ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ ফুটবলে আলো ছড়াচ্ছেন বাংলাদেশের বংশোদ্ভূত ফুটবলার হামজা দেওয়ান চৌধুরী। বাংলাদেশের মানুষের আশা, ভবিষ্যতে বাংলাদেশের জার্সিতে খেলবেন হামজা। সে সম্ভাবনা উড়িয়ে দেননি ২১ বছরের তরুণ। কিন্তু বিষয়টি নির্ভর করছে অনেক যদি-কিন্তুর ওপর। ইংল্যান্ড থেকে হামজা হোয়াটসঅ্যাপ ভিডিও কলে প্রতিবেদক রাশেদুল ইসলামকে শুনিয়েছেন সে সম্ভাবনার কথা
‘আমি ভালা আছি। আপনি কী রকম আছেন’
৮ হাজার ২২ কিলোমিটার (গুগলের তথ্য মতে) দূর থেকে ভেসে আসা কণ্ঠটা মুহূর্তের মধ্যে চমকে দিল। ইংরেজি প্রশ্নের প্রত্যুত্তরে অপ্রত্যাশিত বাংলা জবাবে যে এত রোমাঞ্চ ঠাসা, সোমবার রাতের আগ পর্যন্ত তা অজানা! ফোনের অপর প্রান্তের মানুষটি কে জানেন? ইংলিশ ফুটবলে তারুণ্যের দীপ্তি ছড়ানো ইংল্যান্ডের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাময় তারকা হামজা দেওয়ান চৌধুরী। নাম ও পদবিতে বাংলাদেশি বটে, কিন্তু বিশ্বের অন্যতম সেরা প্রিমিয়ার লিগ ফুটবলে নিয়মিত খেলা ছেলেটির মুখে সিলেটের আঞ্চলিক বাংলা শুনে অবাক হতেই হয়।
৯ মিনিট ২১ সেকেন্ডের ভিডিও আলাপের শুরুতে আড়মোড়া ভেঙেছেন হামজাই ‘দ্যাশি (দেশি) ভাই’ সম্বোধন করে। সেখানে রসদ জুগিয়েছে এই প্রতিবেদকের জাতীয় ফুটবল দলে খেলার অভিজ্ঞতা। দুই ফুটবলার গল্পে মজে গেলে সে আলোচনায় কোনো অস্বস্তি বা রাখঢাক থাকার কথা নয়। থাকলও না। ১১ মাস বয়সী একমাত্র মেয়ে এনাইয়া দেওয়ান চৌধুরীকে কোলে বসিয়ে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এ ফুটবলার খেলার ছলে কখনো বাংলাদেশ নিয়ে নিজের কৌতূহল মেটালেন, আবার মন খুলে দিয়ে গেলেন প্রশ্নের জবাবও।
সেই গল্প সিলেট হবিগঞ্জের দেওয়ানবাড়ি থেকে শুরু করে ইংল্যান্ডের লেস্টার সিটি ঘুরে এসে থেমেছে আলোর পথ খোঁজা বাংলাদেশের ফুটবলের অন্ধকার গলিতে। সেই অন্ধকারে কি একটু আলোর দিশা দিলেন হামজা? কী কৌতূহল জাগছে, হামজা বাংলাদেশের হয়ে খেলবেন কি না? তাই তো! শুরুতেই কৌতূহল না মিটিয়ে সে কথায় আসছি একটু পরে।
এর আগে জেনে নিই ২১ বছর বয়সী এই বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ফুটবলারের ইংলিশ ফুটবলে রাজ করার সারাংশ। ২০১৫-১৬ মৌসুমে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে চ্যাম্পিয়ন হওয়া লেস্টার সিটিতে এখন নিয়মিত একাদশে দেখা যায় হামজাকে। দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে জায়গা করে নিয়েছেন ইংল্যান্ড অনূর্ধ্ব-২১ দলে। অনূর্ধ্ব-২১ ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপে খেলে ইতালি থেকে বাসায় ফিরেছেন সোমবারই। ঝাঁকড়া চুলের হামজা এখন ইংলিশ যুব দলের গুরুত্বপূর্ণ মিডফিল্ডার। ৪-৩-৩ ফরমেশনে হোল্ডিং মিডফিল্ডার পজিশনে খেলে থাকেন। অনূর্ধ্ব-২১ দলে খেলা মানে মূল জাতীয় দল থেকে এক পা দূরে দাঁড়িয়ে আছেন ‘বাংলাদেশের’ হামজা।
হ্যাঁ বাংলাদেশেরই তো! জন্ম বাংলাদেশে না হলেও বাঙালি পরিবারে জন্ম হওয়ার সুবাদে বাংলার আলো–বাতাস সঙ্গী করে বড় হয়েছেন। বাংলাদেশে তাঁদের বাড়ি হবিগঞ্জের বাহুবল থানার স্নানঘাট গ্রামে। ছয় মাস বয়স থেকে পরিবারের সঙ্গে বাংলাদেশে যাতায়াত শুরু হয় হামজার। তাঁর দেওয়া তথ্যমতে, বাংলাদেশে আসা হয়েছে ২০ বারের মতো। সর্বশেষ এসেছিলেন চার বছর আগে। পেশাদার খেলোয়াড় হিসেবে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার পর চাপ বেড়ে যাওয়ায় আপাতত বাংলাদেশে আসা-যাওয়া কম। তবে হামজা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, তিনি বাংলাদেশি, ‘আমি বাঙালি। আমার আব্বা-আম্মা বাংলাদেশের। ২০ বারের বেশি বাংলাদেশে গেছি। গ্রামে কাদার মধ্যে ফুটবল খেলেছি। ইংল্যান্ডে নিজের বাড়িতে সব সময় বাংলাতেই কথা বলি।’
