ঐতিহ্যের কঙ্কাল হয়েই গত মৌসুমটা শেষ করেছিল বার্সেলোনা। কোথাও কোনো সাফল্য নেই, শুধুই হাহাকার। ব্যর্থতার দায় নিয়ে মৌসুমের মাঝ পথেই কোচ জাভি হার্নান্দেজ ঘোষণা দেন—মৌসুম শেষে ক্লাব ছাড়বেন। তাঁর ক্লাব ছাড়া নিয়েও নাটক কম হয়নি। শুরুতে জাভি নিজে ক্লাব ছাড়তে চাইলেও তাঁকে থেকে যাওয়ার জন্য বুঝিয়ে রাজি করায় বার্সা। কিন্তু পরে সেই জাভিকে আবার বার্সাই ছাঁটাই করে। জাভির বিদায়ের পর নতুন কোচ কে হবেন, সেটা নিয়েও চলে নানা নাটক। শেষ পর্যন্ত জার্মান কোচ হানসি ফ্লিককে নিয়োগ দেয় তারা।
ফ্লিকের নিয়োগ নিয়েও নানা টানাপোড়েনে ছিলেন বার্সা সমর্থকেরা। জার্মান এই কোচ বার্সার সংস্কৃতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারবেন কি না, তারুণ্য ও অভিজ্ঞতার মধ্যে ভারসাম্য আনতে পারবেন কি না এবং চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রিয়াল মাদ্রিদকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারবেন কি না; সেসব নিয়েই ছিল যত প্রশ্ন। সেই প্রশ্নের উত্তর পেতে হয়তো আরও কিছু সময় লাগবে। তবে ‘সকালের সূর্যটা সুন্দর দিনের বার্তা দিচ্ছে’ বার্সা সমর্থকদের। লা লিগায় টানা ৭ ম্যাচ জিতে বার্সা এখন রীতিমতো উড়ছে।
এর মধ্যে আজ রাতে নতুন এক মাইলফলকের হাতছানিও আছে বার্সার সামনে। ওসাসুনার বিপক্ষে জিততে পারলে বার্সার ইতিহাসে দ্বিতীয় কোচ হিসেবে লা লিগায় নিজের প্রথম ৮ ম্যাচ জেতার মাইলফলক গড়বেন ফ্লিক। তবে এই পরিসংখ্যানের মধ্যে ফ্লিকের জন্য লুকিয়ে আছে একটি সতর্কবার্তাও। এর আগে বার্সার হয়ে প্রথম ৮ ম্যাচে জিতেছিলেন আর্জেন্টাইন কোচ জেরার্দো মার্তিনো। কিন্তু সে মৌসুমে শেষ পর্যন্ত শিরোপা জেতা হয়নি বার্সার। তবে এই সতর্কবার্তা নিয়েও বর্তমান মৌসুমটা বার্সা যেভাবে শুরু করেছে, সেখানে ইতিবাচক হওয়ার মতো অনেক কিছুই আছে।
ফ্লিককে নিয়ে বার্সেলোনা সমর্থকদের মধ্যে অস্বস্তির কথা আগেই বলা হয়েছে। কিন্তু সেই অস্বস্তি এখন অনেকটাই কেটে গেছে তাদের। বার্সাকে লা লিগায় তিনি যে শুরু এনে দিয়েছেন, সেটা আবার নতুন করে স্বপ্ন দেখাচ্ছে ক্লাবটিকে। অথচ ফ্লিক বার্সায় আসেন মূলত ফ্রি এজেন্ট হিসেবে। তাঁর পেছনে ছিল জার্মানির কোচ হিসেবে ব্যর্থতার বোঝা আর সামনে নিজেকে প্রমাণের কঠিন চ্যালেঞ্জ। অনুপ্রেরণা হিসেবে আবার ছিল বায়ার্ন মিউনিখকে ট্রেবল জেতানোর স্মৃতি। এমন পরিস্থিতিতে বার্সার দায়িত্ব নিয়ে দারুণ দায়িত্বশীলতার প্রমাণ দেন তিনি। শুরুতে তিনি সম্পর্ক গড়ে তোলেন খেলোয়াড়দের সঙ্গে। কদিন আগেই তাঁকে নিয়ে পেদ্রি বলেছিলেন, ‘খেলোয়াড়দের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক দারুণ। তিনি তরুণদের দারুণ সহায়তা করছেন।’ শুধু ড্রেসিংরুম নিয়ন্ত্রণ করে তো আর দলকে জেতানো যায় না। জিততে হলে প্রয়োজন মাঠে ভালো খেলা। সেখানেও চমক নিয়ে হাজির হয়েছেন ফ্লিক।
ফ্লিকের অধীনে বার্সা এমন ফুটবল খেলছে, যা লম্বা সময় ধরে ক্লাবটিতে দেখা যায়নি। বিশেষ করে লিওনেল মেসির বিদায়ের পর বার্সার আক্রমণভাগ হয়ে পড়েছিল নির্বিষ এবং সাদামাটা। এর ফলে প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়দের মধ্যে বার্সার আক্রমণভাগ নিয়ে যে আতঙ্ক, সেটাও কমতে থাকে। এসবের পেছনে অবশ্য কারণও ছিল। ফ্লিকের আগ পর্যন্ত কোচ যে–ই থাকুন, বার্সা খেলেছে মূলত তিকিতাকা ফুটবল। ফ্লিক এসেই তিকিতাকা সরিয়ে দিয়েছেন। দলকে এখন তিনি নিজস্ব ফুটবল–দর্শনে সাজানোর চেষ্টা করেছেন। যেটা কিনা বার্সার এত দিনের ফুটবল–দর্শন থেকে একেবারেই ভিন্ন। এই ফুটবল দর্শনের ফলও পেতে শুরু করেছে ক্লাবটি।
নতুনভাবে উজ্জীবিত হওয়া বার্সার মূল পরিবর্তনটা ঘটেছে আক্রমণভাগে। দলটির আক্রমণভাগের খেলোয়াড়েরা এ মুহূর্তে এককথায় দুর্দান্ত খেলছে। বল পায়ে প্রতিপক্ষের রক্ষণে কাঁপন ধরাচ্ছেন তাঁরা। প্রেসিং এবং ফিনিশিং—দুটিতেই দারুণ কৌশলী ক্লাবটি। লা লিগার প্রথম ৭ ম্যাচে এখন পর্যন্ত বার্সা গোল করেছে ২৩টি। যা দুইয়ে থাকা রিয়ালের চেয়ে ৭ গোল বেশি। এর মধ্যে চার বা তার বেশি গোল করেছে ৩ ম্যাচে। যেখানে আছে ভায়াদোলিদের বিপক্ষে ৭–০ গোলের জয়ও।
এক গোল দিয়ে জেতা ম্যাচ মাত্র একটি। এমনকি প্রতিপক্ষের গোললাইনের ৪০ মিটারের মধ্যে বল দখলেও বার্সা দারুণ কার্যকারিতা দেখিয়েছে। তবে আক্রমণভাগে বার্সার সবচেয়ে বড় স্বস্তির নাম সম্ভবত রবার্ট লেভানডফস্কি। ফ্লিকের অধীনে লেভা যেন নতুন করে নিজেকে খুঁজে পেয়েছেন। ৭ ম্যাচে লা লিগায় এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ ৭ গোল করেছেন তিনি, সঙ্গে আছে দুটি অ্যাসিস্টও। এ ছাড়া রাফিনিয়া এবং লামিনে ইয়ামালদের মতো ফরোয়ার্ডরাও নিয়মিত গোল পাচ্ছেন। মূলত আক্রমণভাগের ঘুরে দাঁড়ানোই বার্সাকে এখন নতুন করে স্বপ্ন দেখাচ্ছে।
