আলভেজ, অবামেয়াং, পিকে - তিনজনই খেলতে পারেন আজ
আলভেজ, অবামেয়াং, পিকে - তিনজনই খেলতে পারেন আজ

সীমানাঘেঁষা উইঙ্গার, মাঝমাঠে উঠে আসা ডিফেন্ডার... যেভাবে খেলতে পারে বার্সেলোনা

লুইস এনরিকে দায়িত্ব ছাড়ার পর খুব সম্ভবত এই প্রথম কোনো কোচের অধীনে বার্সেলোনা দৃষ্টিনন্দন ফুটবল খেলছে। আর্নেস্তো ভালভার্দে থেকে শুরু করে কিকে সেতিয়েন, রোনাল্ড কোমান—কেউই বার্সেলোনাকে দিয়ে গার্দিওলা-এনরিকের সময়ের চোখজুড়ানো ফুটবল খেলাতে পারেননি। জাভি আসার পর গত কয়েক মাসে কিছুটা হলেও সে গ্লানি ঘুচেছে। বার্সেলোনার প্রতি তীব্র বিদ্বেষ না থাকলে যে কেউই হয়তো স্বীকার করবেন, জাভির কৌশল ও পেদ্রি-গাভি-বুসকেতসদের দক্ষতা মিলিয়ে বার্সেলোনার খেলা দেখতে অন্তত ভালো লাগে।


বার্সেলোনার খেলার এই সৌন্দর্যই এবারের এল ক্লাসিকোর আকর্ষণ বাড়িয়ে দিচ্ছে কয়েক গুণ। নাহয় এবার এমন এক সময়ে ক্লাসিকো হচ্ছে, ম্যাচের ফল যা-ই হোক না কেন, পয়েন্ট তালিকার শীর্ষ স্থানে ওলট-পালট হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। রিয়াল মাদ্রিদ জিতুক, হারুক বা ড্র করুক—ম্যাচ শেষে পয়েন্ট তালিকার শীর্ষে থাকবেই।

খেলা দেখিয়ে আনন্দ দিচ্ছে জাভির বার্সেলোনা

বার্সেলোনার ক্ষেত্রেই বরং ম্যাচটার গুরুত্ব অনেক। আজ জিতলে আগামী মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগে সুযোগ পাওয়ার দৌড়ে বেশ ভালোই এগিয়ে যাবে কাতালানরা। কিন্তু ড্র করলে বা হারলে? অন্য ম্যাচগুলোর ফল পক্ষে না এলে পয়েন্ট তালিকার পঞ্চম স্থানেও নেমে যেতে পারে দলটা।


ভালভার্দে, কোমান ও সেতিয়েনের মতো কোচেরা প্রায় সময়ই বার্সেলোনাকে ৪-৪-২, ৩-৫-২ কিংবা ৩-৪-৩ ছকে খেলালেও ঐতিহ্যগতভাবে বার্সেলোনা ৪-৩-৩ ছকেই দুর্দান্ত খেলে। এই ছকে খেলেই বার্সার ‘বার্সা’ হয়ে ওঠা। জাভি কোচ হয়ে সেটিই ফিরিয়ে এনেছেন আবার। তবে গার্দিওলার বার্সেলোনার সঙ্গে জাভির বার্সেলোনার তফাত অনেক বেশি।

আলভেজ এখন অনেকটা মিডফিল্ডারের ভূমিকায়

রক্ষণ থেকেই শুরু করা যাক। দুই ফুলব্যাক দানি আলভেজ আর জর্দি আলবার বয়স অনেক বেশি এখন, চাইলেও গতির খেলায় প্রতিপক্ষের সঙ্গে টক্কর দিতে পারবেন না। এটা বুঝেছেন জাভি। তাই বলে এই দুজনের মতো অভিজ্ঞ খেলোয়াড়কে বেঞ্চেও যে বসিয়ে রাখা যায় না! ধীরগতির আলবা ও আলভেজ অভিজ্ঞতা আর বুদ্ধিমত্তা দিয়ে বার্সেলোনাকে যেভাবে সাহায্য করতে পারবেন, কজন খেলোয়াড়ের সামর্থ্য আছে তা করার?

