মতিন মিয়ার নয় সদস্যের পরিবার। সম্বল বলতে দুটি ছোট্ট ঘর। সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক বাবার আয় দিয়েই চলত সংসার। কিন্তু সামান্য আয় দিয়ে সংসার চলছিল না। পড়াশোনা বন্ধ করে মতিনকে তাই নামতে হয়েছিল রংমিস্ত্রির কাজে। সারা দিন হাড়ভাঙা খাটুনির পর দিন শেষে যে সামান্য টাকা পেতেন, মতিন সেটিই তুলে দিতেন মায়ের হাতে।
এরপর কেটে গেছে আরও চার বছর। কিন্তু চার বছরের মাথাতেই মতিনের জীবনটা যেন পাল্টে গেছে ভোজবাজির মতো। ফুটবলের প্রতিভাটা ছিলই। সেটির স্পর্শেই রংমিস্ত্রি মতিনের জীবনটা এখন রঙিন।
মতিনকে বাংলাদেশের ফুটবলে হালে অন্যতম প্রতিভাধর ফুটবলার হিসেবেই মনে করা হয়। গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে সেই প্রতিভারই ঝলক দেখালেন যেন। হয়ে উঠলেন ফুটবলে আশার আলো। তাঁর গোলেই সাইফ স্পোর্টিং পেয়েছে দারুণ এক জয়।
‘বক্স অফিসে’ বাজিমাত করতে মতিন কাল সময় নিয়েছেন মাত্র ৯ মিনিট। আরামবাগকে এই সময়ের মধ্যেই বুঝিয়ে দিয়েছেন নিজের যোগ্যতা। ‘নাম্বার নাইন’ হিসেবে প্রতিপক্ষ রক্ষণভাগকে গতিতে পেছনে ফেলা, আড়ালে থেকে গোলমুখে জায়গা করে নেওয়া, প্রয়োজনে নাম্বার টেন ও উইংগার পজিশনের সঙ্গে জায়গা বদল করা। একই সঙ্গে গোলের ক্ষুধা তো আছেই। সবকিছু মিলিয়ে মতিন যেন একজন দক্ষ স্ট্রাইকারের প্যাকেজ।
গত মৌসুমেই মতিন মিয়ার ঝলক দেখেছে চ্যাম্পিয়নশিপ ফুটবল। সেখান থেকে সাইফকে প্রিমিয়ারে উঠতে মতিনের ভূমিকা দুর্দান্ত। গোল করেছিলেন ৬টি। হয়েছিলেন লিগের সেরা খেলোয়াড়। পুরস্কার হিসেবে ডাক পেয়েছিলেন জাতীয় দলের কন্ডিশনিং ক্যাম্পে। সাইফ স্পোর্টিং কন্ডিশনিং ক্যাম্প করতে কলকাতায় যাওয়ার পর তাঁর দুই পায়ের কাজ ইস্টবেঙ্গলের মতো ক্লাবে কর্তাদের নজরও নাকি কেড়েছিল। সেখানে ইস্টবেঙ্গলের জুনিয়র দলের বিপক্ষে দুটি প্রীতি ম্যাচ খেলেছিল সাইফ। দুটিতেই মতিনের নৈপুণ্য ছিল অনন্য।
সিলেট শহরের পাশে তাজপুরে মতিনের বাড়ি; এলাকায় খালি পায়েই ফুটবল খেলতেন। পরে এক বড় ভাইয়ের পুরোনো বুট দিয়ে খেলা শুরু করেন। প্রতিভা তো আর চেপে রাখা যায় না। কিছুদিনের মধ্যেই নাম ছড়িয়ে পড়ে তাঁর। কিন্তু অভাবের তাড়নায় পড়াশোনার মতো ফুটবল খেলাও যখন অনিশ্চয়তার মধ্যে, ঠিক তখনই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন ‘বড় ভাই’ জাতীয় দলের ডিফেন্ডার ইয়ামিন মুন্না। মুন্নার হাত ধরেই ঢাকার আসা। ফুটবলে নিজের প্রতিভার দ্যুতি ছড়িয়ে দেওয়া।
২০১৪ সালে শুরু। টিঅ্যান্ডটি ক্লাবের হয়ে প্রথম বিভাগে ছয় ম্যাচে ছয় গোল। কিন্তু সিলেটে ‘খ্যাপ’ খেলার নেশায় পরের বছর ঢাকায়ই আসেননি মতিন। মুন্না প্রায় জোর করেই সাইফ স্পোর্টিংয়ে নিয়ে আসেন। পেশাদার লিগের দ্বিতীয় স্তরে সাইফ পাওয়ারটেক তাঁকে পাঁচ লাখ টাকা দিয়েছিল। দলটি প্রিমিয়ারে ওঠার পর অঙ্কটা বেড়ে হয়েছে ১৫ লাখ। ‘অনেক কষ্ট করে আমাকে এত দূর আসতে হয়েছে। পুরস্কারও পাচ্ছি। পরিবারে একটু সচ্ছলতা ফেরাতে কত দিন, কত কষ্টই-না করেছি!’
স্কিল ও গতির কারণে মতিনের প্রশংসা এখন সবার মুখেই। একই ক্লাবে খেলা জাতীয় দলের হোল্ডিং মিডফিল্ডার জামাল ভূঁইয়া নাকি বল ছাড়ার আগে শুধু মতিনকেই খোঁজেন। সবচেয়ে বড় সার্টিফিকেট দিয়েছেন জুনিয়র জাতীয় দলের কোচ, জাতীয় দলের সাবেক ফুটবলার মাহবুব হোসেন রক্সি। ১৯ বছর বয়সী এই স্ট্রাইকারের আবির্ভাবে দেশের স্ট্রাইকার-সমস্যার সমাধান হতে চলেছে বলেই মনে করেন তিনি, ‘আমরা অনেক দিন পরে ভালো একজন স্ট্রাইকার পেয়েছি। পড়েছেও ভালো কোচের হাতে। প্রিমিয়ার লিগে সে আরও অনেক ভালো করবে।’
সাইফের ব্রিটিশ কোচ টিম গ্র্যান্ট উচ্ছ্বসিত মতিনের পারফরম্যান্সে, ‘সে খুবই ভালো খেলেছে। একটি কেন, ফিনিশিংটা নিখুঁত হলে সে তিনটি গোলও করতে পারত।’
সাইফের দলটি এবার তারকায় ঠাসা। কিন্তু গ্রান্টের মতে, এই দলটাকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেবেন মতিনই।