যাত্রাবাড়ী ক্রীড়া চক্রের গোলকিপার ও অধিনায়ক মোহাম্মদ আলী
যাত্রাবাড়ী ক্রীড়া চক্রের গোলকিপার ও অধিনায়ক মোহাম্মদ আলী

পোস্টের নিচে আজও অবিচল ৫১ বছরের সেই মোহাম্মদ আলী

মাঠে নামার আগে ড্রেসিংরুমে সতীর্থদের বললেন, ‘শোনো, তোমরা কিন্তু মাঠে নিজেদের সেরাটা দিবা। কোনো রকম ঘাবড়াবা না। সবাই ভালো খেললে ইনশা আল্লাহ আমরা জিতব।’

বক্তার নাম মোহাম্মদ আলী। স্থান কমলাপুর বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী মোস্তফা কামাল স্টেডিয়ামের ড্রেসিংরুম। ২৪ আগস্ট ২০২২, বুধবার। বিকেল চারটায় ঢাকা প্রথম বিভাগ ফুটবল লিগে যাত্রাবাড়ী ক্রীড়াচক্র বনাম ফ্রেন্ডস সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার অর্গানাইজেশনের ম্যাচ শুরু হওয়ার ঘণ্টাখানেক আগের কথা।

প্রথম বিভাগ ফুটবল লিগ হলো বাংলাদেশের ফুটবলে তৃতীয় স্তর। প্রিমিয়ার লিগ ও চ্যাম্পিয়নশিপ লিগের পর এই লিগের স্থান। আর এই লিগেই এখন ১৪ দলে চার শর বেশি ফুটবলারেরর মধ্যে একজনের ওপরই সব আলো—মোহাম্মদ আলী। যিনি যাত্রাবাড়ী ক্রীড়া চক্রের অধিনায়কও। অধিনায়কের দায়িত্ববোধ থেকেই ওপরের কথাগুলো তিনি বলছিলেন সতীর্থদের।

নাইজেরিয়ান রক্ত বইছে মোহাম্মদ আলীর শরীরে

আলী নামটা শুনে অনেকেই হয়তো একটা মুখ মনে পড়ে যাবে। হ্যাঁ, ইনি সেই সেই মোহাম্মদ আলী, যাঁর শরীরে বইছে নাইজেরিয়ান রক্ত, যাঁর নানা ছিলেন নাইজেরিয়ান। চল্লিশের দশকে নাইজেরিয়ার এক সার্কাস দলের সদস্য হয়ে তাঁর নানা বাংলাদেশে আসেন তরুণ বয়সে। তারপর নারায়ণগঞ্জে থেকে যান। সেখানেই বিয়ে করেন। তাঁরই নাতি আজকের মোহাম্মদ আলী, আগামী ৩ অক্টোবর যিনি ৫২ বছরে পা দেবেন।

নারায়ণগঞ্জ শহরের বাপ্পি সরণিতে রণদাপ্রসাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই ঘনবসতি এলাকায় আলীর দোতলা বাড়ি। সেখানেই থাকেন বাংলাদেশের ৫০ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বয়সী এই ফুটবলার। নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা এসে অনুশীলন, ম্যাচ খেলা এখনো তাঁর প্রাত্যহিক জীবনের অংশ।

বুধবার ঢাকায় ম্যাচ থাকায় সকাল ৯টার আগেই নারায়ণগঞ্জ থেকে যাত্রাবাড়ী ক্লাবে চলে আসেন। তাড়াহুড়া করে বের হওয়ার কারণে বাড়ি থেকে মুঠোফোন আনতে ভুলে যান। ফলে সারা দিন অনেকেই তাঁকে ফোনে পাননি। আলীর অবশ্য এসব নিয়ে ভাবার সময় নেই। ক্লাবে এসে সতীর্থদের সঙ্গে ম্যাচের প্রস্তুতি নিয়ে কথা বলেন। দুপুরে চলে আসেন কমলাপুর স্টেডিয়ামে।

মোহাম্মদ আলী স্টেডিয়ামে আসা মানে তাঁর দিকেই অনেকের চোখ। ওই যে আলী ভাই...ভাই ভালো আছেন? এমন কত প্রশ্ন ভেসে আসে। ছোট–বড় প্রায় সবারই চেনা মুখ। আলী সবার সঙ্গে কথা বলেন, করমর্দন করেন, হেসে উত্তর দেন কেউ কিছু জানতে চাইলে। মানুষটা দেখতে অনেকটা আফ্রিকানদের মতোই। তাই তাঁকে নিয়ে একটা বাড়তি কৌতূহল বরাবরই থাকে। অতীতে তাঁকে অনেকে বিদেশি খেলোয়াড় ভাবতেন, এখনো নাকি এ বিড়ম্বনায় পড়েন।