জাভি তাই দুই ফুলব্যাকের কাছ থেকে গতির খেলা দেখতে চান না। যে কারণে আলবা বা আলভেজ, কাউকেই অত বেশি উপরে উঠতে দেখবেন না। দেখবেন না ছদ্ম উইঙ্গাররূপে। বরং কাগজে-কলমে রাইটব্যাক হলেও আলভেজের ভূমিকা এখন অনেকটা সেন্ট্রাল মিডফিল্ডারের মতো। নিজের বুদ্ধিমত্তা, নিখুঁত পাস বের করার ক্ষমতার কারণে আলভেজ এখন রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডারের ভূমিকায় থাকা বুসকেতসের পাশে আরেক মিডফিল্ডারের ভূমিকা নেন। চলে আসেন মাঝমাঠে। সেখান ওপরে থাকা খেলোয়াড়দের নিখুঁত পাস পাঠান।

আদামার ড্রিবলিং ও গতি এই বার্সেলোনার বড় সম্পদ

আলভেজ মাঝমাঠে বুসকেতসের সঙ্গে থাকলে আরেক ফুলব্যাক আলবা একটু ওপরে উঠে বাঁ দিকের মিডফিল্ডার ফ্রেঙ্কি ডি ইয়ং ও উইঙ্গার ফেরান তোরেসের সঙ্গে ত্রিভুজাকৃতির ‘শেপ’ সৃষ্টি করেন, যা ওই তিনজনের মধ্যে রসায়ন মজবুত করতে সাহায্য করে। ওই রসায়নের সুযোগ নিয়েই প্রতিপক্ষের ডান দিকে জায়গা বের করে গোলের সুযোগ সৃষ্টি করতে চায় বার্সেলোনা। অনেক সময় বাঁ দিকে আলবা, তোরেস আর ডি ইয়ংয়ের সঙ্গে যুক্ত হন ওপর থেকে নেমে আসা স্ট্রাইকার অবামেয়াংও।
আবার আলবা বুসকেতসের সঙ্গে মাঝমাঠে থাকলে, ডান দিকে থাকা আলভেজ একইভাবে ডান দিকের মিডফিল্ডার পেদ্রি ও উইঙ্গার আদামা ত্রাওরে বা উসমান দেম্বেলের সঙ্গে ত্রিভুজাকৃতির ‘শেপ’ সৃষ্টি করেন। সুযোগমতো তখন স্ট্রাইকার হিসেবে খেলা অবামেয়াংও নেমে এসে মাঠের ওই জায়গায় বার্সেলোনার খেলোয়াড়দের আধিক্য নিশ্চিত করেন।


প্রশ্ন উঠতে পারে, অবামেয়াং যদি ডানে-বাঁয়ে এভাবে নেমে যান, ফুলব্যাকরা যদি মাঝমাঠে চলে আসেন, তাহলে বুসকেতস ছাড়া বাকি দুই মিডফিল্ডার পেদ্রি ও ডি ইয়ংয়ের অবস্থান কেমন হয়? জাভি চমক দেখিয়েছেন এখানেও।

দেম্বেলে আর আদামার মধ্যে যেকোনো একজন সুযোগ পাবেন একাদশে

গার্দিওলার বার্সেলোনার শেষ কথা ছিল মাঠে বল পায়ে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ। বুসকেতস, জাভি, মেসি, ইনিয়েস্তা কিংবা পেদ্রোর মতো খেলোয়াড় থাকার কারণে সে লক্ষ্য অর্জনে সমস্যাও হতো না গার্দিওলার। কিন্তু জাভি বোঝেন, গার্দিওলার হাতে যে অস্ত্র ছিল, তাঁর হাতের অস্ত্রগুলো অতটা ক্ষুরধার নয়। হ্যাঁ, পেদ্রি-ডি ইয়ংরা প্রতিভাবান অবশ্যই কিন্তু এখনই ইনিয়েস্তা বা খেলোয়াড় জাভির পর্যায়ে চলে যেতে পারেননি। যে কারণে তাদের একটু ভিন্নভাবে ব্যবহার করছেন কোচ জাভি।


