ছবি আসলেই কথা বলে। আলোকচিত্রীর ক্যামেরায় ধরা পড়া একটি মুহূর্ত কোনো একদিন হয়তো পরিণত হতে পারে ঐতিহাসিক মুহূর্তে। ছোট্ট সেই মুহূর্তটিই হয়তো ব্যঞ্জনা তৈরি করতে পারে ইতিহাসের। সত্তর-আশির দশকে বাংলাদেশের ফুটবল ছিল জমজমাট। ফুটবল দ্যোতনা তৈরি করত মানুষের মধ্যে। আবেগ-মথিত করে দিত হৃদয়। ওই সময়ের অনেক মুহূর্তই ধরা পড়েছে আলোকচিত্র সাংবাদিকদের টেলিলেন্সে। যে মুহূর্তগুলো, যে ঘটনাগুলো হয়তো আজকের দিনে ঐতিহাসিক হিসেবেই বিবেচিত। সেই ঘটনাগুলোর বেশির ভাগই হারিয়ে গেছে, নষ্ট হয়ে গেছে, চলে গেছে লোকচক্ষুর আড়ালে। ফুটবলের সেই স্বর্ণালি সময়ে হারিয়ে যাওয়া এমন একটি আলোকচিত্র এই প্রজন্মের পাঠকদের সামনে তুলে ধরার লোভটা তাই সংবরণ করা গেল না। আজ থেকে ৩০ বছর আগে তোলা এই ছবিটি যেকোনো বিচারেই ঐতিহাসিক। ছবিটিতে মিশে আছে ফুটবল নিয়ে সাধারণ মানুষের সেই সময়কার আবেগ আর এ দেশের ক্রীড়া ইতিহাসের এক ঐতিহাসিক মুহূর্তের অনুরণন।
ছবিটি যে ফুটবল কিংবদন্তি কাজী সালাউদ্দিনের, সেটা নিশ্চয়ই বোঝা যাচ্ছে। ১৯৮৪ সালের এই অক্টোবর মাসেই মাঠের ফুটবলকে বিদায় জানিয়েছিলেন এ দেশের ফুটবলের সর্বশ্রেষ্ঠ এই তারকা। বিদায়লগ্নে ঢাকা স্টেডিয়ামে উপস্থিত (বর্তমানের বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম) দর্শকদের উষ্ণ ও আন্তরিক ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছিলেন তিনি। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মোহামেডানকে সেদিন তিনি বেছে নিয়েছিলেন বিদায়-মঞ্চের প্রতিপক্ষ হিসেবে। কিন্তু কী আশ্চর্য! ‘জাতশত্রু’ আবাহনীর সেরা খেলোয়াড়ের বিদায়কে কোথায় উদযাপন করবে মোহামেডান সমর্থকেরা, তা না, উল্টো তাঁরাই সেদিন সালাউদ্দিনকে জানিয়েছিলেন আবেগমথিত আন্তরিক বিদায়। সেই দিনটি, সেই মুহূর্তটির কথা মনে করে আজও আবেগে-আপ্লুত হয়ে ওঠেন কাজী সালাউদ্দিন, আজকের ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি।
‘কী বলব, আমার খেলোয়াড়ি জীবনের শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত ছিল ওটা।’ স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে গলাটা যেন একটু কেঁপেই ওঠে সালাউদ্দিনের। তাঁর আবেগের মূল কারণ হচ্ছে, সেদিন তাঁর বিদায়লগ্নে ঢাকা স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে মোহামেডান অংশেই তিনি পেয়েছিলেন সবচেয়ে বেশি উষ্ণ অভ্যর্থনা ও বিদায়। যে দলটির ‘শত্রু’ হিসেবে গোটা খেলোয়াড়ি জীবনে খেলেছেন, যে দলটির বিপক্ষে একের পর এক গোল করে ভেঙে দিয়েছেন সমর্থককুলের হৃদয়, সেই মোহামেডান-সমর্থকেরাই তাঁর বিদায়ের দিনে তুমুল করতালির সঙ্গে তাঁকে প্রদর্শন করেছিলেন দাঁড়িয়ে সম্মান। ঘটনাটা সেই থেকে আজ পর্যন্ত ভুলতে পারেননি সালাউদ্দিন। বললেন, ‘ওটাই তো আমার ফুটবল ক্যারিয়ারের সেরা অর্জন।’ তাঁর ক্যারিয়ারের অর্জন, তারকাখ্যাতি, সবকিছুই হার মেনে যায় সেদিনের সেই ছোট্ট ঘটনাটিতে।
ছবিটি ভালো করে লক্ষ করুন। আবাহনীর জার্সি পরা সালাউদ্দিন দর্শক গ্যালারির সামনে দাঁড়িয়ে। গ্যালারিটা যে মোহামেডানের, সেটা এক কোনার ওই মোহামেডান-পতাকাটি দেখেই বোঝা যাচ্ছে। আরও একটু খেয়াল করুন, দেখবেন মোহামেডান-সমর্থকেরা প্রায় সবাই দাঁড়ানো। বিদায়ী ম্যাচটি শুরু হওয়ার আগে সালাউদ্দিন মাঠ প্রদক্ষিণ করে দর্শক অভিবাদনের জবাব দিচ্ছিলেন সেদিন। একপর্যায়ে মোহামেডান গ্যালারির সামনে এলে তিনি লক্ষ করেন দর্শকেরা সবাই দাঁড়িয়ে গেলেন। সেদিন মোহামেডান গ্যালারি থেকে নীরব করতালির যে আওয়াজটা সালাউদ্দিন পেয়েছিলেন, তা শুনেই তাঁর মনে হয়েছিল, ‘আমার খেলোয়াড়ি জীবন সার্থক।’
ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৮৪ সালের ১৯ অক্টোবর। পরদিন ২০ অক্টোবর দেশের সব জাতীয় দৈনিকে খেলার ফল ছাপিয়ে সালাউদ্দিনের বিদায়ই হয়ে উঠেছিল মূল খবর। তাঁর বিদায়ের বিভিন্ন ছবি ওই দিন বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপা হলেও প্রখ্যাত আলোকচিত্র সাংবাদিক রশীদ তালুকদারের তোলা এই ছবিটিই ছাপিয়ে যায় অন্য আর সবগুলোকে। আজকের দিনে আলোকচিত্র সাংবাদিকেরা যেসব যন্ত্রপাতি নিয়ে ঘোরেন, তার অনেক কিছুই হয়তো রশীদ তালুকদারের কাছে ছিল না, কিন্তু তার পরও কী অসাধারণ ছবিই না তিনি তুলেছেন।
কাজী সালাউদ্দিনের খেলোয়াড়ী জীবনের কিছু দুর্লভ ছবি দেখুন: