২ এপ্রিল, ১৯৮৫ সাল থেকে ১ জুন ২০২২। মাঝখানে পেরিয়েছে ৩৭টি বছর। কালের হিসাবে বিরাট এক সময়। আর সেই সময়ের দূরত্ব পেরিয়ে আজ বাংলাদেশের ফুটবল পেছনে ফিরে তাকাচ্ছে ১৯৮৫ সালের সেই দিনটিতে, যেদিন ইন্দোনেশিয়ার বিপক্ষে এসেছিল প্রথম জয়টি।
বলা হয়, মঙ্গলে নাকি অমঙ্গল হয়। কিন্তু ১৯৮৫ সালের ২ এপ্রিল মঙ্গলবার দিনটা মঙ্গলময়ই হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশের ফুটবল অঙ্গনে। তৎকালীন ঢাকা স্টেডিয়ামের কানায় কানায় পরিপূর্ণ গ্যালারির সামনে লাল–সবুজের সমর্থকেরা সাক্ষী হয়েছিলেন বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে বাংলাদেশের প্রথম জয়ের। সেই জয়টিই আসে ইন্দোনেশিয়ার বিপক্ষে।
ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে ফুটবল মাঠে বাংলাদেশের প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ২৯ জুলাই মারদেকা টুর্নামেন্টে। বাংলাদেশ হেরে যায় ৪-০ গোলে। এরপর ১৯৮৪ সালের ১০ আগস্ট, ইন্দোনেশিয়া জেতে ২-১ গোলে। ১৯৮৫ সালের ১৮ মার্চ বিশ্বকাপ বাছাইয়ের প্রথম লেগে জাকার্তায় ২-০ জয় স্বাগতিক ইন্দোনেশিয়ার। তারপরই ফিরতি ম্যাচে জেতে বাংলাদেশ। সর্বশেষ সাক্ষাৎ ২০০৮ সালে মারদেকায় (১-২)। দুই দলের ৬ সাক্ষাতে ইন্দোনেশিয়ার জয় ৪। ১ জয় বাংলাদেশের, ১ ড্র।
বান্দুংয়ে আজ দুই দল সপ্তমবারের মতো মুখোমুখি হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৭টায় দুই দলের এই ফিফা আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচটির আগে ফিরে ফিরে আসছে ১৯৮৫ সালের ২ এপ্রিল। ইন্দোনেশিয়ার বিপক্ষে বাংলাদেশের সেই একমাত্র জয়ের সুখস্মৃতিটা বারবার টোকা দিচ্ছে স্মৃতির দরজায়।
সেদিন ঢাকা স্টেডিয়ামে ইন্দোনেশিয়া প্রথমে গোল করেছিল। কিন্তু ঘরের ছেলেরা ঘুরে দাঁড়ান গোল খেয়ে। গোল শোধ হলো, গোল করলেন ঢাকা মাঠের উঠতি এক ফুটবলার। মাত্রই রহমতগঞ্জে খেলে ১৯৮৪ সালে নেপালে প্রথম সাফ গেমসে যিনি জাতীয় দলে জায়গা করে নেন।
পরের বছরই ১৯৮৫ সালে সেই তিনি ঢাকার মাঠে করলেন নিজের প্রথম আন্তর্জাতিক গোল। আর সেই গোলই তাঁকে ‘কায়সার হামিদ’ হিসেবে চেনাতে শুরু করে। তারপর তো লম্বা ভ্রমণ। কায়সার হামিদ হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসে অন্যতম সেরা ডিফেন্ডার। যিনি শুধু গোল আটকাতেন না, গোল করতেনও।
কায়সারকে ৩৭ বছর পেছনে ফিরিয়ে নিলে নস্টালজিক হয়ে খুলে দিলেন স্মৃতির ঝাঁপি, ‘ইন্দোনেশিয়ার বিপক্ষে ১-১ করা আমার সেই গোলটি ছিল ঢাকা মাঠে আমার আন্তর্জাতিক অভিষেক গোল। শুধু তা–ই নয়, সেটিই ঢাকার মাঠে আমার প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচও। ইন্দোনেশিয়া গোল করেছিল সেদিন প্রথমে, আমার গোলটি এসেছিল হেডে, সম্ভবত কর্নারে... ঠিক মনে নেই।’
কায়সারের কণ্ঠে এরপর আত্মতৃপ্তির সুর, ‘ওই ম্যাচ দিয়েই আসলে লোকে আমাকে চেনা শুরু করল। তখন আমি রহমতগঞ্জে খেলি। পুরান ঢাকার এই দলে খেলেই ১৯৮৪ সালে নেপালে প্রথম সাফ গেমসে জাতীয় দলের জার্সিতে। গেমসে আমার গোলও আছে। তবে ঢাকার মাঠে নিজের প্রথম আন্তর্জাতিক গোলটা আমাকে পরিচিতি দিয়েছে। আমি “কায়সার হামিদ” হয়ে উঠতে শুরু করলাম।’
কায়সারের গোলে ১-১ হওয়ার পর দুই দলই ঝাঁপাল দ্বিতীয় গোলের জন্য। তাতে সফল স্বাগতিক বাংলাদেশ। গোলটা এসেছিল দারুণ এক ফ্রিকিকে। গোলদাতা? আশরাফ উদ্দিন আহমেদ চুন্নু। আজ এত বছর পরও সেই গোলটার বর্ণনা যেন মুখস্থ তাঁর কাছে।
