১৯৭২ সালে ঢাকায় আসার পর দারুণ সমাদরই পেয়েছে মোহনবাগান
১৯৭২ সালে ঢাকায় আসার পর 
দারুণ সমাদরই পেয়েছে মোহনবাগান

৭ কোটি মানুষের জন্য ভালোবাসা নিয়ে ঢাকায় এসেছিল মোহনবাগান

দুই বাংলার ফুটবলপ্রেমীদের চোখ আজ কলকাতার সল্টলেক স্টেডিয়ামে। বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা সাতটায় এএফসি কাপে আবাহনী-মোহনবাগান লড়াই। সেই লড়াইয়ের উত্তাপ পদ্মা-গঙ্গার এপার-ওপারে। ঠিক এমন দিনে ফিরে ফিরে আসছে ৫০ বছর আগের স্মৃতি, যা বাংলাদেশের সত্তরের দশকের ফুটবলারদের মনে গেঁথে আছে আজও। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম যে বিদেশি দলটি খেলতে এসেছিল, তার নাম যে মোহনবাগান!

১৯৭২ সালে ১০ মে সকাল সাড়ে ১০টা। তেজগাঁও বিমানবন্দরের নামে ৩১ সদস্যের মোহনবাগান ফুটবল দল। বিমানবন্দরে অতিথি দলকে স্বাগত জানান ম্যাচের আয়োজক বাংলাদেশ ক্রীড়া নিয়ন্ত্রণ সংস্থার কর্মকর্তারা। অনেক খেলোয়াড়, ক্রীড়ামোদীর ভিড়ে ছিলেন তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ইউসুফ আলীও। বিপুল সংবর্ধনা জানানো হয় অতিথি দলকে।

বিমানবন্দরে নেমেই মোহনবাগানের ম্যানেজার করুণা ভট্টাচার্য বলেছিলেন, ‘আমরা বাংলাদেশের সাত কোটি মানুষের জন্য মৈত্রী, শুভেচ্ছা আর ভালোবাসা নিয়ে এসেছি।’ করুণা ভট্টাচার্য জানিয়েছিলেন, ১৯৩০ সালে আইএফএর হয়ে এক প্রীতি ম্যাচে অংশ নেওয়ার পর ৪২ বছরের মধ্যে সেবারই তাঁর প্রথম ঢাকায় আসা।

ভারতীয় ফুটবল দলের দুই সাবেক অধিনায়ক শৈলেন মান্না ও চুনী গোস্বামী এই দলের সঙ্গে কর্মকর্তা হিসেবে ঢাকায় আসেন। বিমানবন্দরে শৈলেন মান্না জানান, তিনি ঢাকায় সর্বশেষ আসেন ১৯ বছর আগে ১৯৫৩ সালে। সেই দলের অর্ধেকের বেশি খেলোয়াড়ের জন্মভূমি বাংলাদেশ। ময়মনসিংহে যাঁর পূর্বপুরুষের ভিটামাটি, সেই চুনী গোস্বামীর সেটিই ছিল প্রথমবার ঢাকায় আসা। (সূত্র-১১ মে, ১৯৭২, দৈনিক বাংলা)

স্বাধীন বাংলাদেশের অনানুষ্ঠানিক জাতীয় দলের প্রথম ম্যাচ, উন্মাদনা অনুমান করে নেওয়াই যায়!

মোহনবাগানের সেই ঐতিহাসিক দলটিতে ছিলেন তৎকালীন ভারত অধিনায়ক সৈয়দ নইমুদ্দিন, যিনি পরে বাংলাদেশে কোচিং করিয়েছেন দীর্ঘদিন। সেই সফরে ছিলেন পরিমল দে, প্রবণ গাঙ্গুলী, অশোক চ্যাটার্জি, টি বোস, মন্টু ঘোষ, সুভাষ ভৌমিকের মতো ফুটবলাররা। খেলা ছেড়ে পরে ভারতের ফুটবলে কোচিংয়েও আলো ছড়ানো সুভাষ ভৌমিক সম্প্রতি চলে গেছেন না-ফেরার দেশে।

