নব্বইয়ের দশকের রক্তক্ষয়ী বলকান যুদ্ধের পর যুগোস্লাভিয়া ভেঙে বেশ কিছু দেশের জন্ম হয়। যে দেশকে এককালে ইউরোপের ব্রাজিল বলা হতো, বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত না হলে সে দেশের ফুটবল দলটা কেমন হতো? কল্পনা করার চেষ্টা করা হয়েছে।
নব্বই দশকের শুরুতে রক্তক্ষয়ী বলকান যুদ্ধের বলি হয়েছিল এককালের ফুটবলশক্তি যুগোস্লাভিয়া। ইউরোপের ‘ব্রাজিল’ বলা হতো যাদের, সেই দেশটি বিলীন হয়ে গেছে ফুটবল দুনিয়া থেকে। ১৯৩০ ও ১৯৬২ বিশ্বকাপে চতুর্থ স্থান পেয়েছিল তারা। তিনবার শেষ আটে খেলা যুগোস্লাভিয়া সর্বশেষ বিশ্বকাপে খেলেছিল ১৯৯৮ সালে। এর আগেই অবশ্য দেশটি ভেঙে জন্ম হয় সার্বিয়া, ক্রোয়েশিয়া, স্লোভেনিয়া, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা, আলবেনিয়া ও মন্টেনেগ্রো ও মেসেডোনিয়ার। অনেক পরে জন্ম নিয়েছে কসভো। প্রথমবার আবির্ভাবেই ১৯৯৮ বিশ্বকাপে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল ক্রোয়েশিয়া—উঠেছিল সেমিফাইনালে। আটানব্বইয়ে যুগোস্লাভিয়ার নামে আসলে খেলেছিল ‘সার্বিয়া’ জাতীয় দল।
এবারের বিশ্বকাপে খেলছে সাবেক যুগোস্লাভিয়া ভেঙে গঠিত দুটি আলাদা দেশ—ক্রোয়েশিয়া ও সার্বিয়া। ক্রোয়েশিয়া ১৯৯৮ থেকেই নিয়মিত ফুটবল বিশ্বকাপে। তবে ২০ বছর পর এবারই তারা আলো ছড়াচ্ছে নতুন করে। লুকা মডরিচ, মারিও মানজুকিচ, ইভান রাকিতিচরা বিশ্ব ফুটবলের বড় তারকাই। সার্বিয়ার নেমানিয়া ভিদিচ, ব্রানিস্লাভ ইভানোভিচ, মাতিয়ে নাসতাসে ও আলেক্সান্ডার কোলারভরাও মাতিয়ে যাচ্ছেন ফুটবল দুনিয়া। ইতিহাসে ঢুঁ মেরে মনে প্রশ্ন কিন্তু আসে—বলকান যুদ্ধ যদি যুগোস্লাভিয়া রাষ্ট্রটিকে ধ্বংস করে না দিত, তাহলে এবারের বিশ্বকাপে ঐক্যবদ্ধ যুগোস্লাভিয়া হতো কঠিন এক শক্তিই।
ক্রোয়েশিয়া, সার্বিয়া, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা, মন্টেনেগ্রো, কসোভোর সেরা সেরা খেলোয়াড়কে নিয়েই যুগোস্লাভিয়া দলটা হলে সেটা কেমন হতো!
