১৮০ টাকা বেতন থেকেই বাংলাদেশের ফুটবলের কিংবদন্তি

মোহামেডানের বাদল রায় হিসেবেই তিনি উজ্জল ফুটবলপ্রেমীদের হৃদয়ে।
ছবি: সংগৃহীত

উঠতি বয়সে কুমিল্লা সুতাকলের জার্সিতে খেলতে খেলতেই তিনি হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের ফুটবলের এক কিংবদন্তি। সুতাকলে বেতন পেতেন ১৮০ টাকা। সত্তর দশকের মাঝামাঝি এই টাকা তখন অনেক। ঈদের সময় মিলের কর্মীদের সঙ্গে বাদল রায়ও উৎসব ভাতা পেতেন। বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা, খাওয়াদাওয়া চলত সেই টাকায়। আনন্দময় কৈশোর পেরিয়ে তারুণ্যের সিঁড়িতে পা রাখতেই ডাক এল চট্টগ্রাম কাস্টমস থেকে। চলে গেলেন চট্টগ্রামে খেলতে।

সেই যে খেলার নেশায় বাড়ি ছাড়েন, তারপর ঢাকার মাঠ কাঁপানো শুরু। বাদল রায় হয়ে ওঠেন ‘বাদল রায়’। গতকাল বিকেলে তিনি স্মৃতির পাতায় ঠাঁই নিয়েছেন। লিভার ক্যানসারের কাছে হার মেনে ৬২ বছর বয়সে চলে গেছেন না–ফেরার দেশে। আজ রাজধানীর সবুজবাগ কালীমন্দির শ্মশানে দাহ করা হবে তাঁর নশ্বর দেহ। পেছনে পড়ে থাকবে ফুটবল নিয়ে তাঁর ভালোবাসার নানা গল্প। আশির দশকে দেশের ফুটবল নষ্টালজিয়ার অন্যতম প্রিয় মুখ হয়ে তিনি বেঁচে থাকবেন চিরকাল।

বাদল রায় শুধু একটি নাম নয়, একজন সুন্দর-রুচিমান মানুষের প্রতিচ্ছবিও। বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে এমন ব্যক্তিত্ব কমই এসেছে। কর্মে ছিলেন সৎ। মনেও ছিলেন সৎ। ফুটবলের উন্নয়নে নিরলস কাজ করেছেন। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের ৩ বারের নির্বাচিত সহসভাপতি ছিলেন। অনিয়ম দেখলে প্রতিবাদে ফেটে পড়েছেন। অসুস্থ শরীর নিয়েও বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি পদে প্রার্থী হয়েছেন এই ভেবে যে কাউকে বিনা চ্যালেঞ্জে পার পেতে দেবেন না। সেই মানুষটির প্রয়াণে দেশের ক্রীড়াঙ্গন আজ শোকে মুহ্যমান।

রায় বংশে চাকরির প্রতি ঝোঁকটা ছিল কমই। তবে চট্টগ্রাম কাস্টমসে খেলা, কাস্টমস হাউসে থাকার সুবাদে চাকরির একটা আবহ সেই সত্তরের মাঝামাঝি রায় পরিবারে আমদানি করেছিলেন বাদল। ১৯৭৬ সালে তিনি চট্টগ্রামে খেলেন। একই বছর কুমিল্লার সুতাকলের হয়েও খেলেছেন। ওই বছর কুমিল্লা দ্বিতীয় বিভাগ ফুটবলে তাঁকে নাকি জোর করে খেলানো হয়। কীভাবে?

বেঁচে থাকতে সে নিয়ে গল্পে মেতেছিলেন বাদল রায়। এই প্রতিবেদককে বলেছিলেন, ‘সে এক গল্প। কুমিল্লা দ্বিতীয় বিভাগের হয়ে প্রথম ম্যাচ আমার। কিন্তু আমি তো খেলব না। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়ার সুবাদে দাউদকান্দি ছেড়ে শহরে থাকি। শহরে এক জায়গায় লুকিয়ে থাকলাম। কারণ, স্টেডিয়ামে এত মানুষের সামনে খেলতে আমার ভয় লাগছিল। যা–ই হোক, কুমিল্লা সড়ক ও জনপথ বিভাগের ক্লাব দলের কর্মকর্তা হক ভাই তৃতীয় ম্যাচের দিন আমাকে খুঁজে বের করে মাঠে নামান। সেদিন খেলতে নামি তুমুল বৃষ্টির মধ্যে। আমি হ্যাটট্রিক করে বসলাম।’

