চ্যাম্পিয়নস লিগ

স্মরণীয় সেই সব ফাইনাল–পর্ব ২

ইকার ক্যাসিয়াসের কাছে মনে হয়েছিল, বিশ্বকাপ জেতার চেয়েও এই ট্রফি তাঁকে বেশি তৃপ্তি দিয়েছে। অস্বাভাবিক নয়। দুবারের চেষ্টাতেই বিশ্বকাপ জিতেছেন, যেখানে চ্যাম্পিয়নস লিগ ১২ বছর ধরে তাঁকে নাকানিচুবানি খাইয়েছে। ওদিকে পেপ গার্দিওলা বলছেন, চ্যাম্পিয়নস লিগের চেয়ে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ জেতা কঠিন। যদিও এতে আপত্তি তুলতে পারেন রোনালদো নাজারিও বা ইব্রাহিমোভিচ। বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে দুজনেরই যে অপ্রাপ্তির নাম এই চ্যাম্পিয়নস লিগ। ২৮ মে প্যারিসে চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে মুখোমুখি রিয়াল মাদ্রিদ ও লিভারপুল। ভালোবাসার শহর কাকে বরমাল্য দেয়, সেটা জানতে এখন সবার অধীর অপেক্ষা। এই ফাইনাল উপলক্ষে চ্যাম্পিয়নস লিগ নিয়ে প্রথম আলোতে প্রতিদিন থাকছে বিশেষ আয়োজন। চলুন আরেকবার ঝালিয়ে নেওয়া যাক চ্যাম্পিয়নস লিগের স্মরণীয় সব ফাইনালের স্মৃতি। আজ দ্বিতীয় পর্বে তিন ফাইনাল—

২০১৪, রিয়াল মাদ্রিদ-আতলেতিকো মাদ্রিদ (৪–১)

প্রেক্ষাপট

আতলেতিকো মাদ্রিদ: লিগ চ্যাম্পিয়ন

রিয়াল মাদ্রিদ: লিগে তৃতীয়, কোপা দেল রে বিজয়ী

চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা হাতে রিয়াল অধিনায়ক ইকার ক্যাসিয়াসের উল্লাস

ফেবারিট: রিয়াল মাদ্রিদ।

একই শহরের দুই ক্লাবের মধ্যে প্রথম ফাইনাল ছিল এটি। রিয়ালের ১৩তম ফাইনাল, আতলেতিকোর দ্বিতীয়। ২০০২ সালে নবম শিরোপা জয়ের পর রিয়ালের প্রথম ফাইনাল, যে ‘ডেসিমা’ মরীচিকার রূপ নিয়েছিল, তা জেতার সুযোগ। আতলেতিকো মাদ্রিদের লা লিগা জেতাটা ছিল বড় এক চমক। কিন্তু ওই ‘চমক’ শব্দটাই বুঝিয়ে দেয়, ফাইনালে তাদের কাছে প্রত্যাশাকে। অন্য দিকে কোপা দেল রে সেমিফাইনালের দুই লেগেই আতলেতিকোকে হারিয়ে দেওয়া রিয়াল ফাইনালের আগে সব প্রতিযোগিতা মিলে করেছিল ১৫৬ গোল! লিগ জেতায় বড় ভূমিকা রাখা দিয়েগো কস্তা ফাইনালের আগে চোটে পড়ায় আরেকটা বড় ধাক্কা খায় আতলেতিকো।

ম্যাচে যা হলো

পুরো ফিট না থেকেও মাঠে নেমেছিলেন কস্তা। কিন্তু ৯ মিনিটেই মাঠ ছাড়তে হয় তাঁকে। এক দিয়েগোর অভাব বুঝতে দেননি অন্য দিয়েগো। ৩৬ মিনিটে ইকার ক্যাসিয়াসের বলের গতিপথ বোঝার ভুল, দিয়েগো গদিনের হেড—এগিয়ে যায় আতলেতিকো মাদ্রিদ। রক্ষণের জন্য বিখ্যাত দিয়েগো সিমিওনের দলের জন্য ওটাই যথেষ্ট ছিল। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, গ্যারেথ বেল, করিম বেনজেমা, আনহেল দি মারিয়ারা আক্রমণের পর আক্রমণ করে গেছেন, কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না।

