শাখতার দোনেৎস্ককে হারিয়ে শেরিফের খেলোয়াড়দের উচ্ছ্বাস
শাখতার দোনেৎস্ককে হারিয়ে শেরিফের খেলোয়াড়দের উচ্ছ্বাস

চ্যাম্পিয়নস লিগ

শেরিফ নামের জমিদারের ‘রূপকথা’র গল্প

একটু কল্পনার রথ ছোটানো যাক—ধরুন, বাংলাদেশের অমুক জেলা নিজেদের স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে দাবি করে। নিজস্ব সরকার, সংবিধান, পতাকা, জাতীয় সংগীত, মুদ্রা, সশস্ত্র বাহিনী—সবই আছে। কিন্তু পৃথিবীর কোনো দেশ সেই জেলাকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। জাতিসংঘের স্বাধীন দেশের তালিকায়ও নাম নেই। গোটা বিশ্বের চোখে অঞ্চলটি বাংলাদেশেরই অংশ। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় অনেকে সেই অঞ্চলকে বলতে পারেন ‘ডি ফ্যাক্টো’ রাষ্ট্র—অর্থাৎ কার্যত স্বাধীন দেশ, কিন্তু সে স্বাধীনতার স্বীকৃতি নেই।

কল্পনার রথ এখানেই না থামিয়ে বরং আরেকটু গতি বাড়ানো যাক। ধরুন, স্বাধীন হিসেবে দাবি করা সেই জেলার প্রধান শহরের একটি ক্লাব প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবলে। যেনতেনভাবে অংশ নেওয়া নয়, রীতিমতো সেখানে দাপটও দেখায়!

ধরুন, সেই দাপটের ঢেউ দেশের ফুটবলের সীমানা ছাপিয়ে আছড়ে পড়ল এশিয়া মহাদেশের সেরা ক্লাব প্রতিযোগিতা—এএফসি চ্যাম্পিয়স লিগে। অর্থাৎ, দেশের মধ্যে ‘দেশ’ দাবি করা সেই অঞ্চলের ক্লাবটি এ টুর্নামেন্টে খেলার যোগ্যতা অর্জন করল। আর শুধু যোগ্যতা অর্জন করেই আত্মতুষ্টিতে ভোগেনি, চ্যাম্পিয়নস লিগে অভিষেক ম্যাচে জয়ও তুলে নিল!

এবার কল্পনার রথ থামিয়ে একটু দম নেওয়া যাক। বাংলাদেশের ফুটবলের মান বিচারে বিষয়টি কল্পনাতেও বদহজমের ঝুঁকি থাকে। কিন্তু ইউরোপিয়ান ক্রীড়াঙ্গনে আহামরি কিছু নয়। চ্যাম্পিয়নস লিগে তো নয়–ই। ইউরোপসেরা ক্লাবের এই প্রতিযোগিতায় বড় ক্লাবগুলো ফি মৌসুম ‘পচা শামুকে পা’ হড়কায়। শেরিফ তিরাসপোল এখনো তেমন কিছু করেনি। কিন্তু কল্পনার রথ ছুটিয়ে যে উদাহরণ দেওয়া হলো, ঠিক এ কারণেই ক্লাবটি এখন ইউরোপে আলোচিত।

গুগলে এই ক্লাবের নাম সার্চ করলে দেখাবে মলদোভান ক্লাব—তিরাসপোলে অবস্থিত। কাগজে–কলমে স্বীকৃত ইতিহাস বলছে, মলদোভার প্রথম ক্লাব হিসেবে এবার চ্যাম্পিয়নস লিগের মূল পর্বে খেলছে শেরিফ। ভেতরের খবর হলো, ক্লাবটি মলদোভার মধ্যে কার্যত স্বাধীন রাস্ট্র হিসেবে দাবি করা ট্রান্সনিসত্রিয়ার প্রধান শহর তিরাসপোলে অবস্থিত। পৃথিবীর মানচিত্রে মলদোভান–ইউক্রেনিয়ান সীমান্তে অবস্থিত এই ট্রান্সনিসত্রিয়ার আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে কোনো অস্তিত্ব নেই। পুরো বিশ্বের চোখে ট্রান্সনিসত্রিয়া মলদোভারই অংশ। ১৯৯৭ সালে প্রতিষ্ঠিত শেরিফ খেলে মলদোভান লিগে, চ্যাম্পিয়নও হয়েছে ১৯ বার।

শাখতারের জালে প্রথম গোলের পর শেরিফের খেলোয়াড়দের উচ্ছ্বাস

সেই শেরিফ কাল চ্যাম্পিয়নস লিগ অভিষেকে প্রতিবেশী ইউক্রেনের অন্যতম জনপ্রিয় ক্লাব শাখতার দোনেৎস্ককে ২–০ গোলে হারিয়ে রূপকথার জন্ম দিয়েছে। কাল শেরিফের জয়ের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্লাবটি আলোচিত হয়েছে আরও একটি কারণে। গায়ে তেল মেখে আলোচনা–রসিকতার জন্ম দেওয়া উলভারহ্যাম্পটনের স্ট্রাইকার আদামা ত্রায়োয়ের মতো শেরিফেরও একজন আদামা ত্রায়োয়ে আছে—তিনিও গায়ে তেল মাখেন কি না জানা যায়নি—শাখতারের বিপক্ষে গোলও পেয়েছেন। আর তাঁকে দিয়ে গোলটি করিয়েছেন ক্রিস্টিয়ানো। না, নামের বাকি অংশ ‘রোনালদো’ নয়—দি সিলভা লেইতে। টুইটারে রসিকতা চলেছে, শেরিফের তাহলে নিজস্ব ত্রায়োরে ও ক্রিস্টিয়ানো আছে!

