ইউরোপীয় ফুটবলে চলছে দলবদল। দলগুলো নিজেদের শক্তিমত্তা বৃদ্ধি করার জন্য নতুন খেলোয়াড় আনছে, অপ্রয়োজনীয় খেলোয়াড় ছেড়ে দিচ্ছে। প্রায় প্রত্যেকটা বড় দলই নতুন স্ট্রাইকার কেনার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। গোলসংখ্যা বাড়ানোর দিকেই যেন তাদের নজর। কারা তারা? আর কোন কোন স্ট্রাইকারকেই বা দলে চাইছে ক্লাবগুলো?
ফুটবল খেলার সরলতম নিয়ম কোনটি?
প্রশ্ন করলে মোটামুটি সবার কাছ থেকেই এক উত্তর আসবে। গোল করা। যে দল যত বেশি গোল করবে, সে দল ম্যাচ জিতবে। আর গোল করার মূল দায়িত্ব থাকে দলের স্ট্রাইকারদের ওপরে। এবার দলবদলের বাজারে মোটামুটি প্রত্যেকটা বড় দলই এই গোল করার পেছনে যেন বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। নতুন স্ট্রাইকার দলে আনা ও দলে থাকা অপ্রয়োজনীয় স্ট্রাইকারদের ছেড়ে দেওয়ার দিকেই তাদের নজর।
বার্সেলোনার কথাই চিন্তা করুন। দলের মূল স্ট্রাইকার লুইস সুয়ারেজের বয়স হয়ে যাচ্ছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই, বার্সার আক্রমণের ধার আর আগের মতো নেই। দলে সুয়ারেজের বিকল্প হিসেবে কিছুদিন আগেও ছিলেন মুনির এল হাদ্দাদি, কেভিন প্রিন্স বোয়াটেংরা। কেউই সন্তোষজনকভাবে পারফর্ম করতে পারেননি। জিরোনার ক্রিস্টিয়ান স্টুয়ানি বা চীনের লিগে খেলা নাইজেরিয়ার স্ট্রাইকার ওডিওন ইগহালোর প্রতি বার্সার আগ্রহের কথা শোনা গেলেও শেষ পর্যন্ত তাঁরা বার্সায় আসেননি। এবার দলের গোলসংখ্যা বাড়ানোর জন্য আগেভাগেই কাজ করা শুরু করে দিয়েছে বার্সেলোনা। লিগে প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের সবচেয়ে বড় তারকা স্ট্রাইকার আঁতোয়ান গ্রিজমানকে আনার মাধ্যমে এক ঢিল দুই পাখি মেরেছে তাঁরা। নিজেদের শক্তি তো বেড়েছেই, প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যাটলেটিকোর শক্তিও কমেছে। ওদিকে নেইমারের প্রতি বার্সেলোনার আগ্রহের ব্যাপারে তো নতুন করে বলার কিছু নেই। পিএসজি স্ট্রাইকারকে যদি বার্সেলোনা দলে ফেরাতে পারে, তাহলে তর্কযোগ্যভাবে বিশ্বের সেরা আক্রমণভাগ বার্সেলোনারই হবে, অন্তত কাগজে-কলমে তো বটেই।
গ্রিজমান চলে যাওয়ার কারণে দলে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে, অ্যাটলেটিকো সেটা পূরণ করেছে বেনফিকা থেকে তরুণ স্ট্রাইকার জোয়াও ফেলিক্সকে দলে নিয়ে এসে। দেখতে কখনো ব্রাজিল তারকা কাকা, বা কখনো আর্জেন্টাইন তারকা সার্জিও আগুয়েরোর মতো মনে হলেও খেলার দিক দিয়ে এই তরুণ যে স্বদেশি ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর যোগ্য উত্তরসূরি, এ ব্যাপারে ফুটবল বিশারদদের সন্দেহ সামান্যই। গত মৌসুমে বেনফিকাকে লিগ জেতাতে সাহায্য