রিয়াল কোচ আনচেলত্তি গোল করার মরিয়া চেষ্টায় বেনজেমাকে তুলে মোরাতাকে নামালেন। একমাত্র ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার খেদিরাকেও তুলে নিলেন, নামালেন আক্রমণাত্মক খেলোয়াড় ইসকোকে। কোয়েন্ত্রাওকে তুলে নামানো হয় মার্সেলোকেও।

ফাইনালে স্বপ্নভঙ্গ হয় আতলেতিকোর। হারের পর

বলের দখল, শট নেওয়া—সবকিছুতেই রিয়াল মাদ্রিদের দাপট। কিন্তু ৯২ মিনিট পর্যন্ত পিছিয়ে রিয়াল মাদ্রিদ। এ অবস্থায় একটা কর্নার পায় রিয়াল। মদরিচের কর্নার গ্যারেথ বেলের মাথার স্পর্শ পায়নি। কিন্তু সের্হিও রামোস ছিলেন। ৯২.৪৮ এই সংখ্যাকে রিয়াল মাদ্রিদের ইতিহাসে অমর করে দিয়ে রামোসের হেড জালে।

অবিশ্বাস্যভাবে ম্যাচে ফেরে রিয়াল। অতিরিক্ত সময়ে গড়ানো ম্যাচে আর পাত্তা পায়নি আতলেটিকো। ১১০ মিনিটে দি মারিয়ার ক্রস থেকে বেলের গোলে এগিয়ে গেছে রিয়াল। ১১৮ মিনিটে মার্সেলো সব অনিশ্চয়তা দূর করেছেন। ১২০ মিনিটে পেনাল্টি থেকে রোনালদোর গোল শুধু আতলেটিকোর জ্বলুনি বাড়িয়েছে। যোগ করা সময়ে সিমিওনের লাল কার্ড নাটকের শেষ অঙ্কটা জমিয়ে তুলেছে আরও।

১৯৯৯, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড-বায়ার্ন মিউনিখ (২–১)

প্রেক্ষাপট

ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড: লিগ চ্যাম্পিয়ন, এফএ কাপ বিজয়ী

বায়ার্ন মিউনিখ: লিগ চ্যাম্পিয়ন

ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড গোলকিপার পিটার স্মাইকেল শিরোপা হাতে সতীর্থদের সঙ্গে

ফেবারিট: কেউ না।

দুই ফাইনালিস্টই লিগ শিরোপা জিতেছিল। ইউনাইটেড জিতেছিল এফএ কাপও। ওদিকে জার্মান কাপের ফাইনালে পেনাল্টি শুটআউটে হেরেছে বায়ার্ন। ন্যু ক্যাম্পে ফাইনালের ড্রেস রিহার্সাল চ্যাম্পিয়নস লিগের গ্রুপ পর্বেই দিয়ে এসেছে দুই দল। দুটি ম্যাচই ড্র হয়েছিল। ফাইনালে তাই কাউকে ফেবারিট বলার উপায় ছিল না।

ম্যাচে যা হলো

নাটকীয় সমাপ্তির বিচারে সবচেয়ে বিখ্যাত ফাইনাল হয়তো এটাই। কেউ যদি ওলে গুনার সুলশারের ক্যারিয়ার হাইলাইটস দেখতে চান, তাহলেও এই একটা ম্যাচই যথেষ্ট। ‘বেবি ফেসড অ্যাসাসিন’-এর কারণেই ‘সুপার সাব’ কথাটার দেখা মিলেছিল বা বলা ভালো ‘সুপার সাব’ কথাটার উৎপত্তি সুলশারের পাশে বসবে বলেই।