নিজস্ব—এই শব্দটা শেরিফের সঙ্গে মানানসই। ট্রান্সনিসত্রিয়া মলদোভার অংশ হলেও সেখানকার কেউ পারতপক্ষে তা স্বীকার করতে নারাজ। নিজস্ব মুদ্রা ট্রান্সনিসত্রিয়ান রুবল, লাল ও সবুজ রঙের কাস্তে–হাতুড়ির নিজস্ব পতাকা এবং সুপ্রিম সোভিয়েত নামে নিজস্ব সরকারব্যবস্থাও আছে তাদের। নাকে একটু সোভিয়েত সোভিয়েত গন্ধ লাগলে ঠিকই ধরেছেন। ট্রান্সনিসত্রিয়ার রাজধানী তিরাসপোলের রাস্তায় কাস্তে–হাতুড়ির ব্যানার এবং সেই টেকো–গুঁফো বিপ্লবী লোকটার (লেনিন) বিশাল ছবি সগৌরবে শোভা পায়। ট্রান্সনিসত্রিয়ার আইনসভার সামনেই রয়েছে লেনিনের ছবি। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন খণ্ড খণ্ড হওয়ার পর একটি খণ্ডে মলদোভা নামে স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। সেই ভূখণ্ডের মধ্যেই নিস্ত্রে নদীর তীরে অনানুষ্ঠানিক গৌরব নিয়ে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের স্মৃতি জাবর কাটে ট্রান্সনিসত্রিয়া।

শাখতারের বিপক্ষে শেরিফের প্রথম গোলটি করছেন আদামা ত্রাওরে

ট্রান্সনিসত্রিয়া ও শেরিফের নিজস্বতাটুকু এককথায়ও বোঝানো যায়—মলদোভা গোটা ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে গরিব দেশ। কিন্তু ট্রান্সনিসত্রিয়া ভূখণ্ডে এর ছাপ লাগেনি। কাল রাতে শাখতার যে স্টেডিয়ামে খেলল—শেরিফ এস্তাদিওন—সেটি ‘স্টেট অব দ্য আর্ট’ স্থাপত্য, তৈরিতে খরচ ‘মাত্র’ ২০ কোটি ডলার। ভেবে দেখুন, এমন একটি স্টেডিয়ামে অনুশীলন করা একটি দল যে লিগে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে, সেখানকার বাকি দলগুলো অনুশীলন করে জীর্ণশীর্ণ মাঠে (স্টেডিয়ামও নয়), কিছু মাঠকে ঢাকা শহরের ঘাসবিহীন ছাল–চামড়া উঠে যাওয়া মাঠের সঙ্গেও তুলনা করা যায়। আশপাশ জঞ্জালে ভরা, সমর্থকেরা মেরেকেটে ১৫–২০ জন!

মলদোভার লিগে বাকি ক্লাবগুলো যেখানে স্থানীয় খেলোয়াড় নিতেই হিমশিম খায়, শেরিফ সেখানে আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, পূর্ব ইউরোপ থেকে খেলোয়াড় উড়িয়ে আনে। খেলোয়াড়দের মাসিক বেতনেই ন্যূনতম ১৫ হাজার ডলার করে খরচ করে ক্লাবটি, সেখানে তাদের ঘরোয়া প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর খেলোয়াড়েরা বড়জোর কয়েক শ ডলার পান—সেটিও যদি বেতনটা নিয়মিত হয়! উদাহরণস্বরূপ, ঐতিহাসিকভাবে মলদোভার সবচেয়ে বড় ক্লাব জিমব্রু চিজিনাও–এর কথা বলা যায়। তাদের স্টেডিয়াম ভাড়া করে অনুশীলন করে মলদোভার জাতীয় দল—এই ভাড়াই জিমব্রু চিজিনাওয়ের টিকে থাকার একমাত্র অবলম্বন।

শাখতারের বিপক্ষে শেরিফের দ্বিতীয় গোলটি করে মমো ইয়াসানের উৎসব

তাহলে সেই গরিবখানায় শেরিফের শান–শওকতের হেতু কী? উত্তরে বলা যায়, নামেই পরিচয়! ক্লাবটির প্রধান স্পনসর ট্রান্সনিসত্রিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান—শেরিফ। নব্বই দশকের সেই ‘স্নায়ুযুদ্ধ’কালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর এই প্রতিষ্ঠানের গোড়াপত্তন করেছিলেন রাশিয়ার সাবেক গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবির দুই এজেন্ট ভিক্টর গুশান ও ইলিয়া কাজমালি। মলদোভা এমনিতেই ইউরোপে অন্যতম কুখ্যাত চোরাচালান–রুট হিসেবে পরিচিত। অস্ত্র, ওষুধ, জাল সিগারেট—কী চোরাচালান হয় না!