স্মৃতির দুয়ার খুলে ভেতরে প্রবেশ করে চুন্নু বলছেন, ‘সেবার বিশ্বকাপ বাছাইয়ে প্রথম ম্যাচে ইন্দোনেশিয়ায় আমরা ১-০ গোলে হেরে আসি। ঢাকায় ফিরতি ম্যাচে ২-১ গোলে জিতলাম। মনে আছে, ইন্দোনেশিয়ার ডি বক্সের ৮-১০ গজ দূর থেকে বাঁকানো এক ফ্রিকিকে গোলটা করেছিলাম। গোল করার পর দেখি স্টেডিয়ামজুড়ে সে কী আনন্দ! দারুণএক দৃশ্য। দারুণ এক স্মৃতি।’
চুন্নু কখনো ভুলবেন না দিনটির কথা। সেটি শুধু নিজে গোল করে বাংলাদেশকে জিতিয়েছেন বলে নয়। স্টেডিয়ামের পরিবেশ তাঁকে বেশি টেনেছে। মাঠে এসেই দেখে দর্শকের ঢল। তারপর? এক নিশ্বাসে চুন্নু বলে চলেন, ‘মনে হয় সেদিন গোটা বাংলাদেশের চোখই ছিল ঢাকা স্টেডিয়ামে। আমার গোলের পর দর্শকেরা শেষ বাঁশির অপেক্ষায় ছিল। কিছু সময় বাদে বাজল শেষ বাঁশি। আহা, সে কী উচ্ছ্বাস সবার মধ্যে! না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।’
বিশ্বকাপ বাছাইয়ের ওটাই বাংলাদেশের প্রথম জয় বলে চুন্নু আনন্দটা বেড়ে যায় কয়েক গুণ। আজ ভাবতে তাঁর দারুণ লাগছে যে সেই দলের গর্বিত সদস্য ছিলেন। নিজেই বলেন, ‘তখন বাংলাদেশ জাতীয় দল মাঠে নামলে লোকে তাকিয়ে থাকত কেমন খেলে সেটি দেখার জন্য। খেলা নিয়ে আলোচনা হতো সারক্ষণ। এসবই আমাদের কাছে ছিল বাড়তি প্রেরণা।’
ইন্দোনেশিয়ার বিপক্ষে সেই জয়ী দলের গর্বিত সদস্য আশীষ ভদ্র, খোরশেদ বাবুল, আবদুল সালাম, ইলিয়াস হোসেন, ওয়াসিম ইকবাল, জসিম উদ্দিন জোসী, মোহাম্মদ মহসীন, স্বপন দাস, আজমত আলীরা। তাঁদের স্মৃতিতেও কি ৩৭ বছর আগের ম্যাচটা মনে পড়ে? প্রত্যেকেরই মনে পড়ে। হয়তো তাঁরা আজ আর ফুটবলে নিত্যদিনের খোঁজ রাখতে পারেন না। কিন্তু কোনো একটা ম্যাচের সূত্র ধরিয়ে দিলে গড়গড় করে বলতে থাকেন সবকিছু।
ব্রাদার্সের তৎকালীন মিডফিল্ডার আবদুল সালাম যেমন বললেন, ‘ইন্দোনেশিয়াকে সেদিন আমরা হারিয়েছিলাম দৃঢ় প্রতিজ্ঞায়। গোল খেলেও আমরা ভেঙে পড়িনি। আমাদের মধ্যে একটা জেদ ছিল, দেশের মাটিতে কিছু করব। সেটিই আমরা করতে পেরেছিলাম। ভাবতে ভালো লাগছে যে আমরা সেদিন জিতেছিলাম।’
২০০৮ সালের পর ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে আজ আরেকটি ম্যাচ। ইন্দোনেশিয়াকে হারানো সম্ভব তাদেরই মাঠে? অনেক কঠিন। কারণ, ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে দুই দলের মধ্যে পার্থক্য ২৯ ধাপ। ইন্দোনেশিয়া ১৫৯, বাংলাদেশ ১৮৮। তা ছাড়া বাংলাদেশ দল এখন চোট জর্জর। ফলে কোচ হাভিয়ের কাবরেরা কোনো মতে ম্যাচটা পার করতে পারলেই যেন বাঁচেন। অন্যদিকে ইন্দোনেশিয়া আছে ফুরফুরে মেজাজে। তাদের কোচ এমন একজন, যিনি ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপে ছিলেন দক্ষিণ কোরিয়ার কোচ। অর্থাৎ আজ জামাল ভূঁইয়াদের প্রতিপক্ষ রাশিয়া বিশ্বকাপের কোচ শিন তায়ে ইয়ংও।
তা হোক, কায়সার হামিদ লড়াই চান। বলছেন, ‘ইন্দোনেশিয়া এখন অনেক পেশাদার দল। সে দেশের ঘরোয়া লিগ জমজমাট হয় অনেক। অনেক ভালো ভালো বিদেশি খেলে। সুতরাং তাদের সঙ্গে তাদেরই মাঠে ভালো কিছু করা বাংলাদেশের জন্য একটা চ্যালেঞ্জেই। তারপরও লড়াই করতে হবে। চেষ্টার কোনো বিকল্প নেই।’
ইন্দোনেশিয়কে ৩৭ বছর আগে হারানোর সেই নায়ক আশরাফ উদ্দিন আহমেদ আজ জামাল ভূঁইয়াদের দিচ্ছেন একটা টোটকা, ‘নিজের ওপর বিশ্বাস রেখে খেলতে হবে। হারের আগেই হার হার। তাহলে হয়তো ভালো কিছু হলেও হতে পারে।’
সেই আশাতেই আছে দেশের ফুটবল অঙ্গন।