অনেক স্বপ্ন আর আশার জাল বুনে নায়ক এসেছিলেন মঞ্চে। তাঁকে ঘিরে প্রত্যাশার বেলুনও ফুলে উঠেছিল। ভালো হয়েছিল শুরুটাও। কাজী সালাহউদ্দিনের টানে বড় বড় প্রতিষ্ঠান এসেছিল স্পনসর হিসেবে। দেশের মৃতপ্রায় ফুটবল আবার জেগে ওঠার পথ খুঁজে পেয়েছে মনে করেছিলেন অনেকে। কিন্তু গতকাল তাঁর বিদায়ের ঘোষণার পর হিসাব মেলাতে বসলে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি হিসেবে কাজী সালাহউদ্দিনের ১৬ বছরের মূল্যায়নটা কেমন হবে?
ভালো-মন্দ দুটোই থাকছে খেরোখাতায়। ভালোটাই যদি আগে বলা হয়, ঘরোয়া ফুটবলের শীর্ষ স্তর একটা কাঠামো পেয়েছে। যদিও বছর বছর ক্লাব কমে যাচ্ছে, ঠিক থাকছে না ভেন্যু। তারপরও প্রিমিয়ার লিগটা নিয়মিত হচ্ছে, এটা সুখবর। খেলাটা অন্তত মাঠে আছে। সালাহউদ্দিনের ১৬ বছরে আর যা–ই হোক, খেলার জন্য ফুটবলারদের আন্দোলন করতে হয়নি। সালাহউদ্দিন দায়িত্ব নেওয়ার আগে কখনো কখনো তিন বছরেও একটা লিগ হয়েছে।
ক্লাব ফুটবল এবারও দেশের ছয়টি ভেন্যুতে হচ্ছে। এটি অবশ্যই ইতিবাচক। বাংলাদেশের ক্লাব বসুন্ধরা কিংস এএফসির চ্যাম্পিয়নস লিগের বাছাইয়ে খেলেছে। সামনে এগোনোর সূচক হিসেবে এটিকেও আপনি বিবেচনায় নিতে পারেন। শীর্ষ স্তরের ফুটবলারদের পারিশ্রমিক কোটি টাকা ছুঁয়েছে। ফুটবলে টাকার প্রবাহ বেড়ে যাওয়ায় কৃতিত্ব নিতেই পারেন সালাহউদ্দিন।
কৃতিত্ব নিতে পারেন দেশের নারী ফুটবলকে দাঁড় করানোরও। সালাহউদ্দিনের সমালোচকেরা অবশ্য এটিকে খুব একটা গুরুত্ব দেন না। কিন্তু একটা তথ্য না লিখলেই নয়। সাফের ফুটবলে বাংলাদেশ এই মুহূর্তে চারটি শিরোপার মালিক! যার তিনটিই মেয়েদের। মেয়েদের জাতীয় দল প্রথমবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ২০২২ সালে। বাকি দুটি শিরোপা অনূর্ধ্ব–১৬ ও অনূর্ধ্ব–১৯ বিভাগে। অন্য শিরোপাটি ছেলেদের অনূর্ধ্ব-২০ বিভাগে। এই গত মাসেই নেপালকে হারিয়ে এসেছে যে শিরোপা।
২০০৮ সালে প্রথমবার নির্বাচনে জিতেই সালাহউদ্দিন জাতীয় দলকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। ২০১২ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছেন। ২০১৬ ও ২০২০ সালে ভোটে। ক্রমে জাতীয় দলের প্রতি তাঁর মনোযোগ আরও বেড়েছে। এই সময়ে জাতীয় দল পেয়েছে সর্বোচ্চ সুযোগ–সুবিধা। বিদেশি কোচ, কোচিং স্টাফ, প্রচুর প্রীতি ম্যাচ, অনুশীলনের জন্য ফুটবলারদের বিদেশে পাঠানো, ফুটবলারদের ভালো হোটেলে রাখা—সালাহউদ্দিনের জমানায় আন্তর্জাতিক মানের সুযোগ–সুবিধাই পেয়েছে বাংলাদেশ জাতীয় দল।