ঢাকা এসেই সেদিন বিকেলে ঢাকা স্টেডিয়ামে অনুশীলন করে মোহনবাগান। অনুশীলন শেষে দলের মূল অধিনায়ক ভবানী রায় সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, তিনি নিজে পুরো সুস্থ না থাকায় ঢাকায় কোনো ম্যাচেই খেলবেন না। এ-ও বলেছিলেন, ঢাকা স্টেডিয়াম তাঁর খুব পছন্দ হয়েছে।

কথা ছিল, এ সফরে কলকাতার দলটি ‘গোষ্ঠপাল একাদশ’ নামে দুটি প্রীতি ম্যাচ খেলবে। কারণ, তখনো বাংলাদেশ ফিফার সদস্য হয়নি। ফলে মোহনবাগান নাম নিয়ে খেলার উদ্যোগে জটিলতা দেখা দেয়। তবে ঢাকায় আসার ঠিক আগে মোহনবাগান নামেই ঢাকায় প্রীতি ম্যাচ খেলার অনুমতি তারা পেয়েছে ফিফার কাছ থেকে।

১১ মে ১৯৭২। অবশেষে এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। বাংলাদেশের ফুটবলে সোনার অক্ষরে লেখা একটি দিন। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের ফুটবলাররা এই প্রথম কোনো বিদেশি দলের সঙ্গে খেলার স্বাদ পেলেন। ঢাকায় প্রথম প্রীতি ম্যাচে মাঠে নামে ১৮৮৯ সালে প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যবাহী মোহনবাগান। প্রতিপক্ষ ছিল বাংলাদেশের প্রথম স্বাধীনতা দিবস শিল্ড বিজয়ী ঢাকা মোহামেডান। ঢাকা স্টেডিয়ামে ম্যাচের আগে টস করেন মোহনবাগানের অধিনায়ক পি গাঙ্গুলী ও মোহামেডানের অধিনায়ক জাকারিয়া পিন্টু। পরদিন সেই টসের ছবি ছাপা হয় তৎকালীন পত্রিকা দৈনিক বাংলার প্রথম পাতায়।

গ্যালারি ঠাসা ছিল দর্শকে

মোহনবাগান ম্যাচে ১১টি কর্নার পেয়েছিল। কিন্তু গোল তারা পাচ্ছিল না। গোলের চেষ্টা করছিল মোহামেডানও। প্রথমার্ধের তুলনায় দ্বিতীয়ার্ধে সাদাকালোরা সুযোগ তৈরি করেছে বেশি। এর মধ্যে গোলাম সারোয়ার টিপু ও কাজী সালাউদ্দিন দুটি ভালো সুযোগ তৈরি করেছিলেন। তবে এই অর্ধে কাজের কাজটি করেছে মোহনবাগান। ফরোয়ার্ড অশোক চ্যাটার্জির গোলে তারা জেতে ম্যাচটি (১-০)।

পরদিন মর্নিং নিউজ পত্রিকার প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘মোহনবাগান স্ন্যাপ গোল ভিক্টরি ওভার মোহামেডান’। দৈনিক বাংলার প্রতিবেদনে লেখা হয়, ‘জৌলুশ ও দর্শকের ব্যাপক উৎসাহ থাকা সত্ত্বেও খেলোয়াড়েরা খেলাটিকে আকর্ষণীয় করে তুলতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। ম্যাচটি তাই একরকম প্রাণহীন ছিল। মোহনবাগান দল সম্পর্কে দর্শকদের যে বিপুল উচ্চাশা ছিল, সেটা ম্যাচে পূরণ হয়নি।’

ম্যাচে কোনো সৌজন্য টিকিট রাখা হয়নি। কারণ, এ ম্যাচ আয়োজনের উদ্দেশ্য ছিল প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে সহায়তা করা। টিকিটের মূল্য ছিল পূর্ব দিকের গ্যালারি ১ টাকা, পশ্চিম দিকে ২ টাকা। ৩৫ হাজারের বেশি দর্শক সেদিন হয়েছিল ঢাকা স্টেডিয়ামে। ম্যাচের উদ্বোধন করেন তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ইউসুফ আলী। ঐতিহাসিক এ ম্যাচের শুরুতে ও বিরতির সময় দর্শকদের জন্য বাড়তি পাওনা ছিল ব্যান্ড পার্টির বাদ্যবাজনা।