নিউইয়র্ক টাইমস–এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৬ সালে ট্রান্সনিসত্রিয়ার আমদানি পরিসংখ্যান জরিপ করে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ বাহিনী জানায়, ওই অঞ্চলের মানুষ প্রতিবছর অন্তত ২০০ পাউন্ড করে হিমায়িত মুরগির রান চিবোন। ওদিকে মলদোভার মানুষের ‘নাই নাই’–এর শেষ নাই! শেরিফের সহপ্রতিষ্ঠাতা ভিক্টর গুশান একবার জানিয়েছিলেন, চোরাচালানে তাঁর প্রতিষ্ঠানকেও হাত–পা নাড়াচাড়া করতে হয়েছে। বাকিটা বুঝে নিন।

ট্রান্সনিসত্রিয়ায় মূলত সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করে এই প্রতিষ্ঠান। মলদোভার সংবাদকর্মী ও ধারাভাষ্যকার ইওন জালবার ভাষায়, ‘ট্রান্সনিসত্রিয়ার সবাই শেরিফ তিরাসপোলিসের জন্য। তিরাসপোলিসে সবকিছু এই প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।’ কথার সত্যতাও আছে—চেইন সুপারমার্কেট, গ্যাস স্টেশন, ওয়াইন তৈরির কারখানা, টিভি চ্যানেল এবং ফোন নেটওয়ার্কও আছে। ট্রান্সনিসত্রিয়ার মোড়ে মোড়ে শেরিফের গ্যাস স্টেশন।

ম্যাচ শেষে শেরিফের খেলোয়াড়দের জয়োচ্ছ্বাস

তবে রাজনৈতিক মতভেদ থাকলেও মলদোভার ফুটবল ফেডারেশন এবং শেরিফের মধ্যে দহরম–মহরম চূড়ান্ত রকম। মলদোভারই ফুটবল সংবাদকর্মী ক্রিস্টিয়ান জার্দানের ভাষায়, ‘এখানে ফুটবল পুরোপুরি শেরিফের নিয়ন্ত্রণে।’ একটা উদাহরণ দেওয়া যায়। চ্যাম্পিয়নস লিগ বাছাইপর্বে শেরিফ তিরাসপোল যেন ভালোভাবে প্রস্তুতি নিতে পারে, সে জন্য এ মৌসুমে লিগের খেলাও স্থগিত করেছে দেশটির ফেডারেশন। এমনকি দলটির স্কোয়াড শক্তিশালী করতে লিগে বিদেশি খেলোয়াড় খেলানোর নিয়মও পাল্টানো হয়েছে।

মলদোভার সাবেক ফুটবলার ও ফেডারেশনের সহসভাপতি ইওন তেস্তেমিতানুর ভাষায়, ‘মলদোভায় অন্য কোনো দলের প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ নেই।’ কীভাবে? গত বছর মলদোভার দুর্নীতি তদন্তকারী সংস্থা দেশটির লিগে কমপক্ষে ২০টি ম্যাচে পাতানো খেলার প্রমাণ খুঁজে পায়। লিগের এই তথ্য ফাঁসকারীদের মধ্যে একজন স্থানীয় সংবাদমাধ্যমকে বলেছিলেন, খেলোয়াড়দের ‘খেলার চেয়ে আয়ে মনোযোগ দিতে বলা হয়।’ এসব অভিযোগ সরাসরি শেরিফের দিকে না উঠলেও নিয়ন্ত্রণ মহলের অন্যতম তো তাঁরাই!

চ্যাম্পিয়নস লিগে শেরিফ তিরাসপোলের ‘রূপকথা’ কত দূর লেখা হবে, তা এখনো অজানা। ঘরে যা-ই ঘটুক, অন্তত ইউরোপের ময়দানে তাদের শুরুটা হলো দুর্দান্ত। এই টুর্নামেন্টের গ্রুপ পর্বে খেলার জন্য ২ কোটি ডলার পাবে দলটি। তাতে মলদোভা লিগের কোনো উন্নতি হবে না। স্থানীয় ফুটবলারদের জীবনেও হবে না কোনো পরিবর্তন। কিন্তু শেরিফের ‘বিশ্বমানের একাডেমি’র সুযোগ–সুবিধা আরও বাড়বে, তরতর করে এগোবে দলটির ভবিষ্যৎ–রথ।

অভুক্ত প্রজার করুণ চোখ বিলাসী জমিদারের আয়েশি জীবন দেখেই যাবে শুধু, চোখ রাঙাতে তো আর পারবে না।