র্যাঙ্কিংয়ে ৬১ ধাপ এগিয়ে থাকা মালয়েশিয়াকে ৬–০ গোলে উড়িয়ে দিয়ে আবারও আলোচনায় বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল। দ্বিতীয় ম্যাচে গোলশূন্য ড্রয়ে ফিফা প্রীতি সিরিজ জয় সাবিনাদের সাফল্যের মুকুটে নতুন এক পালক। যে সাফল্যের বেশির ভাগই বয়সভিত্তিক পর্যায়ে, জাতীয় দলেও সেই ধারা বয়ে নিতে প্রয়োজন সারা দেশে খেলাটার বিস্তৃতি। এখন যা অনেকটাই বাফুফে ভবনকেন্দ্রিক হয়ে আছে।
‘যে পা রাঙা আলতা মাখে
সে পা ফুটবলও খেলে।’
১৯৭৮ সালে পাক্ষিক ক্রীড়াজগত–এ মেয়েদের ফুটবল নিয়ে এক প্রতিবেদনে ওপরের কথাটি লিখেছিলেন প্রয়াত ক্রীড়াবিদ ও ক্রীড়া সাংবাদিক সালমা রফিক। আজ বেঁচে থাকলে তিনি ভীষণ খুশি হতেন। যখন দেখতেন, র্যাঙ্কিংয়ে ৬১ ধাপ এগিয়ে থাকা মালয়েশিয়াকে বাংলাদেশের মেয়েরা হেলায় হারিয়ে দেন ৬-০ গোলে। সেই মালয়েশিয়ার সঙ্গে পরের ম্যাচ গোলশূন্য ড্র করে সাবিনা খাতুনরা দুই ম্যাচের ফিফা প্রীতি সিরিজ জিতে নেন।
১৯৭৭ সালে ফুটবলে যাত্রা শুরু হয়েছিল বাংলাদেশের মেয়েদের। মেয়েরা হাফ প্যান্ট পরে খেলবেন...অনেকেই যখন তা মেনে নিতে চাইতেন না। সমাজের সেই রক্ষণশীলতার পর্দা ছিঁড়ে ভিকারুননিসা নূন স্কুলের মেয়েদের নিয়ে এ দেশে প্রথম মেয়েদের ফুটবল অনুশীলন শুরু করেছিলেন প্রয়াত কোচ সাহেব আলী। আজ অনন্তলোকে নিশ্চয়ই তিনিও খুব খুশি। খুশি দেশের মানুষও। মেয়েরা ফুটবল খেলে একটা ভালো লাগার অনুভূতি ছড়িয়ে দিচ্ছেন চারপাশে।
যে ভালোবাসা অর্জন করে নিয়েছেন তাঁরা। ২০০৪ সালে বয়সভিত্তিক ফুটবল দিয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে পা ফেলার পর এখন পর্যন্ত আসা সাফল্য মূলত বয়সভিত্তিক স্তরেই। মেয়েরা এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ বিভাগে আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। খেলেছেন এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ চূড়ান্ত পর্বে। সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জেতাটা ডালভাত বানিয়ে ফেলেছেন মারিয়া মান্দারা। বিভিন্ন বয়সভিত্তিক স্তরে এ পর্যন্ত ৯১টি ম্যাচ খেলে জয় ৫২টিতে। হার ৩০টি। ড্র ৯।
তুলনায় বাংলাদেশে মেয়েদের জাতীয় দলটা দুর্বল। মাঝখানে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা দল ফিফা র্যাঙ্কিংয়েই ছিল না। জুনিয়র আর সিনিয়র দলে এমনই পার্থক্য যে ২০১৯ নেপাল এসএ গেমসে বাফুফে নারী দলই পাঠায়নি। ২০১০ সালে জাতীয় দলের আনুষ্ঠানিক যাত্রার পর যুগপূর্তির বছরে এসে দেখা যাচ্ছে, এ পর্যন্ত ৪৪টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে মেয়েরা জিতেছেন ১৪টিতে। ২৫টি হার। ৫টি ড্র। বয়সভিত্তিক স্তরে জয়ের রেকর্ড যেখানে ৫৭ শতাংশের বেশি।
আসলে হঠাৎ হঠাৎ চমকে দিলেও জাতীয় দলটা সেভাবে তৈরি করা যায়নি। কারণ, বয়সভিত্তিক দলে খেলা মেয়েরাই জাতীয় দলের জার্সিতে খেলেন, সেই নবীনেরা জাতীয় দলের ভার সেভাবে বহন করতে পারেননি। তবে আস্তে আস্তে তাঁরা পরিণত হচ্ছেন। মালয়েশিয়ার বিপক্ষে জয়ে সেটিরই প্রমাণ।
কদিন আগেই মালয়েশিয়ার ছেলেদের কাছে বাংলাদেশে হেরেছে ৪-১ গোলে। অন্যদিকে কী দাপুটে পারফরম্যান্স মেয়েদের! ছেলেরা বারবার হতাশ করেছেন, ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশ ২০০ ছুঁই ছুই, উল্টো দিকে মেয়েরা এনে দিচ্ছেন আনন্দের উপলক্ষ। এমনও তাই শোনা যায়, মেয়েরা আজ ছেলেদের অনুপ্রেরণা হতে পারেন। মেয়েরা নিজেদের সেই জায়গায় নিতে পেরেছেন বাফুফের নিবিড় পরিচর্যা পাওয়ায়। বলতে গেলে, মেয়েদের ফুটবল বাফুফে নামের একটা স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে। মেয়েদের ফুটবলে আজ বাংলাদেশের যা অর্জন, সবই বাফুফে ভবনকেন্দ্রিক কার্যক্রমের ফল।
