একদিকে কৃষ্ণসাগর, আরেক দিকে ককেশাস পর্বতমালা। সাগরের ঢেউ এসে ধুয়ে দিচ্ছে সৈকতের বালুকা বেলা। আর চারদিকে তো আছেই সবুজ অরণ্য। অসাধারণ সুন্দর রাশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলের এই শহর। এখন প্রবল গ্রীষ্ম, তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস, এখানে এলেই শুচি হয়ে যায় মন। বোঝা গেল ব্রাজিল কেন সোচিতে এসে আস্তানা গেড়েছে। নিজেদের আবহাওয়ার সঙ্গে মিল যেমন পেয়েছে, পেয়েছে পাহাড় আর সাগরের গলাগলি ধরা অবস্থান।
আর এখানে কিনা ব্রাজিলের ম্যাচ নেই। তবে সোচির ফিশত অলিম্পিক স্টেডিয়াম ব্রাজিলের ধারা একটু বইবে। এখানেই আর কিছুক্ষণ পর নামছে পর্তুগাল, তাদের সামনে স্পেন। বর্তমান ইউরো চ্যাম্পিয়ন বনাম সাবেক ইউরো চ্যাম্পিয়ন। এটা শুধু প্রতিদ্বন্দ্বিতার একটা পিঠই সামনে আনে। আরেক পিঠে রয়েছে শতাব্দী প্রাচীন ফুটবলের যুদ্ধ। যাকে বলে ‘আইবেরিয়ান ডার্বি’, আইবেরিয়ান সাগর সংলগ্ন দুই প্রতিবেশীর লড়াই।
এই ফিশত স্টেডিয়াম ২০১৪ শীতকালীন অলিম্পিক আয়োজনের মূলকেন্দ্র। শহরটি এখনো যেন আচ্ছন্ন হয়ে আছে অলিম্পিকের স্মৃতি নিয়েই। যে কাউকে স্পেন-পর্তুগাল মহারণের কথা জিজ্ঞেস করলেই বলছেন, ওহ্, অলিম্পিক স্টেডিয়ামে আজ যে খেলা সেটির কথাই বলছেন তো!
এর সবকিছুতেই অলিম্পিকের চিহ্ন, পোশাকটা মূলত অলিম্পিকের গায়ে শুধু বিশ্বকাপের চাদর পরানো হয়েছে আরকি।
ফিশত স্টেডিয়ামের ভেতরে ঢোকার দুই কিলোমিটার দূর থেকেই মানুষের স্রোত। রক্তলাল গোলাপের মতো ফুটে আছে গোলাপের ঝাড় বুনেছে স্পেনের সমর্থকেরা। পাশেই লাল-সবুজের মেলা বানিয়েছে পর্তুগিজ সমর্থকেরা। তবে যত বেশি ‘ ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো’কে ঘুরে বেড়াতে দেখা যাচ্ছে, ‘ইনিয়েস্তা’ বা ‘রামোস’দের ততটা নয়।
ফুটবলের ব্যক্তিগত বিভায় রোনালদো যত উজ্জ্বল স্পেনের কেউ তো আর নয়। আজ কারা জিতবে—এই প্রশ্নে অনেক পর্তুগিজ সমর্থকের মুখেই উত্তর মিলছে রোনালদো। অর্থাৎ পর্তুগাল জিতলে আসলে জিতবে রোনালদোর পর্তুগাল। আর স্পেন জিতবে পুরো স্পেন দল—লা রোহা। দুই রুশ তরুণী টিকিট হাতে মাঠে ঢোকার মুখে বললেন, ‘যে জেতে জিতুক ক্ষতি নেই, আমরা এসেছি রোনালদোকে দেখতে।’ এ ম্যাচের বক্স অফিস রোনালদো বাড়িয়ে দিয়েছেন বহু গুন।
ম্যাচে শেষ পর্যন্ত ম্যাচের ফল বেঁধে দেবে ৯০ মিনিটের মাঠের লড়াই। তবে মানসিকভাবে একটু হলেও পর্তুগালকে মনে হচ্ছে অগ্রগামী। বিশ্বকাপ শুরুর একদিন আগে কোচ হুলেন লোপেতেগিকে ছাঁটাই করে স্পেন, বলতে দ্বিধা নেই, চাপটা টেনে এনেছে নিজেদের ওপর। রিয়াল মাদ্রিদ ছাড়ার ইঙ্গিত দিয়ে যে তিরটা নিজের বুকের দিকে টেনে এনেছিলেন রোনালদো, সেটি এখন স্প্যানিশদের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। মিডিয়া ও ব্রডকাস্টিং অঞ্চলের উল্টোদিকে বড় একটা পাব বানানো হয়েছে, ওখানে ৩০-৩৫ জন স্প্যানিশ তরুণ-তরুণী কাপুচ্চিনুতে মুখ ডুবিয়ে হৈ হল্লা করছিল। সেখানে ঢুকেই পর্তুগিজ চার তরুণ পর্তুগালের পতাকায় নিজেদের মুড়ে গান গাইতে শুরু করে দিল, কনকুইস্তা ও সানিও পর্তুগাল—স্বপ্নকে জিতে নাও পর্তুগাল। এই বিশ্বকাপে পর্তুগালের থিম সং। দূর থেকে দেখতে পেয়ে বেশ বয়স্ক কয়েকজন স্প্যানিশ, যথারীতি স্পেনের লাল-হলুদ গায়ে চাপিয়ে জোরে চিৎকার করতে থাকলেন, ভিভা এস্পানা, ভিভা এস্পানা।
এই কি আইবেরিয়ান ডার্বি? রণ দুন্দুভি তো বাজছে না। এ তো দেখি লড়াইয়ের পোশাক গায়ে সম্প্রীতির অন্তসলীলা সুর। আসলে বিশ্বকাপটাই এমন। এখানে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার পাশে সম্প্রীতি বসে থাকে। বারুদগন্ধ যুদ্ধের মধ্যে শান্তি দাঁড়িয়ে থাকে। তারপরও এক দল জেতে এক দল হারে। গ্রুপ পর্বে সাম্যবাদ থাকতে পারে, নকআউট পর্ব থেকে থাকবে রণ দুন্দুভি। শেষ পর্যন্ত শিরোপা উঠবে কোন দলের হাতে? স্পেনের দাবিটা তো তাদের রক্তলাল গোলাপের মতোই। পর্তুগালের দাবিটা অত বিজ্ঞাপিত নয়, একটু নিরুচ্চার। তবে মনে রাখবেন, তারা ইউরোর বর্তমান চ্যাম্পিয়ন। যেখানে স্পেন ছিল, জার্মানি ছিল, ইতালি ছিল, ফ্রান্স ছিল। সব বাধা টপকেই তারা মাথায় পরেছে ইউরো মুকুট।
কৃষ্ণসাগরের ঢেউ, আর ফিশত পর্বতচূড়ার(যেটির নামে স্টেডিয়াম) হাওয়ায় কী ভেসে আসে কে জানে।