‘ফুটবলে রাতারাতি উন্নয়ন সম্ভব নয়।’
কাজী সালাউদ্দিন কথাটা বললেন ১২ বছর পর এসে। এমন একটা সময় তা বললেন, যখন তিনি চতুর্থবারের মতো বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) সভাপতির আসনে বসার অপেক্ষায়, যখন বাফুফে সভাপতি হিসেবে তাঁর এক যুগের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নিয়ে ফুটবলপ্রেমীদের মধ্যে আলোচনা তুঙ্গে। সালাউদ্দিন কথাটি বললেন এ দেশের ফুটবলপ্রেমীদের অনেক স্বপ্ন দেখিয়ে, ফুটবল উন্নয়নে অনেক কিছু করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে।
দেশের ফুটবলের সবচেয়ে জনপ্রিয় তারকা ছিলেন সালাউদ্দিন। অনেকে তাঁকে সব খেলা মিলিয়েই দেশের সেরা তারকার মর্যাদা দেন। সালাউদ্দিনের খেলোয়াড়ি সামর্থ্য নিয়ে কোনো প্রশ্ন ছিল না। প্রশ্নটা উঠল যখন তিনি দেশের ফুটবলে দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হলেন। বিতর্কিত হলো সভাপতি হিসেবে তাঁর কর্মকাণ্ড।
২০০৮ সালের এপ্রিলে বড় স্বপ্ন দেখিয়েই বাফুফে সভাপতির পদে বসেন কাজী সালাউদ্দিন। সালাউদ্দিন বলেই তাঁর কাছে প্রত্যাশাও ছিল বেশি। ব্যাপারটা এমন ছিল যে, সালাউদ্দিন যদি বাংলাদেশের ফুটবলকে উন্নতির সিঁড়িতে নিতে না পারেন তাহলে আর কেউই পারবেন না। দেশের ফুটবলের দায়িত্ব তাঁর হাতে উঠেছে দেখে তাই আশাবাদী হয়েছিলেন ফুটবল-সংশ্লিষ্ট প্রায় সবাই। বাফুফেতে সালাউদ্দিন সহযোগী হিসেবেও পেয়েছিলেন সাবেক তারকাদেরই। তবু অপ্রিয় সত্যি হলো, বাফুফে সভাপতি হিসেবে সালাউদ্দিনের এক যুগের ইতিহাস নিয়ে উচ্ছ্বসিত হওয়ার কিছু নেই।
সালাউদ্দিন নিজে অবশ্য সাফল্যের ফিরিস্তিই দেন। তাঁর সবচেয়ে বড় রক্ষাকবচ ঘরোয়া ফুটবলটাকে নিয়মিত মাঠে রাখা। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার আগে অনেক সময় মাঠেই থাকত না খেলা। কিন্তু এটাও তো ঠিক, এই ১২ বছরে ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশ ক্রমেই নিচের দিকে নেমেছে। যে সাফ অঞ্চলে একটা ভালো অবস্থান নিয়ে বাংলাদেশের গর্ব ছিল, সেটিও আজ অতীত। ভাবা যায়, সালাউদ্দিন বাফুফে সভাপতি হওয়ার পর ৬টি সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ খেলা বাংলাদেশ গ্রুপপর্ব থেকে বিদায় নিয়েছে ৫ বারই! ২০০৮ সালের আগে এই বাংলাদেশই তিনবার সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে খেলে একবার শিরোপা জিতেছে। এ ছাড়া গত এক যুগে অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েও তৃণমূল থেকে ফুটবল প্রতিভা বের করে আনার দৃশ্যমান চেষ্টা ছিল না। জেলা ফুটবলের উন্নয়ন, কিংবা সারা দেশে ফুটবল ছড়িয়ে দেওয়ার কাজেও সালাউদ্দিন ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এই এক যুগে সালাউদ্দিন বিতর্কিত ব্যক্তিদের কাছে টেনেছেন বলেও অভিযোগ আছে।