ফুটবল খেলে মোহাম্মদ আলীর জেতা ট্রফিগুলোর একাংশ

সেসব বিড়ম্বনা কখনো কখনো তাঁর জন্য মধুর অভিজ্ঞতাই হয়ে আসে। তবে অতীত এক পাশে রেখে এখন তাঁর সব মনোযোগ খেলার দিকে। নিজের চেয়ে অনেক ছোট বয়সের তরুণদের উৎসাহ দিয়ে কীভাবে মাঠে সেরাটা বের করবেন, সেই দাওয়াই খোঁজেন। ফলও পেয়েছেন। ১৪ দলের প্রথম বিভাগে প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশ বয়েজের বিপক্ষে জিতেছেন ১–০ গোলে। দ্বিতীয় ম্যাচে পিডব্লুডির সঙ্গে গোলশূন্য ড্র।

প্রথম দুটি ম্যাচেই পুরো সময় খেলেছেন আলী। দলকে দারুণ নেতৃত্ব দিয়ে দুই ম্যাচে তুলেছেন ৩ পয়েন্ট। কোনো গোল হজম করেননি। গোলকিপার হিসেবে আজও আস্থার প্রতীক। তবে মজা করে বলেন, ‘আজ তৃতীয় ম্যাচ। আল্লাহই জানেন, আজ কপালে কী রাখছেন।’

এমনটা কেন ভাবছেন? এক ফাঁকে ড্রেসিংরুমে বসে এই প্রতিবেদককে বললেন, ‘আজকের ম্যাচটা নিয়ে একটু টেনশনে আছি। কারণ, আমার ভাইটাল একটা প্লেয়ার নাই। আগের ম্যাচে রেড কার্ড খাইছে। এখন এর জায়গায় অন্য একজন খেলবে।’

আলীর সতীর্থ ফুটবলাররা বেশির ভাগই ১৮ থেকে ২০ বছরের মধ্যে। তার মানে আলীর ফুটবল খেলা শুরুর পর সবার জন্ম। বলা যায়, সতীর্থরা তাঁর ছেলের বয়সী সবাই। ফুটবলীয় অভিজ্ঞতায় তরুণেরা যদি পুকুর হন, আলী মহাসাগর। বিশাল তাঁর ভান্ডার। আবাহনীসহ দেশের কয়েকটি শীর্ষ দলে খেলেছেন। তাঁর সময়ের আলফাজ, আরমানরা সেই কবে খেলা ছাড়লেও বয়সের দূরত্ব ঘুচিয়ে আলী ২৯ বছর ধরে টানা খেলে চলেছেন।

পরিবারের সঙ্গে মোহাম্মদ আলী

কীভাবে তরুণদের সঙ্গে মানিয়ে নিচ্ছেন? প্রশ্ন শুনে নড়েচড়ে বসেন। বলেন, ‘ওরা আমার অনেক জুনিয়র। উৎসাহ দিয়া দিয়া খেলাই। বলি, টেনশনের কিছু নাই। তোমরা খেলো। আর ওদের প্রতিদিন বলি, ফুটবলে প্র্যাকটিসের বিকল্প নাই। প্র্যাকটিস না করলে কিছুই করতে পারবা না। এটাই মেসেজ ওদের প্রতি আমার। সব সময় বলি, আমাকে ফলো করো। ৫০ বছর পার হয়েও আমি এখনা খেলি। প্র্যাকটিস না করলে ফিটনেস থাকবে না। আমি প্রতিদিন প্র্যাকটিস করি, তোমরাও করো।’

তরুণেরা অবশ্য সেভাবে খুব বেশি জানেন না আলী সম্পর্কে। সেটার প্রমাণও মিলল। ড্রেসিংরুমে আলীর পাশে বসা চট্টগ্রামের পটিয়ার এক তরুণ ফুটবলারকে প্রশ্ন করলে বলেন, ‘উনি আলী ভাই। আমরা ঢাকার মাঠে আসার পর থেকে দেখতেছি উনি খেলতেছেন। ওনার নানার বাড়ি শুনলাম বাইরে কোথায় যেন...। এর বেশি কিছু জানি না।’ সাগর নামের এক ফুটবলারের কথা, ‘উনি আলী ভাই। উনি আমাদের ক্যাপ্টেন।’