বছরব্যাপী ৩০-৪০ জন মেয়েকে বাফুফে ভবনে রেখে একরকম লালন–পালনই করছে বাফুফে। ওই মেয়েরাই ঘুরে ঘুরে বয়সভিত্তিকসহ সব আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় খেলছেন। জাপান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশের অর্থায়নে অনূর্ধ্ব-১৪, ইউনিসেফের অর্থায়নে অনূর্ধ্ব-১৬ টুর্নামেন্ট হচ্ছে দেশে। কোচ গোলাম রব্বানী এবং তাঁর মেয়েদের আন্তরিক চেষ্টাও প্রশংসাযোগ্য।
বাফুফের নারী ফুটবল কমিটির প্রধান মাহফুজা আক্তার ফিফার কাউন্সিল সদস্য, তাঁর একটা প্রভাব আছে মেয়েদের ফুটবল উন্নয়নে। বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনও মেয়েদের ফুটবলের ব্যাপারে উদার। অন্য অনেক ব্যর্থতা ও সমালোচনা থাকলেও মেয়েদের ফুটবল নিয়ে বাফুফেকে সাধুবাদ জানাতেই হয়।
বাফুফের টেকনিক্যাল ডিরেক্টর পল স্মলি সারা বছর যুক্ত থাকছেন মেয়েদের দলের সঙ্গে। দলে একজন কোচ থাকলেও অলিখিত কোচ পল স্মলিই। নারী ফুটবল দলের সঙ্গে সার্বক্ষণিক উপস্থিতি তাঁর। বিদেশ সফরেও তিনি দলের সঙ্গী। পৃথিবীর আর কোনো দেশের টেকনিক্যাল ডিরেক্টর সে দেশের নারী দলকে কোচিং করান বলে শোনা যায়নি। কিন্তু পল স্মলি নারী ফুটবলের সঙ্গেই বেশি সম্পৃক্ত এবং এর কিছু সুফলও আসছে।
যদিও পল স্মলিকে কাজে লাগানো যেত নারী ফুটবলের সামগ্রিক অবকাঠামো উন্নয়নে। তা করা হয়নি বলে দেশে নারী ফুটবলের ভিতটা ভীষণ নড়বড়ে আজও। যথেষ্ট ফুটবলার নেই। সেই অর্থে নেই প্রয়োজনীয় অবকাঠামো। দেশে নারী কোচ তৈরি হচ্ছে না। মালয়েশিয়ার দলের সঙ্গে ঢাকায় আসা সে দেশের ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য দাতো সুরাইয়া বিনতে ইয়াকুবেরও তা চোখে পড়েছে, ‘বাংলাদেশের নারী ফুটবলার যতটা দেখেছি; সে তুলনায় নারী সংগঠক, কর্মকর্তা, কোচ, রেফারিসহ অন্য সব বিভাগে সংখ্যা একেবারেই কম। বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের ভাবা উচিত।’
ঘরোয়া খেলার সময়ই বাংলাদেশে নারী ফুটবলের বিবর্ণ ছবিটা বেরিয়ে পড়ে। প্রায় ৭ বছর পর ২০১৯ সালে লিগটা আবার চালু হয়ে দুটি আসর হয়েছে। কিন্তু লিগে প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই। বসুন্ধরা কিংস জাতীয় দলের প্রায় সবাইকে নিয়ে নেয়। আর প্রায় প্রতি ম্যাচ জেতে ১০-১২ গোলে। যা বুঝিয়ে দেয়, ব্যাপক খেলোয়াড়-সংকট। বাফুফের বেশির ভাগ কর্মকর্তাই বিভিন্ন ক্লাবের কর্ণধার। কিন্তু তাঁরা নারী ফুটবলের পৃষ্ঠপোষকতা করতে নারাজ। ছেলেদের দলের পেছনে ১০ কোটি টাকা খরচ করলেও ১০ লাখ টাকায় মেয়েদের টিম করতে বেশির ভাগ ক্লাবই অনীহ।
সাড়া ফেলা ময়মনসিংহের কলসিন্দুর স্কুল থেকেও এখন আর খেলোয়াড় উঠে আসছে না। মেয়েদের ফুটবলচর্চা সেখানে আগের মতো নেই। কিছু খেলোয়াড় উঠে আসছে মূলত বঙ্গমাতা টুর্নামেন্ট থেকে। এখন সময় এসেছে মেয়েদের মাঠের সাফল্যে আত্মতৃপ্ত না হয়ে খেলাটার একটা ভিত্তি তৈরি করার। বাফুফেকে সেদিকে নজর দিতে হবে। জেলা ক্রীড়া সংস্থা ও ক্লাবগুলোর এগিয়ে আসা উচিত। বিশেষ করে জেলাগুলোতে নারী ফুটবলের চর্চা বাড়ানো এখন সময়ের দাবি।
২০১৫ সালে নেপালে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ আঞ্চলিক (দক্ষিণ ও মধ্যাঞ্চল) চ্যাম্পিয়ন।
২০১৬ সালে তাজিকিস্তানে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ আঞ্চলিক (দক্ষিণ ও মধ্যাঞ্চল) চ্যাম্পিয়ন।
২০১৬ সালে ঢাকায় এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়ন হয়ে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৭ চূড়ান্ত পর্বে উত্তরণ।
২০১৭ সালে ঢাকায় অনূর্ধ্ব-১৫ প্রথম সাফ টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন।
২০১৮ সালে হংকংয়ে চার জাতি জকি কাপ (অনূর্ধ্ব-১৫) চ্যাম্পিয়ন।
২০১৮ সালে ভুটানে অনূর্ধ্ব-১৮ প্রথম সাফে টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন।
২০২১ ডিসেম্বরে ঢাকায় প্রথম সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন।
জাতীয় দল শিলিগুড়িতে ২০১৬ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে রানার্সআপ।