কাজী সালাউদ্দিন হয়তো বলবেন, জাতীয় দল নিয়ে তিনি কাজ করেছেন। জাতীয় দলের আন্তর্জাতিক ম্যাচের সংখ্যা বেড়েছে। কথাটা ভুল নয়, তবে ফল বলছে অন্য কথা। এই ১২ বছরে ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। নামতে নামতে বাংলাদেশ এখন ১৮৭। একটা সময় তো এই অবস্থান ১৯৭-এ গিয়েও ঠেকেছিল! দেশের ফুটবলপ্রেমীরা শঙ্কা নিয়ে অপেক্ষায় ছিলেন কখন ‘ডাবল সেঞ্চুরি’টা করে ফেলে বাংলাদেশ। অবশ্য সালাউদ্দিনের সময়ে একবার বাংলাদেশ ১৩৮-এও উঠেছে।
জাতীয় ফুটবল দল নিয়ে সালাউদ্দিনের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা পরিকল্পনাহীনতা। গণমাধ্যমের সামনে তিনি বারবার বলেছেন, ‘আমি তো আর মাঠে গিয়ে খেলে দিতে পারব না।’ তাঁকে মাঠে গিয়ে খেলতে কখনোই কেউ বলেনি, তাঁর কাছে ফুটবল প্রিয় মানুষের দাবি ছিল জাতীয় দল নিয়ে আধুনিক ও কার্যকর পরিকল্পনা। এক সময় দেশের জার্সি গায়ে খেলেছেন, একাধিকবার জাতীয় ফুটবল দলের কোচের দায়িত্ব পালন করেছেন। জাতীয় ফুটবল দলের উন্নয়নের জন্য কী প্রয়োজন, সেটি সালাউদ্দিনেরই ভালো বোঝার কথা। কিন্তু তিনি সেখানেও ব্যর্থ। কোচ বদল করেছেন কাপড় বদলানোর মতো করে। সালাউদ্দিনের ১২ বছরে জাতীয় ফুটবল দলের কোচের পদে পরিবর্তন এসেছে ১৯ বার।
সালাউদ্দিনের সময় বাংলাদেশ ভুটানের মতো দলের কাছেও হেরেছে। ২০১৬ সালে থিম্পুতে এশিয়ান কাপ প্রাক বাছাইয়ের ম্যাচে সে হার বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসেরই সবচেয়ে বড় লজ্জা হিসেবে বিবেচিত। লজ্জার শুরু অবশ্য আগেই, যখন নেপাল ‘অজেয়’ দলে পরিণত হলো, মালদ্বীপের বিপক্ষে আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচে বাংলাদেশ হারল ৫-০ গোলে।
জাতীয় দল নিয়ে ব্যর্থতার এ রকম অনেক ফিরিস্তিই দেওয়া যাবে। তবে সালাউদ্দিন নিশ্চয়ই চাইবেন সফলতার গল্প শোনাতে। বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে কাতারের বিপক্ষে বাংলাদেশ দলের দুর্দান্ত পারফরম্যান্স, কলকাতায় যুব ভারতী ক্রীড়াঙ্গনে ভারতকে প্রায় হারিয়ে দেওয়ার গল্পটাও সালাউদ্দিনের সময়েরই। অনূর্ধ্ব-২৩ দলের এশিয়ান গেমসে কাতারকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো দ্বিতীয় রাউন্ডে পৌঁছানোর সাফল্যটাও ভুলে গেলে চলবে না। কিন্তু এটাও তো ঠিক, সালাউদ্দিনের আমলেই দক্ষিণ এশীয় ফুটবলে সম্মানের জায়গাটা হারিয়ে ফেলে বাংলাদেশ। সেই দায় সালাউদ্দিন বা তাঁর নেতৃত্বাধীন বাফুফে কীভাবে এড়াবে!