করেছেন, সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ৪৩ ম্যাচে করেছেন ২০ গোল। আক্রমণভাগের যেকোনো জায়গায় খেলতে পারেন ফেলিক্স, ঠিক পূর্বসূরি গ্রিজমানের মতো। ১১৩ মিলিয়ন পাউন্ড দিয়ে ফেলিক্সকে কেনার জুয়াটা কাজে লাগবে কি না, সময়ই বলে দেবে অ্যাটলেটিকোকে। ফেলিক্স ছাড়াও তরুণ এক সার্বিয়ান স্ট্রাইকারকে দলে ভিড়িয়েছেন অ্যাটলেটিকো কোচ ডিয়েগো সিমিওনে-ইভান সাপোনয়িচ। ৮ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে ফেলিক্সের মতো বেনফিকা থেকেই এসেছেন তিনি।
ওদিকে নতুন স্ট্রাইকার কেনার তাড়া রিয়াল মাদ্রিদেরও ছিল। সার্বিয়ান স্ট্রাইকার লুকা ইয়োভিচকে কিনে সে সমস্যার সমাধান তারা দলবদলের শুরুতেই করে ফেলেছে। গত মৌসুমে জার্মান ক্লাব ফ্রাঙ্কফুর্টের হয়ে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ২৫ গোল করা এই স্ট্রাইকারের প্রতি নজর ছিল অনেক বড় বড় ক্লাবের। সবাইকে হারিয়ে জয় হয়েছে রিয়ালের। তরুণ এই স্ট্রাইকারকে কিনতে রিয়ালের খরচ হয়েছে ৬০ মিলিয়ন ইউরোর মতো।
হন্যে হয়ে কার্যকরী এক স্ট্রাইকার খুঁজছে ইন্টার মিলান। নতুন কোচ আন্তোনিও কন্তে নিজের দলে নতুন একজন স্ট্রাইকার চাচ্ছেন, ইন্টারের সাবেক অধিনায়ক ও আর্জেন্টিনার স্ট্রাইকার মাউরো ইকার্দিকে পছন্দ হচ্ছে না তাঁর। ইকার্দি ও তাঁর স্ত্রী ওয়ান্ডা নারা ক্লাবের ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিবাদে জড়িয়ে ক্লাবের চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছেন। এই ইকার্দির জায়গাতেই একটা স্ট্রাইকার লাগবে ইন্টারের, সাফ জানিয়ে দিয়েছেন কন্তে। আর এ জন্য তাঁর একমাত্র পছন্দ ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বেলজিয়ান স্ট্রাইকার রোমেলু লুকাকু। লুকাকুর জন্য ৬৫ মিলিয়ন ইউরোর একটা প্রস্তাবও পাঠিয়েছে ইন্টার। সে প্রস্তাবে ইউনাইটেডের ঠিক মন ভরেনি। তারা ৮৫ মিলিয়ন ইউরো চাচ্ছে। লুকাকুর জন্য এত বেশি খরচ করার ইচ্ছে নেই ইন্টারের। লুকাকুকে যদি না পায় তাঁরা, সে ক্ষেত্রে ইন্টারের পছন্দ এএস রোমার বসনিয়ান স্ট্রাইকার এডিন জেকো। তবে লুকাকু না আসলে বেলজিয়ান এই স্ট্রাইকারকে নিয়ে ইন্টার কোচ আন্তোনিও কন্তের আক্ষেপটা দীর্ঘই হবে শুধু। কন্তে যখন চেলসির কোচ ছিলেন, মূল স্ট্রাইকার হিসেবে লুকাকুকে চেয়েছিলেন। তখন এভারটনে খেলতেন লুকাকু। ৭৫ মিলিয়ন পাউন্ড না পেলে লুকাকুকে বিক্রি করব না, চেলসিকে সাফ জানিয়ে দিয়েছিল এভারটন। পরে লুকাকুকে না পেয়ে ১৫ মিলিয়ন পাউন্ড কম দিয়ে রিয়াল মাদ্রিদ থেকে স্প্যানিশ স্ট্রাইকার আলভারো মোরাতাকে কিনে এনেছিলেন কন্তে। এবারও যদি দামের কারণে লুকাকুকে না পান এই ইতালিয়ান কোচ, তবে তাঁর জন্য ব্যাপারটা বেশ বিরক্তিকরই হবে!