কিন্তু যে জাতীয় দলের পেছনে অকাতরে ঢাকা ঢেলেছেন, সেই জাতীয় দলই তাঁকে সবচেয়ে বেশি নিরাশ করেছে। তাঁর সময়ে বাংলাদেশ একবারও সাফের ফাইনালে খেলতে পারেনি। ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে দেশকে ১৫০–এর ঘরে আনার আশা দেখিয়েছিলেন। উল্টো ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে মে—এই চার মাস বাংলাদেশ নেমে গিয়েছিল ১৯৭ নম্বরে। যখন সালাহউদ্দিনের বিদায়ের ঘণ্টা বাজছে, ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ভুটানেরও (১৮২) দুই ধাপ নিচে। কদিন আগেই ভুটানের বিপক্ষে দ্বিতীয়বারের মতো হেরে এসেছে বাংলাদেশ। ১৯৯৬ সালের এপ্রিলে ১৮১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ছিল ১১০। ২০০৮ সালের ২৮ এপ্রিল সালাহউদ্দিন বাফুফে সভাপতির দায়িত্ব নেওয়ার ১৯ দিন আগে ঘোষিত র্যাঙ্কিংয়ে ছিল ১৮০-তে। যখন যাচ্ছেন, তখন বাংলাদেশ চার ধাপ নিচে।
ফুটবলার হিসেবে তাঁর ক্যারিশমা এবং গত সরকারের শীর্ষ মহলের সঙ্গে সুসম্পর্ক মিলিয়ে সালাহউদ্দিনের কাছে প্রত্যাশা ছিল অনেক বেশি। সেটি কতটা পূরণ হয়েছে, তর্ক হতেই পারে। ফুটবলের জন্য আজও একটা নিজস্ব স্টেডিয়াম হয়নি। সংস্কারের নামে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম পড়ে আছে তিন বছর ধরে। প্রতিশ্রুতি দিয়েও পারেননি আধুনিক একটা একাডেমি করতে। সারা দেশে বিভাগভিত্তিক ফুটবল সেন্টার করার কথাও রাখতে পারেননি। এত বছরে ফিফার কাছ থেকে বাংলাদেশ দুটির বেশি পূর্ণাঙ্গ টার্ফ আনতে পারেনি। সেই দুটিও নষ্ট হয়ে গেছে। ফিফার অর্থায়নে ট্রেনিং সেন্টার করা যায়নি এখনো। যদিও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় সরকারের কাছ থেকে জমি না পাওয়াও এর একটি কারণ।
ক্লাবগুলোর নিজস্ব একাডেমি না হওয়া, বয়সভিত্তিক দল না গড়ার জন্য সালাহউদ্দিনকে সরাসরি দায়ী করা যাচ্ছে না। তবে ক্লাবগুলোকে তিনি বাধ্য করতে পারেননি। খেলোয়াড় আসে নিচের দিকের লিগ থেকে। ঢাকার নিচের দিকে লিগগুলোর প্রতিও নজর দেওয়া হয়নি সেভাবে। জেলা লিগগুলো অনিয়মিত। ঢাকার পাশের জেলা নায়ায়ণগঞ্জেই ছয় বছর ধরে ফুটবল লিগ হয় না। সালাহউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন বাফুফে এর কোনো খোঁজও রাখেনি। বাফুফে হয়ে রয়েছে আসলে ঢাকা ফুটবল ফেডারেশনই। সারা দেশের ফুটবল জাগানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে সালাহউদ্দিন ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে বাফুফের জেলা লিগ কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন। কিন্তু গত দুই বছরে এই কমিটির কোনো সভাই হয়নি।
সালাহউদ্দিনের গায়ে দুর্নীতির কালো দাগ লাগেনি ঠিক। কিন্তু তাঁর সময়ে ফিফা আর্থিক অনিয়মের অভিযোগে গত বছর এপ্রিলে বাফুফের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈমকে দুই বছর নিষিদ্ধ করেছে। বাফুফের অর্থ কমিটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার দায়ে বাফুফের দ্বিতীয় ব্যক্তি সিনিয়র সহসভাপতি সালাম মুর্শেদীকে ফিফা ১৩ লাখ টাকা জরিমানা করেছে। বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসে যা নজিরবিহীন। এর দায় সালাহউদ্দিন এড়াতে পারেন না। তাঁর ১৬ বছরে এটা বড় একটা কালির দাগ হয়েই থেকে যাবে।