সালাউদ্দিনের মুখে ফুটবল একাডেমির কথা বারবারই শোনা গেছে। সিলেট বিকেএসপিতে একাডেমির কার্যক্রম শুরু হলেও সেটি বন্ধ হয়ে গেছে। নতুন করে শুরু করার কোনো উদ্যোগ নেই। ঢাকায় একটি শিল্পগ্রুপের জায়গায় একাডেমি স্থাপনের কথা শোনা গেলেও সেটি কাগজেই রয়েছে। ২০১৫ সালে সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ বিজয়ী বাংলাদেশ দলকে নিয়েও পরিকল্পিতভাবে এগোনোর কথা বলেছিলেন সালাউদ্দিন। আজ সে দলের অনেকেই হারিয়ে গেছে। ২০১৭ সালে কাতারকে হারিয়ে আসা অনূর্ধ্ব-১৬ দলের খেলোয়াড়দের নিয়েও কোনো পরিকল্পনা দিতে পারেনি সালাউদ্দিনের বাফুফে। পারেনি প্রিমিয়ার লিগের ক্লাবগুলোকেও বয়সভিত্তিক দল তৈরির ব্যাপারে কোনো নীতিমালার আওতায় আনতেও।
সালাউদ্দিনের দাবি— এই সময়ে তিনি ফুটবলের ভিত তৈরি করেছেন। ৩০ তলা ভবন তৈরিতে যেমন ভিত তৈরি করতে সময় লেগে যায়, গত ১২টি বছরকে কী তেমনভাবেই দেখছেন বাফুফে ‘বস’! আর ভিত তৈরিতেই যদি ১২ বছর লেগে যায়, সালাউদ্দিন ফুটবলের উন্নতিটা করবেন কবে? উল্টো আরেকটি নির্বাচনের আগে তিনি বললেন, ‘রাতারাতি ফুটবলের উন্নয়ন সম্ভব নয়।’ সালাউদ্দিন বাংলাদেশের কিংবদন্তি ফুটবলার হতে পারেন, কিন্তু দেশের ফুটবলের অভিভাবক হিসেবে তার বোধ হয় আর কিছুই দেওয়ার নেই।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, সালাউদ্দিন না থাকলে দায়িত্ব নেবেন কে? যারা বিরোধীপক্ষ নিয়ে সব সময় তাঁর সমালোচনাই করে গেলেন তাঁরা তো নির্বাচনে আসি আসি করেও শেষ পর্যন্ত এলেন না! অবশ্য সালাউদ্দিন বিরোধীদের দাবি, যারা নির্বাচনে আসতে চেয়েছেন নানা রকম হুমকি-ধমকিতেই নাকি তারা সরে গেছেন। কারণ যাই হোক, নির্বাচন করে সালাউদ্দিনকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো তেমন কেউই এখন নেই। সভাপতি পদে সালাউদ্দিনের একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী শফিকুল ইসলাম সালাউদ্দিনের চেয়ে ভালো কাজ করবেন, এমন বিশ্বাস কয়জনের আছে?
সভাপতি পদে বাদল রায় প্রার্থী হয়েও শারীরিক সমস্যার কারণ দেখিয়ে সরে গেছেন। অদৃশ্য কারণে সরে গেছেন ফুটবল অঙ্গনে ‘দানবীর’ ও ‘খরচে’ হিসেবে খ্যাত ব্যবসায়ী তরফদার রুহুল আমিনও। সালাউদ্দিন বিরোধী পক্ষ ১৯ পদে প্রতিদ্বন্দ্বী দিয়েও সভাপতি পদে কোনো প্রার্থী দিতে পারেনি। তাহলে তো ধরে নিতেই হয় বাংলাদেশের ফুটবলে সালাউদ্দিনের বিকল্প নেই।
স্বাধীনতার ৪৯ বছর পরও যদি বাফুফে সভাপতির আসনে আসার মতো দ্বিতীয় ব্যক্তি না থাকে, সেটি তো ফুটবলেরই ব্যর্থতা!
বাংলাদেশের ফুটবল আসলেই বড় দুর্ভাগা।