ইউনাইটেড মাঠে নেমেছিল নিয়মিত অধিনায়ক রয় কিনকে ছাড়া। মাঠে ছিলেন না পল স্কোলসও। দুজনই কাটা পড়েছিলেন নিষেধাজ্ঞার খড়্গে। ওদিকে বায়ার্ন মিউনিখের ছিল চোটের সমস্যা। লিজারাজু ও এলবার ছিলেন মাঠের বাইরে। তবু ৬ মিনিটেই এগিয়ে গিয়েছিল বায়ার্ন। মারিও ব্যাসলারের ফ্রি–কিক থেকে করা গোলের পর বল ইউনাইটেড খেলোয়াড়দের পায়ে পায়েই বেশি ঘুরেছে। সুযোগ সৃষ্টিতে অবশ্য বায়ার্নই এগিয়ে ছিল। খেলায় ধারাও তাদেরই ঘোষণা করছিল সম্ভাব্য বিজয়ী বলে।

চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপার পাশ দিয়ে হতাশ মুখে হেঁটে যাচ্ছেন বায়ার্ন কিংবদন্তি লোথার ম্যাথিউস। হারের পর

৬৭ মিনিটে ইউনাইটেড কোচ অ্যালেক্স ফার্গুসন বদলি হিসেবে নামান টেডি শেরিংহামকে, ৮১ মিনিটে নামেন সুলশার। কিন্তু ম্যাচে বদলি খেলোয়াড়দের কোনো প্রভাব দেখা যাচ্ছিল না। ৯০ মিনিট পর্যন্ত ১-০ গোলে এগিয়ে মিউনিখ। পুরস্কার বিতরণীর প্রস্তুতিতে বায়ার্ন মিউনিখের রিবন ট্রফির পাশে বেঁধেও ফেলা হয়েছিল। তখনই শুরু নাটক। ৯১ মিনিটে শেরিংহাম যে গোল করেছেন, সেটি ঢাকার ফুটবলের কাদামাখা মাঠেই দেখা যায় বেশি। বেকহামের কর্নার, শেষ মুহূর্তের কর্নার বলে গোলকিপার পিটার স্মাইকেল উঠে এসেছিলেন। বলটা স্মাইকেলের মাথার একটু ওপর দিয়ে পড়ল ডুইট ইয়র্কের কাছে। ইয়র্ক সেটা আবার জটলায় পাঠালেন। ঠিকভাবে বল ক্লিয়ার করতে পারল না বায়ার্ন রক্ষণ। বল চলে এল গিগসের কাছে। ঠিকভাবে শট নিতে পারেননি ওয়েলশ কিংবদন্তি। কিন্তু তাঁর দুর্বল শট ঠিকই পৌঁছে গেল শেরিংহামের কাছে। বাকিটা শেরিংহামের ডান পা-ই করে দিয়েছে।

ম্যাচটা অতিরিক্ত সময়ে গড়াবে বলে যখন সবাই ধরেই নিয়েছিল, তখনই সুলশারের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গোল। কিক অফের ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে আবার কর্নার। এবারও তা নিলেন বেকহাম। এবার শেরিংহামের মাথাতেই গেল বল। এই ফরোয়ার্ডের হেড গোলমুখে পড়তেই কোত্থেকে হাজির হয়ে গেলেন সুলশার। পা বাড়িয়ে দিলেন, আর তাতেই বল বায়ার্নের জালে। ৪৩ সেকেন্ড বাকি থাকতে বায়ার্ন মিউনিখের হৃদয় ভাঙল।

২০০৫, লিভারপুল-এসি মিলান (৩–৩, লিভারপুল টাইব্রেকারে ৩–২ গোলে জয়ী)

প্রেক্ষাপট

এসি মিলান: লিগে দ্বিতীয়

লিভারপুল: লিগে পঞ্চম

অবিশ্বাস্য ফাইনাল জয়ের পর লিভারপুলের খেলোয়াড়দের বাঁধভাঙা উল্লাস

ফেবারিট: এসি মিলান।

কার্লো আনচেলত্তির এসি মিলানকেই ফেবারিট বলে মেনে নিয়েছিলেন সবাই। দলে পাওলো মালদিনি ও ক্ল্যারেন্স সিডর্ফের মতো সাতবার চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতা খেলোয়াড়। আনচেলত্তি নিজেও খেলোয়াড় হিসেবে যে স্বাদ পেয়েছেন দুবার। দুই বছর আগে এই ট্রফিটা জিতেছেন কোচের ভূমিকাতেও। ওদিকে চ্যাম্পিয়নস লিগ নামকরণের পর এটাই ছিল লিভারপুলের প্রথম ফাইনাল।