১৯৮২ দিল্লি এশিয়াডে মালয়েশিয়ার বিপক্ষে বাদল রায়ের জয়সূচক গোল।

স্মৃতিতে ডুব দিয়ে বাদল রায় যোগ করেছিলেন, ‘কুমিল্লা দ্বিতীয় বিভাগ লিগে দারুণ সাফল্য দেখিয়ে আমাদের দল চ্যাম্পিয়ন হলো। আমরা বন্ধুরা মিলে কুমিল্লার রসমলাই খাওয়ার আয়োজন করলাম।’ সেই রসমলাই খেতে খেতেই জীবনে বাঁক বদলের অলিখিত চিঠি এসে গেল তরুণ বাদল রায়ের জীবনে। তিনি বলেছিলেন, ‘রসমলাই খাওয়ার মাঝপথে ভাণু দা (মোহামেডানের সাবেক ফুটবলার প্রণব কুমার) এসে বললেন, “ঢাকা থেকে এক ভদ্রলোক এসেছেন। তোমাকে মোহামেডানে যেতে বলেছে”।’ এভাবে ঢাকার সাদা–কালো দলে নাম লেখানোর দরজা খুলে যায় নবীন বাদল রায়ের সামনে।

সালটা ১৯৭৭। বাদল প্রথম এলেন ঢাকায় মোহামেডান তাঁবুতে। তখন সাদা–কালোর তাঁবু বায়তুল মোকাররম মসজিদের ঠিক পাশেই। এই ক্লাবই তাঁর জীবনের বড় একটা পরিচয় হয়ে আছে। ১৯৭৭ সালে ঘরোয়া ফুটবলে মোহামেডানের ফল খারাপ হলো। কর্মকর্তারা ঢাকার বাইরে প্রতিভা খুঁজতে থাকেন। সেই প্রতিভা হয়েই কুমিল্লা থেকে বাদলের মোহামেডানে আসা। একই সময়ে রংপুর থেকে আসেন তরুণ মোসাব্বের। গাফফার আসেন ১৯৮০ সালে। যা–ই হোক, সেদিন রসমলাই খেতে খেতে মোহামেডান থেকে ডাক আসার খবর শুনে কিছুক্ষণ ঝিম ধরে রইলেন তরুণ বাদল। মাত্রই উচ্চমাধ্যমিক পাস করা তরুণের চোখে ভাসতে শুরু করে ঢাকায় আসার স্বপ্ন।

১৯৮৫ সালে জাতীয় দলের জার্সিতে (দাঁড়ানো বাঁ দিক দিয়ে দ্বিতীয়)

বাদল রায় শুরুতেই পেয়ে যান লিফট। দ্রুতই উঠতে থাকেন ওপরে। ১৯৭৭ সালে আগাখান গোল্ডকাপে মোহামেডানের জার্সিতে অভিষেক হলো। মোসাব্বেরেরও অভিষেক একই সঙ্গে। তারুণ্যের জোড়া আবাহনে মোহামেডান পেল নতুন শক্তি, নতুন প্রাণ। ক্লাব কর্মকর্তাদের কাছে বাদল-মোসাব্বের যেন বিবৃতি পাঠান, ‘আমরা আসছি।’ মোসাব্বের শুরুতেই মাত করে দিলেন। আগাখান গোল্ডকাপে অলিখিত ভারতীয় জাতীয় দলের বিপক্ষে দারুণ খেলেন। প্রতিপক্ষের অন্যতম সেরা ডিফেন্ডার গুরুদেব সিংকে ডজ দিয়ে গোল করে চারপাশ মাতিয়ে তোলেন মোসাব্বের। বাদল-মোসাব্বেরে উজ্জীবিত হলো মোহামেডান। সাদা–কালো কর্তাদের ছিপ ফেলা বড়শিতে আটকে গেলেন বাদল। তারপর ‘কুমিল্লা-এক্সপ্রেস’ হয়ে ওঠার গল্প।

১৯৭৭-১৯৮৯। মোহামেডানে শুরু, মোহামেডানেই শেষ। অথচ কত প্রলোভন ছিল অর্থের! আবাহনী কম চেষ্টা করেনি। কিন্তু বাদল মোহামেডান ছাড়েননি। ১৯৭৯ সালে বিজেএমসি যেবার লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়, সেবার মৌসুম শুরুর আগে বিজেএমসির এক কর্মকর্তা বাদলকে ২০ হাজার টাকার চেক দেন। উদ্দেশ্য, বাদলকে বিজেএমসিতে নেওয়া। তখন মোহামেডান কর্মকর্তা মনিরুল হক চৌধুরী বিজেএমসির ওই কর্মকর্তাকে শাসিয়ে বলেছিলেন, ‘ পিটিয়ে আপনার হাড্ডি গুঁড়া করে দেব। বাদলকে টাকা দিয়েছেন কেন?’ পরদিনই বাদল সেই চেক ফেরত দেন। বিজএমসিতে যাওয়ার জন্য গোপনে মোহামেডান থেকে সরানো নিজের কাপড়চোপড়ও ফেরত আনেন ক্লাবে।