আলী সফল অধিনায়ক হতে চান। এই ছেলেদের নিয়ে আগামী বছর পেশাদার লিগের দ্বিতীয় স্তরে ওঠার স্বপ্ন তাঁর। পারবেন শেষ পর্যন্ত এই ছেলেদের নিয়ে স্বপ্ন পূরণ করতে? আলী বলেন, ‘ওদের মধ্যে সম্ভাবনা আছে। দরকার ভালোভাবে ওদের পরিচালনা করা। সেটা করতে পারলে আশা করি লক্ষ্য পূরণ হবে।’ এরপর যোগ করেন, ‘আমার সম্পর্কে ওদের জানার কথা নয়। আমার সম্পর্কে প্রশ্ন করবেন আলফাজ, আরমানকে। ওরা বলতে পারবে ভালো। এই ছেলেরা কিছুই বলতে পারবে না। কারণ, এরা আমার আগের খেলা দেখে নাই।’

আলীকে দেখে আশ্চর্য লাগল, এখনো তাঁর ফিটনেস ১৭–১৮ বছরের তরুণের মতো। প্রতিদিন অনুশীলন করেন। ফাঁকি শব্দটা তাঁর জীবনেই নেই। এটাই তাঁর এত বছর টানা খেলে আসার রহস্য। এখন অধিনায়ক হিসেকে বাড়তি দায়িত্ব বর্তেছে। বলেন, ‘ক্যাপ্টেন হিসেবে দলটাকে ব্রিফিং দিই। ওদের উৎসাহ দিই। এই কাজটা করতে আমার খুব ভালো লাগে।’ যাত্রাবাড়ীর সঙ্গে তাঁর চুক্তি দুই লাখ টাকায়। ১ লাখ টাকা অগ্রিম পেয়ে গেছেন। সিঙ্গেল লিগ ভিত্তিতে তাঁকে খেলতে হবে ১৩টি ম্যাচ।

এই বয়সেও ফুটবল টানে মোহাম্মদ আলীকে

এর আগে বলেছিলেন, ৬০ বছর পর্যন্ত খেলতে চান। এবারও একই কথা তাঁর মুখে, ‘অবশ্যই ইচ্ছা আছে ৬০ বছর পর্যন্তই খেলা। ফিটনেস ধরে রেখেছি এখনো। সামনেও ধরে রাখব।’ সেটা যে অসম্ভব নয়, মাঠে দাঁড়িয়ে বলে দিলেন যাত্রাবাড়ীর কোচ আক্তার হোসেন, ‘আলীর মধ্যে এখনো যে শৃঙ্খলা আর একাগ্রতা, সেটা অন্যদের কাছে আদর্শ হতে পারে। ওর ফিটনসেও দারুণ। এ কারণেই ওকে আমরা নিয়েছি। এখন পর্যন্ত খুব ভালোভাবে দলটাকে টেনে নিচ্ছে।’

সত্যিই তাই। বুধবার দিনটা তাঁর জন্য দারুণ কেটেছে। দিন শেষে ছিল না কোনো টেনশন। ফ্রেন্ডস সোসাইটিকে তাঁর দল যাত্রাবাড়ী হারিয়েছে ১–০ গোলে। ৩ ম্যাচে ৭ পয়েন্ট। তিন ম্যাচে কোনো গোল হয়নি তাঁর বিপক্ষে। আলী এক পা করে এগোচ্ছেন সামনে তাঁর লক্ষ্যপূরণের দিকে।

১৯৯৩ সাল থেকে শুরু করে ২৯ বছর ধরে বাংলাদেশের শীর্ষ স্তরে ফুটবল খেলে চলেছেন আলী। গত বছর খেলেন পেশাদার লিগের দ্বিতীয় স্তর চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে, ফরাশগঞ্জে। এবারের চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে খেলব খেলব করেও দু–একটি ক্লাবের দেওয়া আর্থিক প্রস্তাব পছন্দ না হওয়ায় চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে খেলেননি। অপেক্ষায় ছিলেন প্রথম বিভাগে খেলার। সেই অপেক্ষা ফুরানোয় দারুণ খুশি দেশি হয়েও বিদেশি ফুটবলারের তকমা পাওয়া মোহাম্মদ আলী।