দুই উইঙ্গার ফেরান ও দেম্বেলে বা ত্রাওরেকে যথাসম্ভব মাঠের দুই কোণায় থাকার নির্দেশ দিচ্ছেন, একদম প্রথাগত উইঙ্গারের মতো। মেসি বা হ্যাজার্ডের মতো উইঙ্গাররা যেমন ‘ইনসাইড ফরোয়ার্ড’ হয়ে ভেতরে চলে আসেন, নিজেদের উইঙ্গারদের ওই ভূমিকায় খেলান না জাভি। বরং দুই সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার সুযোগ পেলেই বক্সে ঢুকে যাচ্ছেন, নিজের দলের উইঙ্গার ও স্ট্রাইকারের মাঝখানের ‘হাফ স্পেস’ বরাবর উঠে গিয়ে ছকটাকে ৪-৩-৩ থেকে ২-৩-৫–এ রূপান্তরিত করে দিচ্ছেন।

পেদ্রি-ডি ইয়ংদের ভূমিকাও বদলেছে জাভির অধীনে

জাভির বার্সেলোনা খেলায় আরও কিছু জিনিস দেখাচ্ছে, যা আগের তিন-চার মৌসুমের বার্সার খেলায় দেখা যায়নি। কিছুদিন আগে গ্যালাতাসারাইয়ের বিপক্ষে প্রথম লেগের খেলার পর জাভি সেন্টারব্যাক রোনাল্ড আরাউহোকে নিয়ে একটা কৌতূহল জাগানো কথা বলেছিলেন। জানিয়েছিলেন, বলের দখল কখন ছাড়তে হবে, সেটা আরও ভালোভাবে বুঝতে হবে আরাউহোকে। যতক্ষণ না পর্যন্ত প্রতিপক্ষের কেউ প্রেস না করছে, ততক্ষণ পর্যন্ত নিজের পায়ে বল রেখে সামনে এগিয়ে মাঝমাঠে চলে আসার জন্য আরাউহোকে বলেছিলেন জাভি। এটাই তাঁর কৌশলের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ।

দুই ফুলব্যাক তো বটেই, দরকার হলে পিকে-আরাউহোর মতো সেন্টারব্যাককেও মিডফিল্ডারের মতো খেলাচ্ছেন জাভি। ফলে দেখা যাচ্ছে, এমন অনেক পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে, যখন পিকে-আরাউহোর পায়ে বল দেখে দুই সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার পেদ্রি ও ডি ইয়ং স্ট্রাইকারের মতো প্রতিপক্ষের বক্সে ঢুকে যাচ্ছেন। বল পায়ে পিকে যেহেতু অনেক দক্ষ, সেহেতু বক্সে ঢুকে যাওয়া সেই মিডফিল্ডারের উদ্দেশে লম্বা পাস পাঠাতে পারেন। সে পাস নিয়ন্ত্রণে নিয়ে পাশে থাকা স্ট্রাইকারের সঙ্গে বোঝাপড়া করে গোল বরাবর শট নিতে পারে বার্সেলোনা।

দুই উইঙ্গার ফেরান ও দেম্বেলে বা ত্রাওরেকে একদম সাইডলাইন বরাবর খেলতে বলার অর্থ একটাই, তাঁদের দেখে রাখার জন্য প্রতিপক্ষ যেন উইঙ্গারপ্রতি সাধারণত একজনের বেশি খেলোয়াড়ের ওপর দায়িত্ব না দিতে পারে। ফেরান, দেম্বেলে বা ত্রাওরে—তিনজনের প্রত্যেকেই ড্রিবলে অনেক পারদর্শী, গতিশীল। ফলে গতি ও ড্রিবলিংয়ের ঝলকে একজন প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়কে হারিয়ে দেওয়া কোনো ব্যাপারই না এই উইঙ্গারদের কাছে। এ পরিস্থিতিতে প্রতিপক্ষ চাইলেও বার্সেলোনার একজন উইঙ্গারকে দেখে রাখার জন্য একজনের বেশি ডিফেন্ডার নিয়োগ করতে পারে না। কারণ, নিজের জায়গা ছেড়ে বার্সার উইঙ্গারকে আটকাতে এক পাশে চলে যাওয়ার অর্থই সেন্ট্রাল ডিফেন্স ফাঁকা করে দেওয়া, যে জায়গাতে ক্রমশই উঠে পড়েন পেদ্রি বা ডি ইয়ংয়ের মতো মিডফিল্ডাররা।


মোটামুটি আজ এল ক্লাসিকোতেও এমন কৌশলেই খেলতে চাইবে বার্সেলোনা। আর রিয়ালের লক্ষ্য থাকবে নিজেদের মাঠে সে কৌশল ব্যর্থ করার।