আমৃত্যু থেকেছেন ফুটবলের সঙ্গেই।

তার আগেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে পেলেন মৃত্তিকা বিজ্ঞান। কিন্তু এই বিষয়ে পড়াশোনা করতে হবে বেশি। তাই বিষয় পাল্টে চলে যান সমাজবিজ্ঞানে। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হলেও পরীক্ষার ব্যাপারে ‘মাফ’ ছিল না। এমনও হয়েছে, আগের দিন মোহামেডানের জার্সিতে মাঠে কোনো সাফল্য পেয়েছেন। গায়ে রং নিয়েই বসেছেন পরীক্ষা দিতে। তখন ঢাবিতে বাদল রায় মানে বিরাট তারকা। বন্ধুদের অনুরোধে ১৯৮০ সালে ডাকসুর ক্রীড়া সম্পাদক পদে প্রার্থী হয়ে জিতলেন। অথচ পায়ে অস্ত্রোপচার হয়েছে কিছুদিন আগেই। তা ছাড়া মোহামেডানে খেলার বিশাল চাপ। সব মিলেয়ে নির্বাচনী ঝামেলায় জড়াতে চাননি। ক্রীড়া সম্পাদক পদে বাদল রায়ের প্রতিপক্ষ ছিলেন চাঁদপুরের মুকুল, যিনি বিজেএমসিতে খেলেছেন। বাদলের মেয়ে ভক্ত ছিল বেশি। সে সময় শামসুন্নাহার হলে থাকতেন ব্যাডমিন্টন তারকা কামরুর নাহার ডানা। তাঁরা সবাই বাদলের পক্ষে কাজ করেন।

মজার ব্যাপার, নির্বাচনে প্রার্থী হতে বলার পর বাদল রায় চলে গেলেন আত্মগোপনে। অর্থাৎ তিনি প্রার্থী হবেন না। শেষমেশ বাধ্য হলেন এবং জিতলেন। বাদল রায় এমন একজন মানুষ, যিনি কোনো কিছু পাওয়ার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তেন না। ফুটবল ফেডারেশনের কর্মকর্তা হিসেবে বিদেশ যাওয়ার জন্য তাঁকে টিকিট দিলেও সেটি দেরাজে রেখে দিতেন। ২–১ বার এমনও হয়েছে টিকিট দেরাজেই পড়ে ছিল। বাদল রায় যাননি। তবে ১৯৯৯ সাফ গেমসে কাঠমান্ডু না গিয়ে পারেননি। সেবার বাংলাদেশ দলের অভ্যন্তরীণ গোলমাল মেটাতে ঢাকা থেকে যান তৎকালীন ফেডারেশনের যুগ্ম সম্পাদক বাদল রায়। গিয়ে দলকে প্রথমবার দক্ষিণ এশিয়ান গেমসে চ্যাম্পিয়ন করে আনেন। এই হলেন বাদল রায়।

তাঁর জীবনের গল্প লিখে শেষ করা যাবে না। মোহামেডানে এসেই তিনি উঠেছিলেন ভাণু দা, রামা লুসাই আর কালা গফুরের রুমে। কালা গফুর পাকিস্তানের বিখ্যাত ফুটবলার। ফুটবল ক্যারিয়ারে তাঁর তখন শেষ সময়। নবীন বাদলকে মোহামেডানে প্রথম দেখে নাকি অবাক হয়ে বলেছিলেন, ‘ইয়ে লাড়কা কেয়া খেলে গা।’ বাদল মুখে নয় মাঠে নিজেকে চেনান। ’৮১ সালেই পেয়ে যান ১০ নম্বর জার্সি। যে জার্সি বাদলের আগে ছিল বিখ্যাত এনায়েতুর রহমান খানের গায়ে। সব সময়ই সুদর্শন বাদল রায় বলতেন, ‘এনায়েত ভাইয়ের মতো ফুটবলারের সঙ্গে খেলার স্বাদ পেয়ে আমি ধন্য।’

আর বাদল রায়কে পেয়ে ধন্যবাদ দেশের ফুটবল। গোটা ক্রীড়াঙ্গনও। আজ শেষবারের মতো প্রিয় ফুটবল আঙিনায় তিনি এসেছেন কফিনে শুয়ে। তাঁর মরদেহ নেওয়া হয়েছে মোহামেডান ক্লাবে। তারপর যাবে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে। শারীরিকভাবে হয়তো আজই পৃথিবীতে তাঁর শেষ দিন। কিন্তু বাদল রায় থাকবেন চিরকাল। তাঁর অমর স্মৃতির প্রতি রইল শ্রদ্ধাঞ্জলি।