ওদিকে সুযোগ বুঝে লুকাকুর জন্য হাত বাড়িয়েছে ইন্টারের লিগ প্রতিদ্বন্দ্বী জুভেন্টাস। লুকাকুর বিনিময়ে নিজেদের দলের দুই স্ট্রাইকারের একজন-আর্জেন্টিনার পাওলো দিবালা কিংবা ক্রোয়েশিয়ার মারিও মানজুকিচকে ছেড়ে দিতে রাজি তারা। লুকাকুর বিনিময়ে পাওলো দিবালাকে পাওয়ার জন্য এদিকে আগ্রহী হয়ে উঠেছে ইংলিশ ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডও। তবে বাদ সেধেছেন খোদ দিবালা। জুভেন্টাস ছেড়ে তাঁর এমন কোনো ক্লাবে যাওয়ার খায়েশ নেই যারা চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলে না। ফলে ইউনাইটেডের প্রস্তাবিত বাৎসরিক ১২ মিলিয়ন ইউরো বেতনের চুক্তিতেও মন ভরছে না আর্জেন্টাইন এই স্ট্রাইকারের। জুভেন্টাসেই থাকতে চাচ্ছেন। ফলে দিবালার জায়গায় মানজুকিচকে চুক্তিতে ঢোকানোর চেষ্টা চালাচ্ছে জুভেন্টাস। ৩৩ বছর বয়সী মানজুকিচ ইউনাইটেডে যেতে চান কি না; লুকাকুর জন্য মানজুকিচ ছাড়াও জুভেন্টাস ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে আর কত মিলিয়ন ইউরো দেবে, এসব কিছু এখনো নিশ্চিত হয়নি। ওদিকে লুকাকুর জায়গায় ফরাসি ক্লাব অলিম্পিক লিওঁর স্ট্রাইকার ওসমানে দেম্বেলেকে মনে ধরেছে ইউনাইটেড কোচ ওলে গুনার সুলশারের। আর লুকাকুকে না পেলে আটলান্টার কলম্বিয়ান স্ট্রাইকার দুভান জাপাতার দিকে হাত বাড়াতে পারে জুভেন্টাস।
ইকার্দিকে চাচ্ছে না ইন্টার, তাহলে কোথায় যাবেন তিনি? আগ্রহী ক্লাবের তালিকায় শোনা যাচ্ছে এএস রোমা ও নাপোলির নাম। এই তালিকায় রিয়াল মাদ্রিদের নাম শোনা গেলেও লুকা ইয়োভিচকে কিনে সেই আলোচনা ধামাচাপা দিয়েছে মাদ্রিদ নিজেই। তবে চাইলেই তো আর হয় না, বেতন দেওয়ার সামর্থ্য কিংবা ট্রান্সফার ফি দেওয়ার সামর্থ্যও তো থাকা লাগে। রোমা বা নাপোলি, কারোরই ইকার্দিকে উচ্চ বেতনে কেনার সামর্থ্য নেই আপাতত। লুকাকুর প্রতি আগ্রহী নাপোলিও। এর মধ্যেই লুকাকুর জন্য ৭০ মিলিয়ন পাউন্ডের প্রস্তাব পাঠানো হলেও লুকাকু নিজেই সে প্রস্তাবে ‘না’ করে দিয়েছেন।
এদিকে নতুন মৌসুমে হ্যারি কেনের একজন সঙ্গী চাচ্ছেন টটেনহাম কোচ মরিসিও পচেত্তিনো। আর সেটার জন্য স্বদেশি দিবালাকেই মনে ধরেছে আর্জেন্টাইন কোচের। দিবালার সঙ্গে কথা চালিয়ে যাচ্ছেন পচেত্তিনো, কপাল ভালো থাকলে ইউনাইটেড নয়, দিবালাকে পেতে পারে টটেনহামই!