প্রায় দুই দশকের বেশির ভাগ সময় বার্সার সমার্থক হয়ে ছিলেন মেসি। এ সময়ে মেসিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত ছিল তাদের খেলা। যা বার্সাকে সাফল্যও এনে দিয়েছে। বার্সায় মেসির সময়টাই ছিল ক্লাবটির স্বর্ণযুগ। কিন্তু ২০২১ সালে মেসি ক্লাব ছেড়ে যাওয়ার পর নতুন এক বাস্তবতার মুখোমুখি হয় বার্সা। তৈরি হয় বিশাল শূন্যতা। এর মধ্যে গাভি–পেদ্রিরা উঠে এসেছেন লা মাসিয়া থেকে, বাইরে থেকে এসেছেন লেভা–গুন্দোয়ানরা। আলো ছড়ালেও তাঁরা কেউই ক্লাবের প্রতীক হয়ে উঠতে পারেননি।
প্রায় দুই দশকের বেশির ভাগ সময় বার্সার সমার্থক হয়ে ছিলেন মেসি। এ সময়ে মেসিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত ছিল তাদের খেলা। যা বার্সাকে সাফল্যও এনে দিয়েছে।
এর মধ্যে গত মৌসুমে ১৫ পেরোনোর আগেই অভিষেক হয় লামিনে ইয়ামাল নামের এক বিস্ময় বালকের। লা মাসিয়ার এই কিশোর অভিষেকেই নজর কাড়েন। এরপর সময় যতই গড়িয়েছে, ইয়ামাল হয়ে উঠেছেন অপ্রতিরোধ্য। বল পায়ে প্রতিপক্ষকে একাই নাকানিচুবানি খাওয়াতে পারেন এই কিশোর। গত জুলাইয়ে স্পেনকে ইউরো জেতাতে বড় ভূমিকা রেখে হয়েছেন টুর্নামেন্টের সেরা তরুণ খেলোয়াড়ও। চলতি মৌসুমে ফ্লিকের বার্সা আবর্তিত হচ্ছে ইয়ামালকে ঘিরেই।
ইয়ামালকে এখন যৌক্তিকভাবেই এখন তুলনা করা হচ্ছে মেসির সঙ্গে। এখন পর্যন্ত লিগে ৩ গোলের সঙ্গে ৫টি অ্যাসিস্টও করেছেন ইয়ামাল। এমনকি প্রথম ছয় ম্যাচের পরিসংখ্যানও বলছে, দলের যেকোনো সতীর্থের চেয়ে বেশি ট্যাকলও জিতেছেন (৭টি) ইয়ামাল। পাশাপাশি প্রতিপক্ষের ফাইনাল থার্ডে বল পুনর্দখলও করেছেন সবচেয়ে বেশি (৯ বার)।
অনেকে বলেন, পরিসংখ্যান তো আর সব নয়, খেলার সৌন্দর্যও শ্রেষ্ঠত্বের গুরুত্বপূর্ণ নির্ণায়ক। এই মানদণ্ডেও ইয়ামাল এ মুহূর্তে শীর্ষ তারকাদের মধ্যেই থাকবেন। ড্রিবলিং, প্রেসিং, পাসিং কিংবা ফিনিশিংয়ে অবিশ্বাস্য দক্ষতা তাঁর। সব মিলিয়ে ফ্লিকের অধীনে ইয়ামাল নিশ্চিতভাবেই পূর্ণাঙ্গ খেলোয়াড় হিসেবে গড়ে উঠছেন, যিনি সামনের দিনে বার্সেলোনা এবং স্পেনের জন্য দারুণ এক সম্পদও হতে যাচ্ছেন।
বার্সার ফুটবলে এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় এক্স–ফ্যাক্টর ‘আনন্দময় ফুটবল’। দলের খেলোয়াড়েরা খেলাটাকে উপভোগ করছেন। খেলোয়াড়দের নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক ও বোঝাপড়াও চমকৎকার। এটি মূলত তাদের ক্রুয়েফীয় ফুটবল দর্শনের মূল কথাও বটে, যা তারা সাম্প্রতিক অতীতে হারিয়ে ফেলেছিল। এখনো অবশ্য মৌসুমে ১৬ শতাংশ সময় পার হয়েছে। তাই চূড়ান্ত কথা বলার সময় হয়তো এখনো আসেনি।