ছেলেটির ঘরভর্তি ছিল ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর পোস্টার। সেই পোস্টারগুলোর সঙ্গে তুলে রেখেছিল নিজের কিছু ছবিও। একটু গভীরভাবে তাকালে দেখা যাবে, ছবির সেই ছেলেটির মুখ থেকে ঠিকরে পড়ছে আলোর দ্যুতি। আর গোল গোল চোখ দুটি বলে যাচ্ছে অনেক স্বপ্নের কথা। যেন বলছে, ‘একদিন আমিও রেকর্ডের পর রেকর্ড পদানত করে যাব। আমার গতি তোমাদের মনে করিয়ে দেবে বজ্রবিদ্যুৎ উসাইন বোল্টের কথা। ও হ্যাঁ, আমার নাম? কিলিয়ান এমবাপ্পে। মনে রেখো কিন্তু!’
যাঁকে আদর্শ মেনে স্বপ্নের শুরু, বয়স ২০ পেরোনোর আগেই অনেক দিক থেকে এমবাপ্পে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন সেই রোনালদোকে। আর বিশ্বকাপ ছুঁতে না পারার আক্ষেপ নিয়ে রোনালদো যেবার কাঁদতে কাঁদতে টানেল ধরে বেরিয়ে গেছেন, সেবার এমবাপ্পে দেখছেন টানা দ্বিতীয় বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন।
যে স্বপ্নপূরণে আর একটিমাত্র বাধা। আজকের ফাইনালে লিওনেল মেসির স্বপ্ন গুঁড়িয়ে দিতে পারলে ২৩ বছর বয়সেই মহাতারকা থেকে কিংবদন্তিদের সংক্ষিপ্ত তালিকায় ঠাঁই করে নেবেন এই ফরাসি ফরোয়ার্ড।
ফ্রান্সের প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের কিছুদিন পর জন্ম এমবাপ্পের। শৈশব কেটেছে দাঙ্গা-হাঙ্গামায় ভরপুর প্যারিসের বদিঁ এলাকায়। তবে ফুটবল মাঠে প্রতিপক্ষের রক্ষণে সন্ত্রাস ছড়াতে যাঁর জন্ম, তাঁকে কি আর অন্য কিছু ছুঁতে পারে! অপয়া কিছু ছুঁতে পারেনি এমবাপ্পেকেও। বলা যায়, গতিতেই তিনি পেছনে ফেলেছেন সব প্রতিবন্ধকতা ও আশঙ্কাকে। তাই এমবাপ্পে যখন বলটাকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ছুটতে থাকেন, মনে হয় শুধু গোল করার জন্যই তিনি ছুটছেন না। অনেক জমানো ক্ষোভ ও যন্ত্রণার জবাব দিতেই তাঁর এই ঊর্ধ্বগতিতে ছুটে যাওয়া।
ডিয়েগো ম্যারাডোনাকে নিয়ে একবার তাঁর সতীর্থ হোর্হে ভালদানো বলেছিলেন, ‘ম্যারাডোনার বাঁ পায়ে থাকার মতো সুন্দর অভিজ্ঞতা কোনো বলের আর কখনো হয়নি।’ এমবাপ্পের ক্ষেত্রে বলের হয়তো ঠিক উল্টো অভিজ্ঞতা হয়। তাঁর পায়ে বল মানে যেন, বিধ্বংসী কিছু ঘটার সম্ভাবনা। বলটিকে বোমা বানিয়ে মুহূর্তের মধ্যে হয়তো ছারখার করে দেবেন প্রতিপক্ষের রক্ষণ।
এই বিশ্বকাপেও একাধিকবার দেখা গেছে এমন এমবাপ্পে-ঝড়। সর্বশেষ সেমিফাইনালে মরক্কোর বিপক্ষে দ্বিতীয় গোলটিতে এমবাপ্পের ছুটে যাওয়ার কথাই ধরা যাক। পিএসজি তারকা বল নিয়ে যেভাবে উল্কার গতিতে ঢুকে প্রতিপক্ষ রক্ষণকে এলোমেলো করে দিয়েছিলেন, সেখানেই মূলত ম্যাচ থেকে মানসিকভাবে ছিটকে পড়ে মরক্কো। ফাইনালের আগপর্যন্ত মেসির সমান ৫ গোল করেছেন এমবাপ্পে। সুযোগ আছে গোল্ডেন বুট জেতার। দলীয় অর্জনের সঙ্গে ব্যক্তিগত মাইলফলকের হাতছানিও হয়তো তাতিয়ে দেবে তাঁকে।
আজ আর্জেন্টিনারও তাই বিধ্বংসী এমবাপ্পেকে নিয়েই যত ভয়। মাঝমাঠ থেকে তাঁর একটি দৌড় যে আর্জেন্টাইনদের ৩৬ বছর ধরে জমানো স্বপ্নকে ভাসিয়ে দিতে পারে অথই জলে।
আর এমবাপ্পে যে কাজটা কত নিখুঁতভাবে করতে পারেন, তা মেসিদের চেয়ে ভালো আর কারা জানে। ২০১৮ সালে তেমনই এক দৌড় আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে দিয়ে বুয়েনস এইরেসের পথ দেখিয়ে দিয়েছিল। আজও তেমনটি হলে মেসির চিরদুঃখগাথার ভেতরেই দীর্ঘস্থায়ী হবে এমবাপ্পের সাম্রাজ্য।
তা ছাড়া ফাইনালের জয় এমবাপ্পের হয়ে উত্তর দেবে অনেক প্রশ্নের। অনেক বঞ্চনা ও যন্ত্রণার জবাবও যে দেওয়ার আছে তাঁর। চার বছর আগে এই এমবাপ্পের পায়ে ভর দিয়েই ফরাসিরা জিতেছিল দ্বিতীয় বিশ্বকাপ শিরোপা। অথচ সেই এমবাপ্পে ইউরোতে পেনাল্টি মিস করায় রাতারাতি হয়ে যান খলনায়ক।
এরপর থেকে বর্ণবাদী আক্রমণ তাঁর নিত্যসঙ্গী। এমনকি জাতীয় দল থেকে বিদায় নেওয়ার কথাও নাকি ভেবেছিলেন। এমবাপ্পে বলেছিলেন, ‘যারা আমাকে বানর মনে করে, তাদের জন্য আমি খেলতে পারি না। আমি জাতীয় দলে খেলব না।’
সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছিলেন নতুন প্রজন্মকে হার না–মানার বার্তা দিতে। আজ এমবাপ্পের জয় মানেই তাই তারুণ্যেরও জয়। হাল না ছেড়ে নিজের স্বপ্নকে যাঁরা হাত দিয়ে স্পর্শ করতে চান, এই জয় হবে তাঁদেরও।