নতুন স্ট্রাইকার আনার লোভে তরুণ ইতালিয়ান স্ট্রাইকার মইস কিনকে ছেড়ে দিয়েছে জুভেন্টাস। আর এতে লাভবান হয়েছে এভারটন। ২৭.৫ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে এভারটনে যোগ দিতে যাচ্ছেন কিন।
নতুন কোচ এনেছে এসি মিলান। মিলানের কোচ মার্কো জিয়ামপাওলো তাঁর পছন্দের ৪-৩-১-২ ফরমেশনে দলকে খেলানোর জন্য দুজন স্ট্রাইকার খুঁজছেন। একজন তাঁর দলেই আছেন-পোলিশ স্ট্রাইকার ক্রিস্তফ পিওন্তেক। আরেকজনকে ফরাসি ক্লাব লিল থেকে নিয়ে এসেছেন জিয়ামপাওলো। নাম তাঁর রাফায়েল লিয়াও। তরুণ এই পর্তুগিজ স্ট্রাইকারকে আনতে ৩০ মিলিয়ন ইউরো খরচ হয়েছে মিলানের। ফলে মিলানে জায়গা হয়নি ইতালি তারকা প্যাট্রিক কুত্রোনের। পিওন্তেকের সঙ্গে তাঁর খেলার ধরন প্রায় মিলে যায়, এ ‘অভিযোগে’ কুত্রোনেকে ইংলিশ ক্লাব উলভসের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে মিলান। এদিকে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ড অ্যানহেল কোরেয়ার দিকেও হাত বাড়িয়েছে মিলান।
স্ট্রাইকার নিয়ে সবাই টানাটানি করলেও অস্বাভাবিকভাবে চুপ আছে চ্যাম্পিয়নস লিগজয়ী ক্লাব লিভারপুল। আরবি লাইপজিগের জার্মান স্ট্রাইকার টিমো ভেরনার কিংবা ওয়ের্ডার ব্রেমেনের ম্যাক্স ক্রুসের প্রতি আগ্রহের ব্যাপারে শোনা গেলেও দলটার কোচ ইয়ুর্গেন ক্লপ সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, এবার হাত খুলে টাকা খরচ করতে চান না। দলে থাকা বেলজিয়ান স্ট্রাইকার ডিভক অরিগি ও তরুণ ইংলিশ স্ট্রাইকার রিয়ান ব্রুস্টারকে সুযোগ দেবেন তিনি বরং। এর মধ্যে অরিগির সঙ্গে নতুন চুক্তিও করেছে লিভারপুল। ফলে কোনো স্ট্রাইকারের দিকে হাত বাড়াচ্ছে না তারা। একই অবস্থা প্রিমিয়ার লিগজয়ী ক্লাব ম্যানচেস্টার সিটিরও। দলে থাকা আর্জেন্টাইন স্ট্রাইকার সার্জিও আগুয়েরো ও ব্রাজিলের স্ট্রাইকার গ্যাব্রিয়েল জেসুসের প্রতিই আস্থা রাখছেন কোচ পেপ গার্দিওলা।
কোন দল কোন স্ট্রাইকারকে পাচ্ছে, তা আগামী সেপ্টেম্বরের ২ তারিখের মধ্যেই নিশ্চিত হওয়া যাবে। সেদিনই ক্লাবগুলোর দলবদলের সময়সীমা শেষ হয়ে যাবে।