মেসিকে কি তাহলে টপকে গেলেন রোনালদো?
মেসিকে কি তাহলে টপকে গেলেন রোনালদো?

সর্বকালের সেরা রোনালদো, মেসি দ্বিতীয়

এ বিতর্কের কোনো শেষ নেই। সর্বকালের সেরা ফুটবলারের তর্কে এত এত নাম আছে যে ঝামেলা বাধতে বাধ্য। এই প্রজন্মে অবিশ্বাস্য ধারাবাহিকতা দেখানো ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো ও লিওনেল মেসিকে এই তর্কে এগিয়ে রাখতে চান তাঁদের সমর্থকেরা। ওদিকে তিনটি বিশ্বকাপ জেতা পেলেকে পেছনে ফেলবেন কীভাবে? একক কৃতিত্বে আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ এনে দেওয়া ডিয়েগো ম্যারাডোনা, কিংবা ফ্রান্সের অতৃপ্তি ঘোচানো জিনেদিন জিদানকেও কীভাবে পেছনে ফেলবেন কেউ?

এসব ক্ষেত্রে আবেগ, পছন্দ ভূমিকা রাখে বলে কখনো নিরপেক্ষ উত্তর পাওয়া সম্ভব নয়। অক্সফোর্ডের এক গণিতবিদ তাই অন্য পথে হেঁটেছেন। আবেগের ঊর্ধ্বে ওঠার উপায় হিসেবে নিজস্ব কিছু অ্যালগরিদম বেছে নিয়েছে। অ্যালগরিদমে বিভিন্ন মানদণ্ড রাখা হয়েছে। আর মানদণ্ডগুলো থেকে প্রাপ্ত নম্বর থেকেই তিনি দেখিয়েছেন, সর্বকালের সেরার প্রশ্নে রোনালদোই এগিয়ে আছেন।

ডক্টর টম ক্রফোর্ড

অক্সফোর্ডের সেইন্ট এডমুন্ড কলেজের ডক্টর টম ক্রফোর্ড বিভিন্ন প্রজন্মের ফুটবলারদের ক্যারিয়ারের বিভিন্ন অর্জন ও ভূমিকাকে সাতটি মানদণ্ডে ভাগ করে নিয়েছেন। তাঁর নিজের একটি অ্যালগরিদম সৃষ্টি করেছেন। এই অ্যালগরিদমে যে বিশ্বের সব ফুটবলারের নাম এসেছে, এমন নয়। এখানে তাঁদেরই বেছে নেওয়া হয়েছে, যাঁরা অন্তত দুটি ব্যালন ডি’অর জিতেছেন অথবা ১৯৫৬ সালে এই পুরস্কার চালু হওয়ার আগের সময়টার কিংবদন্তি বলে স্বীকৃত।

এতে তালিকাটা খুব ছোট হয়ে উঠেছিল। জিনেদিন জিদানও তাই স্থান পাননি ডক্টর ক্রফোর্ডের এই হিসাবে। সেখানে রোনালদো, মেসি, পেলে ও ম্যারাডোনার পাশাপাশি জায়গা পেয়েছেন শুধু নেদারল্যান্ডস ও এসি মিলান কিংবদন্তি মার্কো ফন বাস্তেন, আরেক ডাচ কিংবদন্তি ইয়োহান ক্রুইফ, হাঙ্গেরির ‘গ্যালোপিং মেজর’ ফেরেঙ্ক পুসকাস, রিয়াল মাদ্রিদ কিংবদন্তি আলফ্রেদো দি স্তেফানো, ব্রাজিল কিংবদন্তি রোনালদো নাজারিও এবং ফ্রান্স ও জুভেন্টাস কিংবদন্তি মিশেল প্লাতিনি।

অনেকের চোখে সেরার চোখে এ চারজনই এগিয়ে

ডক্টর টম ক্রফোর্ডের অ্যালগরিদমে সাতটি মানদণ্ড ছিল। সেগুলো হলো:

১. ক্লাব পর্যায়ে জেতা শিরোপা (ঘরোয়া ও ইউরোপিয়ান)। লিগগুলোর মানের ভিত্তিতে উয়েফা যে কো-এফিশিয়েন্ট সূচক দেয়, সেটি অনুযায়ী লিগের শক্তিমত্তা পয়েন্টে প্রভাব ফেলেছে।

২. জাতীয় দলে পাওয়া শিরোপা। বিশ্বকাপ জেতার জন্য ১৫০ পয়েন্ট, ইউরো বা কোপা আমেরিকা জেতার জন্য ১০০ পয়েন্ট। দল বেশি শক্তিশালী হলে পয়েন্ট কমবে। আবার দলের অর্জনে অবদান রাখলে, অর্থাৎ গোল্ডেন বল বা বুট জিতলে জুটবে আরও বাড়তি কিছু পয়েন্ট।

৩. ক্লাব ফুটবলে গোল।

৪. আন্তর্জাতিক ফুটবলে গোল।

৫. ব্যালন ডি’অরে পাওয়া ভোট। ব্যালন ডি’অর বিজয়ীর পাওয়া ভোটকে নির্দিষ্ট ওই বছরে পুরস্কারটির সেরা তিনে মনোনীত খেলোয়াড়েরা মিলে যত ভোট পেয়েছেন, সেটা দিয়ে ভাগ করে কত শতাংশ ভোট, সেটা বের করা হয়েছে।

