গতকাল কুমিল্লায় বাংলাদেশ প্রিমিয়ার ফুটবল লিগে হারতে বসা ম্যাচে মোহামেডানকে নাটকীয় ড্র এনে দিয়েছেন সোলেমান দিয়াবাতে। যোগ করা সময়ের পঞ্চম মিনিটে কর্নার থেকে তাঁর হেডে স্কোরলাইন হয় ৩-৩। ততক্ষণে দিয়াবাতের হ্যাটট্রিকও পূর্ণ।
কুমিল্লা থেকে বাসে ঢাকা ফেরার পথে রাতে ফোনে দিয়াবাতে প্রথম আলোকে বললেন, ‘আমি অনেক খুশি। লিগে দুটি হ্যাটট্রিক হলো আমার।’ দুটি হ্যাটট্রিকের কথা শুনে খটকা লাগে। কারণ, প্রথমটির কোনো রেকর্ড নেই। তাই প্রথমটি কবে জানতে চাইলে বলেন, কদিন আগেই সিলেটে রহমতগঞ্জের বিপক্ষে।
কিন্তু সেদিন সংবাদমাধ্যমে পাঠানো বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের অফিশিয়াল ফলাফলে রহমতগঞ্জের বিপক্ষে মোহামেডানের ৫-১ গোলের জয়ে দিয়াবাতের গোল দেওয়া আছে দুটি। সে হিসাবে এ পর্যন্ত তাঁর হ্যাটট্রিক একটিই। কিন্তু দিয়াবাতের কথায় তাঁর হ্যাটট্রিক দুটি। এর মানে কি তাঁর একটি হ্যাটট্রিক ছিনতাই হয়েছে? এই প্রতিবেদকের কাছে খবরটা জেনে মন খারাপ করে বললেন, ‘আমি তো জানি আমি হ্যাটট্রিক করেছি, কিন্তু একটি গোল কমল কীভাবে, বুঝতে পারছি না।’
হ্যাটট্রিক প্রসঙ্গ যখন এলই, একটা তথ্য দেওয়া যাক। ১২ দলের বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে গতকাল পর্যন্ত হ্যাটট্রিক হয়েছে ৭টি। এবং ৭টিই বিদেশিদের। যার মধ্যে ৪টি করেছেন নাইজেরিয়ানরা। চট্টগ্রাম আবাহনীর নাইজেরিয়ান স্ট্রাইকার পিটার থ্যাংকগডের হ্যাটট্রিক দুটি। হ্যাটট্রিক করেছেন আবাহনীর ব্রাজিলিয়ান স্ট্রাইকার দরিয়েলতন গোমেজ, বাংলাদেশ পুলিশের আফগান ফুটবলার আমরেদিন শরিফি, সাইফ স্পোর্টিংয়ের নাইজেরিয়ান এমেকা ওগবোহ, শেখ জামালের নাইজেরিয়ান চিনেদু ম্যাথিউ।
শেষের জন নিজেকে দুর্ভাগা ভাবতেই পারেন। গত ৩ এপ্রিল স্বাধীনতা ক্রীড়া সংঘের বিপক্ষে হ্যাটট্রিকের এক ম্যাচ পরই ‘চিনেদু চলে না’ তকমা দিয়ে মধ্যবর্তী দলবদলে শেখ জামাল কর্তৃপক্ষ তাঁকে বাদ দিয়েছে। ক্লাবের ভেতরেই যা নিয়ে অবাক অনেকে। শেষমেশ অবশ্য চিনেদুর একটা ঠিকানা হয়েছে। এএফসি কাপের জন্য বসুন্ধরা কিংস তাঁকে দলে নিয়েছে অতিরিক্ত হিসেবে। যদিও এএফসি কাপ খেলতে পারবেন চার বিদেশি এবং সেই চার বিদেশির একজন হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলছে চিনেদুর। কারণ, আগে থেকেই থাকা চারজনেরই খেলার সম্ভাবনা বেশি। কেউ চোট পেলে চিনেদুকে ‘বিপদের বন্ধু’ হিসেবেই নিয়ে রেখেছে কিংস।
এরই মধ্যে চট্টগ্রাম আবাহনীর পরীক্ষিত বন্ধু হয়ে উঠেছেন পিটার থ্যাংকগড। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি সাইফ স্পোর্টিংয়ের বিপক্ষে ৩-৩ ড্রয়ে দলের তিন গোলই তাঁর। ১৭ মার্চ তিনি আবার হ্যাটট্রিক করেছেন। এবার উত্তর বারিধারার বিপক্ষে মারুফুল হকের দলের ৪-২ গোলের জয়ে থ্যাংকগডের ৩ গোল। থ্যাংকগড আলোচনায় এসেছেন মূলত তাঁর নামের কারণেই। থ্যাংকগড, মানে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ! পরপর কয়েকটি বোন হওয়ার পর তাঁর জন্ম। অবশেষে ছেলেসন্তান হওয়ায় মা–বাবা নাম রাখেন থ্যাংকগড।