মোহনবাগানের সেই দলে ছিলেন আটজন আন্তর্জাতিক মানের ফুটবলার। তবে নজর কাড়েন শুধু অশোক চ্যাটার্জি, এস সেন গুপ্ত, এস ঘোষ, দস্তিদার, সি গুপ্ত। রক্ষণে ভালো খেলেন নিমাহ গোস্বামী ও বি মিত্র। মোহামেডানের কায়কোবাদ, আইনুল, নান্নু ছাড়া অন্যরা আলো ছড়াতে পারেননি। মঈন, হাফিজ, শামসুরা ছিলেন ব্যর্থ। অন্তত পরদিনের পত্রপত্রিকায় ম্যাচের প্রতিবেদনে তেমনই লেখা।

এটা ছিল দুর্দান্ত এক গোল
মোহনবাগানের বিপক্ষে দ্বিতীয় ম্যাচে সালাউদ্দিনের গোলে মুগ্ধতা মোহনবাগানের সে দলের তারকা চুনী গোস্বামী

সেই ম্যাচে মোহামেডানের ফরোয়ার্ড গোলাম সারোয়ার টিপু ৫০ বছর পেছনে ফিরে বলছিলেন, ‘প্রীতি ম্যাচ হওয়ায় খুনে মনোভাব ছিল না কোনো পক্ষেরই। মনে আছে, আমাদের ডিফেন্ডার জহির ভাই মোহনবাগানের লেফট উইংগার প্রবণ গাঙ্গুলীকে বাজেভাবে ট্যাকল করেন। প্রণব সম্ভবত আর খেলতেই পারেনি এ সফরে। ঘটনাটা মনে আছে। কারণ, ম্যাচের পর এ নিয়ে মোহামেডান ক্লাবে কথাবার্তা হয়েছিল। ম্যাচের পর মোহনবাগানকে সংবর্ধনা দিয়েছিল মোহামেডান। চুনী গোস্বামী খুব সুন্দর বক্তব্য রেখেছিল কয়েক মিনিটের।’

গোলাম সারোয়ার টিপু যোগ করেন, ‘মনে পড়ছে, মোহনবাগানের সুরজিত সেন গুপ্তু তখন একেবারেই তরুণ। সে একটা বল সুন্দরবাভে নিয়েছে আমাদের দু-তিনজনকে কাটিয়ে। পরে আমরা ক্লাবে বলাবলি করি, এই ছেলে অনেক দিন খেলবে। পরে সে ভারত দলে খেলেছে বেশ কয়েক বছর। চুনী গোস্বামী দ্বিতীয় ম্যাচে সম্ভবত অল্প কয়েক মিনিটি খেলেছে। সেটা দর্শকদের আবদার মেটাতে। যা-ই হোক, মোহনবাগানের সেই সফরের কয়েক মাস পরই ইঙ্গবেঙ্গল আসে ঢাকায়।’

দুই দলে সেদিন যাঁরা খেলেছেন

মোহামেডান: ননী, জহির, পিন্টু (অধিনায়ক), আইনুল, নান্নু, মঈন, কায়কোবাদ, আমিনুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন হাফিজ উদ্দিন, সালাউদ্দিন ও টিপু।

বেঞ্চ: ইকবাল, বাদল, শামসু, আনসার, মাহমুদ ও দীপু।

মোহনবাগান: তরুণ বোস, দিলিপ করাল, এস ঘোষ, নিমাই গোস্বামী, শংকর ব্যানার্জি, শ্যামসুন্দর মান্না, বি মিত্র, এস সেনগুপ্ত, সুভাষ ভৌমিক (অশোক চ্যাটার্জি/এস ঘোষ দস্তিদার) ও অধিনায়ক প্রবণ গাঙ্গুলী (সি গুপ্ত)।