ম্যাচে যা হলো

‘দ্য মিরাকল অব ইস্তাম্বুল’

যত চেষ্টাই হোক, অনুবাদ এই লাইনের মর্ম বোঝাতে ব্যর্থ। চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল, নাটক, প্রত্যাবর্তন, চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞা আর ইতিহাস—শব্দগুলোকে একসূত্রে গেঁথে রাখার চূড়ান্ত নিদর্শন তো ২০০৫ চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালই।

ম্যাচটা ফেবারিটের মতোই শুরু করেছিল মিলান। ৫২ সেকেন্ডেই মালদিনির গোলে এগিয়েও গিয়েছিল। চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালের সবচেয়ে দ্রুততম গোল। ম্যাচে ফেরার চেষ্টায় লিভারপুল প্রতি আক্রমণে আরও দুই গোল খেয়ে বসে বিরতির আগেই। হার্নান ক্রেসপোর জোড়া গোলে ৪৪ মিনিটেই ৩-০। এ ম্যাচের কথা বলতে গিয়ে অনেকেই বলেন, প্রথমার্ধের পরই খেলা দেখা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এতে তাঁদের দোষ দেওয়ার উপায় নেই। প্রথমার্ধেই ৩ গোলে পিছিয়ে পড়ার পর চ্যাম্পিয়নস লিগে কোনো দলের ফিরে আসার কোনো উদাহরণ যে ছিল না।

বিরতিতে লিভারপুল কোচ রাফা বেনিতেজকে একটু বাইরে থাকতে বলে অধিনায়ক স্টিভেন জেরার্ড ড্রেসিংরুমে কী বলেছিলেন, সেটা হয়তো একদিন কোথাও প্রকাশ পাবে। তবে উজ্জীবনী সে বক্তৃতায় কী হয়েছিল, তা ইস্তাম্বুলের ৬৯ হাজার দর্শক তার সাক্ষী। টিভির সামনে বসে থাকা কোটি দর্শকও দেখেছেন সেই অবিশ্বাস্য নাটক। বেনিতেজেরও অবদান নেই, এমন নয়। বিরতিতে স্টিভ ফিনানকে তুলে নামান তিনি ডিয়েটমার হামানকে। ফরমেশনও বদলে ৩-৪-২-১ করে দেন। দুই উইংব্যাক হিসেবে রাইজ ও স্মিৎসারকে ব্যবহারের ফল খুব দ্রুতই মিলেছে।

ফাইনালে হারের পর হতাশ মিলান তারকা পাওলো মালদিনি

লিভারপুল ৫৪ মিনিটে আশার ক্ষীণ আলো দেখতে পেল জেরার্ডের গোলে। চিরচেনা দূরপাল্লার জেরার্ড–গোল নয়। রাইজের ক্রস থেকে হেডে এসেছে অধিনায়কের গোল। ৬০ মিনিটে ওই জেরার্ডই পেনাল্টি এনে দেন। জাভি আলোনসোর পেনাল্টি ঠেকিয়ে দিয়েছিলেন দিদা। কিন্তু ফিরতি বলে ঠিকই গোল করে সমতা ফেরান আলোনসো। এর মাঝেই ৫৬ মিনিটে দূর থেকে দারুণ এক শটে ব্যবধান কমিয়ে এনেছিলেন স্মিৎসার।

ম্যাচের পরের ৬০ মিনিটে আর কোনো দল গোল পায়নি। ট্রফির মীমাংসা তাই টাইব্রেকারে। পেনাল্টিতে নায়ক বনে যান জের্জি দুদেক। দুটি পেনাল্টি সেভ করেন লিভারপুল গোলকিপার। লিভারপুলকে পঞ্চম শটটিও নিতে হয়নি। এর আগেই প্রত্যাবর্তনের অবিশ্বাস্য এক গল্প লেখে চ্যাম্পিয়ন লিভারপুল।