নামে কী আসে যায়, কথাটা তাই আর যা–ই হোক থ্যাংকগডের বেলায় খাটে না। নাম দিয়েই তিনি বেশি পরিচিতি পেয়েছেন বাংলাদেশের ক্লাব ফুটবলে। অথচ ২০১৭-১৮ ও ২০১৮-১৯ মৌসুমে বাংলাদেশ লিগে দুটি করে মোট ৪টি হ্যাটট্রিক করেও সেভাবে আলোচনায় আসতে পারেনি থ্যাংকগডেরই স্বদেশি রাফায়েল ওদোইন।
থ্যাংকগড এমনিতে খুব শান্ত। নিরিবিলি থাকতে ভালোবাসেন। সারা দিন রুমেই থাকেন। একটু নাকি অলস প্রকৃতির। মাঠে সেটার প্রতিফলনও দেখা যায়। এদিক-ওদিক দৌড়ঝাঁপ কম করেন। বক্সেই তাঁর মূল ঠিকানা। একজন পরিপূর্ণ নাম্বার নাইন। সেই অনুযায়ী চট্টগ্রাম আবাহনী তাঁকে ৯ নম্বর জার্সি দিতে চেয়েছিল। কিন্তু থ্যাংকগড বেছে নিয়েছেন ২৭ নম্বর। এর আগে ২৭ নম্বর জার্সি পরেই সাফল্য পেয়েছেন, ফলে বাংলাদেশে এসেও নম্বরটা আর বদল করেননি।
১০ নম্বর জার্সি পরেন মোহামেডানের দিয়াবাতে ও সাইফের এমেকা। বাংলাদেশ পুলিশের শাকিরি, শেখ জামালের চিনেদু ও আবাহনীর দরিয়েলতন গোমেজ পরেন ৯। শেষেরজন এবারের লিগের প্রথম হ্যাটট্রিকের মালিক। ১৩ ফেব্রুয়ারি যেটি করেছেন রহমতগঞ্জের বিপক্ষে টঙ্গীর মাঠে। দরিয়েলতন অতিরিক্ত চোটপ্রবণ। তাই কিছু ম্যাচ খেলতে পারেননি। নইলে তাঁর নামের পাশেও একাধিক হ্যাটট্রিক থাকতে পারত।
সম্প্রতি তাঁর সঙ্গে কথা হচ্ছিল আবাহনী ক্লাবে বসে। গল্পে গল্পে তখন বলেছিলেন, সুযোগ পেলে আবার চীন যেতে চান। চীন নাকি তাঁর দ্বিতীয় বাড়ি। বছর দশেক চীনে খেলে চীনা ভাষাও রপ্ত করেছেন অনেকটা। এই দু–চারটা চীনা শব্দও উচ্চারণ করলেন এই প্রতিবেদকের সামনে। যেমন নি হাও, (হ্যালো), শিয়ে শিয়ে (ধন্যবাদ)। চীনে জন্ম নেওয়া তাঁর মেয়েকে ব্রাজিল ফিরে ভর্তি করেছেন চীনা স্কুলে। এসব নিয়ে গল্পের ফাঁকে বলেছিলেন, এই লিগে তাঁর ইচ্ছা অন্তত গোটা তিনেক হ্যাটট্রিক করা।
এমেকা ওগবোহর ইচ্ছাও সে রকমই। তাঁর সম্পর্কে সাইফের কর্মকর্তা বলেন, ‘ভালো টিমমেট। শতভাগ দেন মাঠে, এমনিতে চুপচাপ স্বভাবের। বাড়তি কথা বলেন না।’ লিগে তাঁর একমাত্র হ্যাটট্রিকটি এসেছে গত ১ মার্চ স্বাধীনতা ক্রীড়া সংঘের বিপক্ষে। সাইফ জেতে ৫-১ গোলে।
স্বাধীনতার বিপক্ষেই গত ৭ মার্চ বাংলাদেশ পুলিশের ৪-২ গোলের জয়ে হ্যাটট্রিক করেন আমরেদিন শরিফি। তাঁর সম্পর্কে পুলিশ দলের ম্যানেজার আবু তাহেরের মূল্যায়ন, ‘খুবই ভদ্র ফুটবলার। বিদেশিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দলকে সহায়তা করে। ওর খেলায় আমরা খুবই খুশি।’ চারজন বিদেশির দুজনকে এবার মধ্যবর্তী দলবদলে বিদায় করে দিয়েছে পুলিশ। যার মধ্যে টিকে গেছেন আমেরদিন।
২০১৯ সালে কোচ শন লেনের হাত ধরে বাংলাদেশে এসে টানা তিন বছর সাদাকালোর জার্সি পরে খেলছেন সোলেমান দিয়াবাতে। তাঁর সম্পর্কে অভিন্ন কথা শোনা গেল মোহামেডান কর্মকর্তাদের গলায়, ‘ও খুব শান্ত, ভদ্র। আচার-ব্যবহার ভালো।’