কোচ: এস সোম । ট্রেইনার: এ চক্রবর্তী ।

দ্বিতীয় ম্যাচের নায়ক সালাউদ্দিন

১৩ মে ১৯৭২। শনিবার, বিকেল সাড়ে চারটা। দ্বিতীয় প্রীতি ম্যাচে ঢাকা একাদশ নামে মোহনবাগানের বিপক্ষে খেলেছে আসলে বাংলাদেশের নির্বাচিত সেরা একাদশ। সেটিই ছিল তখনকার অলিখিত বাংলাদেশ জাতীয় দল। ম্যাচ শুরুর আগে দুই দলের খেলোয়াড়দের সঙ্গে পরিচিত হন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুকে হতাশ করেননি ঘরের ছেলেরা।

১-০ গোলে জিতল ঢাকা একাদশ। কোনো বিদেশি দলের বিপক্ষে এটিই বাংলাদেশের অনানুষ্ঠানিক জাতীয় দলের প্রথম জয়। ৬৮ মিনিটে তরুণ ফরোয়ার্ড কাজী সালাউদ্দিন ঢাকা একাদশের গোলটি করেন। সেই গোল নিয়ে উচ্ছ্বসিত চুনী গোস্বামী ম্যাচ শেষে বলেছিলেন, ‘এটা ছিল দুর্দান্ত এক গোল।’ মোহনবাগানের দলনেতা বলেন, ‘আমার দেখা অন্যতম সেরা গোল এটি।’

দ্বিতীয় ম্যাচে দারুণ গোলে বাংলাদেশকে জিতিয়ে নায়ক বনে যান সালাউদ্দিন

ওই গোল নিয়ে স্মৃতিচারণায় সালাউদ্দিন বলেন, ‘মাঝমাঠে ফাউল পেলাম আমরা। তারপর কায়কোবাদ সেন্টার করলে আমি বলের গতিপথ অনুসরণ করলাম। মোহনবাগানের দুই ডিফেন্ডার আসছিল। বল বাতাসে রেখেই সাইড ভলিতে দ্বিতীয় পোস্ট দিয়ে জালে। ওই গোল আমার জীবনই পাল্টে দিল।’

কতটা পাল্টে দিল, তা শোনা যাক সেই ম্যাচের আরেক খেলোয়াড় গোলাম সারোয়ার টিপুর মুখে, ‘ওই গোল করেই সালাউদ্দিন আসলে সালাউদ্দিন হওয়ার পথে পা বাড়াল। পরদিন দৈনিক বাংলায় কামরুজ্জামান ভাই লিখলেন, ‘‘সালাউদ্দিন বাংলাদেশের ফুটবলকে ভরসা দিল।’’ পরের দিন বাংলাদেশ অবজারভারের ম্যাচ রিপোর্টের শিরোনাম হয় “ঢাকা হিরোজ হাম্বল মোহনবাগান”। নায়ক পুরো দলের সবাই, তার মধ্যেও ‘নায়কদের নায়ক’ তরুণ ফরোয়ার্ড কাজী সালাউদ্দিন।

৫০ বছর পর আজ যখন কলকাতার মাঠে মোহনবাগানের সঙ্গে লড়ছে ঢাকা আবাহনী, এ ম্যাচে নায়ক হবেন কে? দানিয়েল কলিনদ্রেস, রাফায়েল আগুস্তো, নাবিব নেওয়াজ, নাকি অন্য কেউ?

সেদিনের ম্যাচে ঢাকা একাদশ: সান্টু, হাকিম, নাজির, পিন্টু, আইনুল, আলী ইমাম, ভুট্টো, এনায়েত, সালাউদ্দিন, নওশের, টিপু।

বদলি: কায়কোবাদ, শরফুদ্দিন, গফুর।

মোহনবাগান: পি মিত্র, ডি কোভেল, এস ব্যানার্জি, এন গোস্বামী, নইমুদ্দিন, এস মান্না, এস সেনগুপ্ত, পি দে, এস ঘোষ দস্তিদার, বি মিত্র, নাজির।

বদলি: টি বোস, পি মজুমদার, চ্যাটার্জি, চুনী গোস্বামী।

রেফারি: জেড আলম

সহকারী: মহিউদ্দিন চৌধুরী ও কোরেইশি