স্লোভেনিয়ার কথাই চিন্তা করুন। গত দশ বছরে এই দলের মূল গোলরক্ষক ছিলেন সামির হানদানোভিচ ও ইয়ান ওবলাকের মতো গোলরক্ষকেরা। তারা দুজনেই ইন্টার মিলান ও অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের মতো ক্লাবের হয়ে মাঠ মাতাচ্ছেন! ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপে খেলা স্লোভেনিয়া অবশ্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে প্রতিবেশী সার্বিয়া ও ক্রোয়েশিয়ার মতো উন্নতি করতে। সেটা এখনো না পারলেও ফুটবল দুনিয়ায় নিজেদের অস্তিত্ব তারা কিন্তু জানিয়ে রেখেছেই।
সাবেক যুগোস্লাভিয়া থেকে বেরিয়ে যাওয়া বাকি দেশগুলোর গোলরক্ষকদের মধ্যে ক্রোয়েশিয়ার আছেন দানিয়েল সুবাসিচ, তিনি খেলেন মোনাকোতে। সার্বিয়ার গোলরক্ষক ভ্লাদিমির স্টয়কোভিচ, বসনিয়ার আসমির বেগোভিচ—ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে বহু বছর ধরেই খেলছেন তিনি। ওদিকে লাৎসিওর প্রতিভাবান গোলরক্ষক টমাস স্ট্রাকোশা আবার আলবেনিয়ান। তবে সবাইকে টপকে ‘কল্পনার যুগোস্লাভ’ দলের মূল গোলরক্ষক হওয়ার দৌড়ে হয়তো এগিয়ে থাকতেন স্লোভেনিয়ার ইয়ান ওবলাকই।
সেই দলের রক্ষণভাগে থাকতেন কারা? কয়েক বছর ধরে বিশ্বকে অসাধারণ কিছু ডিফেন্ডার উপহার দিয়েছে সার্বিয়া—নেমানিয়া ভিদিচ হচ্ছেন তাদেরই একজন। এ ছাড়া ইভানোভিচ, নাসতাসিচ, কোলারভের মতো সার্বিয়ান ডিফেন্ডাররা দলটাকে আরও চেহারা দিতেন। এঁরা সবাই বছরের পর বছর ধরে খেলে যাচ্ছেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, চেলসি, ম্যানচেস্টার সিটি, এএস রোমার মতো নামকরা ক্লাবে। ওদিকে ক্রোয়েশিয়ার ডিফেন্সও হেলাফেলা করার মতো নয়, দলে এখন খেলেন লিভারপুলের দেয়ান লভরেন, অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের সিমে ভরসালিয়োকো প্রমুখ। ওদিকে আর্সেনালের লেফটব্যাক সিদ কোলাসিনাচ খেলেন বসনিয়ার হয়ে। অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের হয়ে খেলেন মন্টেনেগ্রোর স্টেফান সাভিচ। এ যুগের যুগোস্লাভ মূল একাদশের ডিফেন্সে এঁদের মধ্যে হয়তো দেখা যেত ভরসালিয়োকো, লভরেন, ইভানোভিচ ও কোলারভকে। বিকল্প ডিফেন্ডার হিসেবে থাকতেন সাভিচ আর কোলাসিনাচ!
সম্মিলিত এই দলের মিডফিল্ড হতো বিশ্বের অন্যতম সেরা। এক ক্রোয়েশিয়াই তো এ যুগে জন্ম দিয়েছে লুকা মদরিচ, মাতেও কোভাচিচ, ইভান রাকিতিচ, ইভান পেরিসিচ, মার্সেলো ব্রোজোভিচের মতো মিডফিল্ডার ও উইঙ্গারদের। সার্বিয়ার মিডফিল্ডে আছে দুসান তাদিচ, সের্গেই মিলিঙ্কোভিচ-সাভিচ, নেমানিয়া মাতিচ, লুকা মিলিভোয়েভিচ ও আদেম লিয়ায়িচের মতো তারকারা। ওদিকে বসনিয়ার হয়ে মাঠ মাতান মিরালেম পিয়ানিচ। ওদিকে সুইজারল্যান্ডের হয়ে খেললেও জেরদান শাকিরিদের নাড়ি পোঁতা আছে কসোভোতে। এ যুগের যুগোস্লাভ দলের মিডফিল্ডটা কেমন ভয়ংকর হতো, একটু ভাবুন তো!
কল্পনার যুগোস্লাভিয়ার স্ট্রাইকাররাও হতেন ভয়ংকর। বসনিয়ার এডিন জেকো, ক্রোয়েশিয়ার মারিও মানজুকিচ, আলেকজান্ডার মিত্রোভিচ, মন্টেনেগ্রোর স্টেভান ইয়োভেটিচ—কাকে ছেড়ে কাকে নেবেন আপনি? যুদ্ধ কত সুন্দর জিনিসকে নষ্ট করে দেয়। যুগোস্লাভ ফুটবল দলটা তেমনই দারুণ কিছু। স্বাধীনতা পেয়ে ক্রোয়েশিয়া, সার্বিয়া, বসনিয়ার মতো দেশগুলো হয়তো জাতীয়তাবাদের জয়গান গাইছে, কিন্তু একবার কল্পনা করুন তো জাতিগত দাঙ্গায় যুগোস্লাভিয়া রক্তাক্ত না হলে লুকা মডরিচের ডিফেন্সচেরা পাসে বিশ্বকাপে গোল করতে দেখতাম এডিন জেকোকে, ওবলাকের সামনে ডিফেন্স আগলাতে দেখতাম ইভানোভিচকে, শাকিরির ক্রসে মাথা ঠেকিয়ে গোল করতেন হয়তো মানজুকিচ! কী দুর্দান্তই না হতো সেই অভিজ্ঞতাটা!