেটেই সময় পার করতে হবে ইউরোপকেও।