বাঙালি পরিবারের সন্তান হওয়ার কারণেই হামজাকে নিয়ে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমে খুব মাতামাতি। অবশ্য এর অনেক কারণের একটি তাঁর ঝাঁকড়া চুল। যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশিদের অগ্রযাত্রায় নতুন অধ্যায়ের সূচনা করা এই তরুণ নিজের বাঙালি পরিচয় নিয়ে গর্ববোধ করেন। যে কারণে পাশ্চাত্য ফুটবলের রঙিন দুনিয়ায় বাংলাদেশের নামটিও বারবার উচ্চারিত হচ্ছে হামজার সঙ্গে। আর তিনিও পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুন না কেন বাংলাদেশের খবর ঠিকই রাখেন। নিজে ফুটবলার হলে কী হবে, দেশের ক্রিকেটের খোঁজ খবরও রাখেন নিয়মিত।
ইংল্যান্ডে যখন বিশ্বকাপ চলছে, হামজা তখন অনূর্ধ্ব-২১ ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ খেলতে ছিলেন ইতালিতে। ইউরোপসেরা টুর্নামেন্টের মাঝেও হামজার মগজে ঘুরে বেরিয়েছেন সাকিব আল হাসান, মাশরাফি বিন মুর্তজারা। বাবা দিবস উপলক্ষে হামজা তাঁর বাবা দেওয়ান গোলাম মুর্শেদ চৌধুরীকে উপহার দিয়েছেন বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট ম্যাচের টিকিট। বাংলাদেশের সাকিব আল হাসানের দারুণ ভক্ত হামজা। বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারের কিছু পরিসংখ্যানও শুনিয়ে দিলেন! এই প্রতিবেদক ও সাকিব একই বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (বিকেএসপি) ছাত্র, সেই তথ্যটা জানালে ক্রিকেট নিয়েও আলোচনা হলো এক পশলা।
তবে সেই আলোচনা অবশ্যই ছাপিয়ে গেছে বাংলাদেশি ফুটবলের গল্পে। বাংলাদেশে জাতীয় দলের ম্যাচ তেমন দেখা হয় না হামজার। অবশ্য জাতীয় দল খেলেই থাকে কালেভদ্রে। সে ম্যাচগুলো ইউটিউবে মাঝেমধ্যে খুঁজে দেখার চেষ্টা তাঁর আছে। তবে জানা নেই জাতীয় দলের কোনো ফুটবলারের নাম। বর্তমান জাতীয় দলের অধিনায়ক ডেনমার্কপ্রবাসী জামাল ভূঁইয়ার প্রসঙ্গ তুলে করা হলো সেই কাঙ্ক্ষিত প্রশ্ন, বাংলাদেশ জাতীয় দলে আপনাকে দেখা যাবে কি না?
অবশ্য প্রশ্নটি করার আগে তাঁর প্রতি বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসার বার্তাটুকু পৌঁছে দেওয়া হয়। হামজার নাম উঠলেই যে দীর্ঘশ্বাস ওঠে ইশ্, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ছেলেটা যদি বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের হয়ে খেলতেন! কথাটি হামজার কানে দেওয়া মাত্রই, ‘বাংলাদেশের জার্সি পরে খেলতে পারলে আমার ভালা লাগত। বাংলাদেশের কথা মনে পড়ে সব সময়।’ হামজার গল্পটা এ আশা নিয়েই শেষ করা যেত যদি না বাস্তবের জমিনে পা রেখে বলতেন, ‘আমি এখন ইংল্যান্ড দলের হয়ে খেলার স্বপ্ন দেখি। যুব দলে যখন খেলছি, তখন জাতীয় দলের হয়েও খেলতে পারব।’
বাংলাদেশের জার্সিতে হামজাকে দেখা যাবে কি না, তা নিমেষেই ঢুকে পড়ল যদি-কিন্তুর গর্ভে। কিন্তু নিজেদের দায়িত্বটুকু কি করতে পেরেছেন বাংলাদেশ ফুটবলের কর্তাব্যক্তিরা? হামজাকে যে কখনো বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের পক্ষ থেকে দেওয়াই হয়নি লাল-সবুজ জার্সিতে খেলার প্রস্তাব।