৬. ব্যক্তিগত রেকর্ড—ক্লাব বা জাতীয় দলের হয়ে সর্বোচ্চ গোল কিংবা কোনো প্রতিযোগিতার সর্বোচ্চ গোলদাতা।

৭. ‘জেড-ফ্যাক্টর’ মৌসুম—এমন কোনো মৌসুম, যেটি গাণিতিকভাবে অবিশ্বাস্য, যেখানে খেলোয়াড়ের গোল দলের সাফল্যে ভূমিকা রেখেছে।

তুলনাটা হয়েছে এই ১০ জনের মাঝে

ক্রফোর্ডের অ্যালগরিদমে প্রাথমিক বাছাইয়ে যে ১০ জন খেলোয়াড়ের নাম এসেছে, তাঁদের মধ্যে প্রথম মানদণ্ডে রোনালদোই এগিয়ে। রিয়াল মাদ্রিদ, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ও জুভেন্টাসের হয়ে সাতটি লিগ ও পাঁচটি চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতে মেসির চেয়ে এগিয়ে আছেন। এই ক্ষেত্রে রোনালদো পূর্ণ ১০০ পয়েন্ট পাচ্ছেন। আর মেসি পেয়েছেন ৮৩ পয়েন্ট। নাপোলিকে দুটি লিগ ও একটি উয়েফা কাপ জেতানো ম্যারাডোনা এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে কম ১০ পয়েন্ট পেয়েছেন।

দ্বিতীয় মানদণ্ডে পেলে, ম্যারাডোনাদের টপকে গেছেন ‘ফেনোমেনন’—রোনালদো। দুই বিশ্বকাপ ও দুই কোপা আমেরিকাজয়ী ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি স্ট্রাইকার পূর্ণ ১০০ পয়েন্ট পেয়েছেন এখানে। জাতীয় দলের হয়ে কোনো অর্জন না থাকায় ডি স্টেফানো, পুসকাস ও ক্রুইফ এখানে পেয়েছেন ০। জাতীয় দলের হয়ে যাঁরা কিছু জিতেছেন, তাঁদের মধ্যে রোনালদোর পয়েন্ট সবচেয়ে কম (১১), তাঁর ঠিক ওপরে মেসি (২৮)। পেলে (৬৬) ও ম্যারাডোনা (৫৪) আছেন দুই ও তিনে।

ম্যাচ প্রতি গোলের ক্ষেত্রে পুসকাস ছিলেন অবিশ্বাস্য

ক্লাব পর্যায়ে গোলের রেকর্ড এখন রোনালদোর। কিন্তু ম্যাচপ্রতি গোলে রোনালদোর চেয়ে এগিয়ে আছেন অন্য কিংবদন্তিরা। ক্লাব ক্যারিয়ারে ৬২৯ ম্যাচে ৬২৫ গোল করে শীর্ষে আছেন পুসকাস। তাঁর ১০০ পয়েন্টের সঙ্গে পাল্লা দিয়েছেন ৬৫৯ ম্যাচে ৬৪৩ গোল করা পেলে (৯৮ পয়েন্ট)। এ ক্ষেত্রে মেসি (৮৪ পয়েন্ট) এগিয়ে আছেন রোনালদোর চেয়ে। সবচেয়ে কম পয়েন্ট প্লাতিনি ও ম্যারাডোনার (২৫)। সর্বকালের সবচেয়ে ভয়ংকর স্ট্রাইকারদের একজন হয়েও রোনালদো নাজারিও পেয়েছেন ৩৬ পয়েন্ট!

জাতীয় দলের গোলের ক্ষেত্রে মাত্রই বিশ্ব রেকর্ড গড়া রোনালদোই এগিয়ে। তাঁর ১০০ পয়েন্টের চেয়ে অনেক পিছিয়ে পেলে (৬৯ পয়েন্ট)। মেসি আছেন তিনে (৬৮ পয়েন্ট)। এই মানদণ্ডে সবচেয়ে কম পেয়েছেন বাস্তেন (২২)।

ব্যালনে ভোট পাওয়ায় এগিয়ে আছেন পেলে

ইউরোপের বাইরে জন্ম বলে নিজেদের সময়ে ব্যালন ডি’অর পাননি পেলে-ম্যারাডোনারা। পরে ২০১৫ সালে ওই সময়ে ওই নিয়ম না থাকলে কারা ব্যালন ডি’অর পেতেন, সে তালিকা দিয়েছিল ব্যালন ডি’অরের আয়োজক প্রতিষ্ঠান ফ্রান্স ফুটবল। তখন বলা হয়েছিল, পেলে পেতেন ৭টি ব্যালন ডি’অর, ম্যারাডোনা ২টি। ক্রফোর্ডের অ্যালগরিদমেও এখানে বিজয়ী বছরে ভোটের হিসাবে পেলেই এগিয়ে (১০০ পয়েন্ট)।
পেলে ৭টি ব্যালন ডি’অর পেতেন, কিন্তু সত্যি সত্যি তো পাননি। সত্যিকার দুনিয়ায় সর্বোচ্চ ৬টি ব্যালন ডি’অর জেতা মেসি আছেন দুইয়ে (৯৬ পয়েন্ট)। পাঁচটি ব্যালন ডি’অর জেতা রোনালদো (৭৮ পয়েন্ট) আছেন তিনে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে পিছিয়ে ম্যারাডোনা (২৮)।