তবে দিয়াবাতে অন্যদের চেয়ে একটু আলাদা। মাঠে প্রচুর পরিশ্রম করেন। গোটা দলটাকে খেলান। মোহামেডানের জোয়াল একাই টানছেন। মতিঝিল ক্লাবপাড়ার দলটি এখন পর্যন্ত লিগে ১৪ ম্যাচে যে ৫টি জয় পেয়েছে, সব কটিতেই অগ্রণী ভূমিকা দিয়াবাতের। দলের ২০ গোলের অর্ধেকের বেশি তাঁর (১১)। ১৪ গোল নিয়ে বাংলাদেশ লিগে গোলদাতার তালিকায় সবার ওপরে থাকা চট্টগ্রাম আবাহনীর পিটার থ্যাংকগডের প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছেন দিয়াবাতে। সেরা গোলদাতার লড়াইয়ে শীর্ষ পাঁচে শুধু বিদেশিরাই।
বিদেশিরা দলের সঙ্গে একাত্ম হতে পারেন না, তাঁরা খেলেন শুধু টাকার জন্য। বাংলাদেশের ফুটবলে এমন একটা কথা প্রচলিত আছে। কথাটা অনেকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলেও অন্য অনেকের সঙ্গে দিয়াবাতেও ভিন্ন। তাঁকে নিয়ে মোহামেডানের পরিচালক আবু হাসান চৌধুরীর বিশ্লেষণ, ‘পরিপূর্ণ একজন টিমম্যান। দলের জন্য জানপ্রাণ দিয়ে খেলে ও।’
তবে দিয়াবাতকে যথার্থ মূল্যায়ন করলেন বোধ হয় আরমান আজিজ। সাবেক ফুটবলার ও চট্টগ্রাম আবাহনীর ম্যানেজারের কথা, ‘আরে, ও তো অলরাউন্ডার। ক্রিকেটের সাকিব। সাকিব যেমন ব্যাটিং-বোলিং–ফিল্ডিং সবকিছুতেই চ্যাম্পিয়ন, দিয়াবাতেকেও আমার কাছে ফুটবল মাঠে তেমনই লাগে। ও সবই করে। নিজে খেলে, দলকে খেলায়। সারাক্ষণ ডিফেন্সকে ডিস্টার্ব করতে থাকে। ওর হ্যাটট্রিক মাঠে বসে দেখে বুঝেছি, ভিন্ন মেজাজের ফুটবলার।’
বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবলে গোল বা হ্যাটট্রিকবিষয়ক আলোচনা যত এগোবে, বিদেশিদের কথাই আসবে বারবার। গত লিগে (২০২০-২১) হ্যাটট্রিক হয়েছে ৯টি। এর ৮টিই করেন বিদেশিরা। ৯ হ্যাটট্রিকের ৫টিই ছিল ফিক্সিং–কাণ্ডে অভিযুক্ত আরামবাগের বিপক্ষে, পরবর্তী সময়ে যারা অবনমিত হয়ে যায়। আরামবাগের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করে গত লিগে দেশিদের মুখ রক্ষা করেন আবাহনীর উইংগার জুয়েল রানা।
দেশি ফুটবলারদের কাছে হ্যাটট্রিক এখন সোনার হরিণ। তবে অতীতে তা ছিল না। আশি-নব্বইয়ের দশকে ঢাকা লিগে যেমন শেখ মোহাম্মদ আসলামের হ্যাটট্রিক ৫টি। অনেকে বলেন, এখন দেশি ফুটবলারদের গোল বা হ্যাটট্রিকের ক্ষুধা কম।
জাতীয় দলের সাবেক কোচ শফিকুল ইসলাম মানিক এর জন্য দেশিদের নিয়মিত খেলার সুযোগ কমে যাওয়াকে দায়ী করছেন। তাঁর বিশ্লেষণ, ‘খেলার সুযোগ কম পাওয়ায় দেশিদের গোল করার ক্ষমতাও কমে গেছে। কয়েক বছর ধরেই তারা নিয়মিত সুযোগ পায় না। সুযোগ পেলেও হয়তো গোল করতে পারছে না। দেশের শীর্ষ স্ট্রাইকার সুমন রেজা, মতিন মিয়ারা অল্প সময় খেলে বসুন্ধরা কিংসে। জীবন (নাবিব নেওয়াজ) অনেক সময় আবাহনীর স্ট্রাইকারের পেছনে খেলে, অনেক সময় মাঝমাঠেও চলে আসে। যে কারণে গোলের সুযোগ কম আসছে।’
এর বড় কারণ অবশ্যই বাংলাদেশ লিগে বিদেশির আধিক্য। বিশেষ স্ট্রাইকিং পজিশনে। যদি ধরা হয় দলগুলো সব ৪-৩-৩ পদ্ধতিতে খেলছে, তার মানে ১২ দলে ৩৬ জন ফরোয়ার্ডের মধ্যে ৩০ জনই বিদেশি। বিদেশিদের ওপরই কোচেরা আস্থা রাখছেন। খুব দরকার না হলে বিদেশিদের বদলিও করা হয় না। ফলে তাঁরাই আলো কাড়েন। হ্যাটট্রিকেও তাঁদেরই জয়জয়কার।