পাঁচটি বিশ্ব রেকর্ড নিজের দখলে রাখা রোনালদো ষষ্ঠ মানদণ্ডে এগিয়ে আছেন। ৫৬ পয়েন্ট নিয়ে দুইয়ে আছেন পেলে। ৪৪ পয়েন্ট নিয়ে তিনে আছেন মেসি। আর ২২ পয়েন্ট নিয়ে চারে আছেন পুসকাস। বাদবাকিদের দখলে বর্তমানে কোনো রেকর্ড না থাকায় তাঁরা এ ক্ষেত্রে কোনো পয়েন্ট পাননি।

সর্বশেষ মানদণ্ড ছিল ‘জেড ফ্যাক্টর’। এমন মৌসুম, যেখানে ফুটবলার এত অবিশ্বাস্য খেলেছেন যে সংখ্যাটাকে অবিশ্বাস্য মনে হয়। আবার কোনো মৌসুমে একাই দলকে টেনেছেন। ২০১৩–১৪ মৌসুমে ১৭ গোল করে রিয়াল মাদ্রিদকে চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতানো রোনালদো যেমন সে মৌসুমে ২ দশমিক ৪ জেড ফ্যাক্টর পয়েন্ট পেয়েছেন। মেসি ২০১২ সালে এক বছরে ৯১ গোল করেছিলেন, এর মধ্যে ২০১১–১২ মৌসুম দেখেছে ৭৩ গোল। সে মৌসুমের জন্য মেসি পেয়েছেন ৩ দশমিক ১ জেড ফ্যাক্টর পয়েন্ট। আয়াক্সের হয়ে ১৯৬৬–৬৭ মৌসুমের জন্য ক্রুইফ পেয়েছেন ৩ দশমিক ১ পয়েন্ট।

এই পয়েন্টের সঙ্গে মৌসুমে দলের সাফল্যে তাঁদের অবদানের ওপর নির্ভর করে পয়েন্ট পেয়েছেন সবাই। বার্সেলোনার হয়ে ১০ লিগ ও ৪টি চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতা মেসি অনেক বড় ব্যবধানে এগিয়ে এখানে। মেসির চেয়ে অনেকটাই পিছিয়ে আছেন রোনালদো (৭১ পয়েন্ট)। তিনে আছেন বাস্তেন (৫৭)। সবচেয়ে কম পয়েন্ট পেয়েছেন প্লাতিনি (১০)।

আন্তর্জাতিক ফুটবলে সবচেয়ে বেশি গোলের (১১১) রেকর্ড গড়েছেন রোনালদো

কিন্তু সব মিলিয়ে রোনালদোকে টপকাতে পারেননি মেসি। ৫৩৭ পয়েন্ট পেয়ে সেরা রোনালদোই। ৫০৩ পয়েন্ট নিয়ে দুইয়ে আছেন মেসি। ৪৫৯ পয়েন্ট নিয়ে পেলে আছেন তিনে। এরপর ধাপে ধাপে পুসকাস (৩০৫), রোনালদো নাজারিও (২৮১), ফন বাস্তেন (২৩৭), দি স্তেফানো (২০১), প্লাতিনি (১৭৭), ম্যারাডোনা (১৬৯) ও ক্রুইফ (১৬৩)।

নিজের এই অ্যালগরিদম নিয়ে ডক্টর ক্রফোর্ডের ব্যাখ্যা, ‘কড়া ফুটবল–ভক্ত হিসেবে বন্ধুদের সঙ্গে বহুবার কে সর্বকালের সেরা, এ নিয়ে তর্ক করেছি। গত কয়েক বছরে গণিতকে সবার কাছে নেওয়ার কাজটা করে বেশ আনন্দ পাচ্ছি। তাই ফুটবল বিশ্বকে এটা ব্যবহার করে দেখানোতেও বেশ মজা পেলাম। আমার অ্যালগরিদমে রোনালদো শীর্ষে থাকলেও এটা তো নিশ্চিত, অন্যদের সংখ্যাগুলোও অবিশ্বাস্য এবং আমি নিশ্চিত, তর্ক চলতেই থাকবে!’

সেটা চলারই কথা। কারণ, ডক্টর ক্রফোর্ড স্বীকার করেছেন, তাঁর কাছে গোল বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। এ কারণে ম্যারাডোনা বা ক্রুইফ অনেকাংশেই পিছিয়ে পড়েছেন। ফলে মিডফিল্ডার, ডিফেন্ডার বা গোলকিপারদের যে এ ক্ষেত্রে কোনো সুযোগই নেই।