বিশ্বকাপের প্রথম দৌড়েই মেসিকে অনেক পেছনে ঠেলে দিলেন রোনালদো।
প্রথম ম্যাচে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো করলেন হ্যাটট্রিক আর লিওনেল মেসি করলেন পেনাল্টি মিস। পেনাল্টি নষ্ট করার মূল্য চুকিয়ে আর্জেন্টিনা ড্র করল আইসল্যান্ডের সঙ্গে। এটি নিশ্চিত করেই চাপ বাড়িয়ে দিল আর্জেন্টিনা দলের ওপর। আর্জেন্টিনার আকাশে এখন একখণ্ড কালোমেঘ। ক্রোয়েশিয়া ও নাইজেরিয়ার সঙ্গে পরবর্তী দুই ম্যাচে ভালো করতে না পারলে কী হবে তা নিয়েই উদ্বিগ্ন আকাশি-নীল শিবির।
খেলা শুরুর আগে প্রেসবক্সের ঠিক ওপরের বাঁ প্রান্ত থেকে যেন ঝড় উঠল। সবার চোখ সেদিকে। দর্শকেরা দৌড়ে যাচ্ছেন। হাজার হাজার মোবাইল ফোন সেদিকে তাক করে আছে। ক্যামেরার শাটার টেপার অবিরাম শব্দ। ব্যাপারখানা কী? ডিয়েগো ম্যারাডোনা এসেছেন। হ্যাঁ, ওই তো ম্যারাডোনা, কালো শুট , কালো চশমা। এসেই দুই হাত উত্তোলিত করে দর্শকদের বলছেন দলকে সমর্থন জানাও। হই হই করে আকাশি-নিল জনসমুদ্র ম্যাক্সিকান তরঙ্গ তুলল। ‘ভামোস আর্জেন্টিনা’ কণ্ঠে নিয়ে নাচল।
১৯ মিনিটে মার্কোস রোহোর ‘মিস হিট’ থেকে বল পেয়ে সার্জিও আগুয়েরো অসাধারণ এক গোল করলেন। পেছনে তাকিয়ে দেখা গেল, সাবেক জামাতার প্রথম বিশ্বকাপ গোল দেখে ম্যারাডোনা বিমোহিত। উঠে দাঁড়িয়ে ডান হাতটা বন বন করে ঘোরাচ্ছেন। পাল্টা আক্রমণে ৪ মিনিটের মধ্যেই আইসল্যান্ডের একমাত্র ফরোয়ার্ড আলফ্রেড ফিনবোগাসন গোল করে বসলেন আর্জেন্টাইন রক্ষণের শ্লথ প্রতিক্রিয়ায়। ম্যারাডোনা এবার চুপ চাপ। গ্যালারির আকাশি-নীল ঢেউ নির্জীব।
৬৪ মিনিটে গ্যালারি যেন হাতের মুঠোয় প্রাণ নিয়ে বসে রইল। আগুয়েরোকে বক্সে আইসল্যান্ডের রক্ষণভাগের এক খেলোয়াড় ফেলে দিলে পেনাল্টি পায় আর্জেন্টিনা। ম্যারাডোনাও দাঁড়িয়ে পড়েছেন। মেসি পেনাল্টি থেকে গোল করলেই এগিয়ে যায় আর্জেন্টিনা। কিন্তু করলেনটা কী? গোলকিপার হানেস হলডরসন পেনাল্টি ঠেকিয়ে দিলেন। আসলে এমন দীর্ঘদেহী গোলকিপারের বিপক্ষে যে উচ্চতায় কিক মারতে হয়, মেসি সেটি করেননি। বলটা যায় তাঁর বুক সোজা উচ্চতায়। এসব ক্ষেত্রে গোলকিপারকে বিভ্রান্ত করে শট নিতে হয় দুই পোস্টের যেকোনো দিকে, সেটিও হয়নি। তাই আইসল্যান্ডারদের উল্লাসের এক পাশে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন আর্জেন্টিনার ত্রাণকর্তা।
খেলার শুরুর আগে কতকগুলি ব্যানার দেখা গিয়েছিল স্পার্তাক মস্কো স্টেডিয়ামে, একপাশে আর্জেন্টাইন পোপ ফ্রান্সিসকোর ছবি, অন্যপাশে যিশু খ্রিষ্টের আলোর বিভায় লিওনেল মেসি। পোপেও কিছু হলো না, নতুন যিশুতেও না। ম্যারাডোনা বসে পড়লেন ধপাস করে। বাকি ২৬ মিনিটে আর্জেন্টিনা অনেক চেষ্টা চালিয়েছে আইসল্যান্ড শিবিরে। গোল আর পায়নি। আইসল্যান্ডাররা দাঁতে দাঁত কামড়ে লড়ে গেছে। একটুকরো জায়গাই দিতে চায়নি তারা আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ডদের। মেসিকে তো একেবারে পুলিশি পাহারায় রেখেছিলেন অ্যারন গুনারসন এবং হরদুর মাগনুসন।
খেলা শেষ হওয়ার পর প্রেসবক্সের পাশ দিয়ে বেরোনোর সময় কয়েকজন আর্জেন্টাইন সমর্থকের মুখ দিয়ে সুরার গন্ধ পাওয়া গেল। পা টলছে দুজনের। মাঠ থেকে মেসিরা তখনো বের হননি। সেদিকে আঙুল তুলে কর্কশ স্বরে কী যেন বললেন ওরা। আকাশি-নীল সমর্থকদেরই একজন অনুবাদ বলল, ওগুলো লেখার অযোগ্য গালি। হোরেসিও নামের ওই ভদ্রলোকের হাত ধরে চলেছে কিশোর পুত্র। তার দুই চোখে আসন্ন বৃষ্টির আভাস। মাথায় হাত বুলিয়ে বাবা দিলেন সান্ত্বনা, ‘এ ম্যাচে জয় আসেনি, দেখে নিয়ো পরের দুই ম্যাচে ঠিক আসবে।’ হোরেসিও স্বগতোক্তি করে চলেছেন, লিও আজ ভালো খেলেনি।
অথচ ম্যাচ শুরুর আগে স্পার্তাক মস্কো স্টেডিয়ামের যে আবহ ছিল তাতে মনে হচ্ছিল, আইসল্যান্ডের আজ বিশ্বকাপ বোধনেই বিসর্জন হবে মস্কোভা নদীতে। যেদিকে তাকানো যায় নীল-সাদা নীল-সাদা। কত হাজার বালক মেসি, কিশোর মেসি, কিশোরী মেসি, তরুণী মেসি, তরুণ এবং প্রবীণ মেসির যে আগমন— কে পারে তা গুনতে।
আর্ট কলেজ থেকে সদ্য পাশ করা ইউলিয়া রংতুলি আর রঙের বাক্স নিয়ে দর্শকদের মুখে মিনিয়েচার পতাকা এঁকেই তাঁর পার্স ভরে ফেললেন। একেকটি পতাকা আঁকার সম্মানী তিন শ রুবল। ইউলিয়াকে দেখে সেখানেই রং তুলি বসে গেলেন মারিয়াম আর মাফা। তাঁদের রমরমা ব্যবসা। বলা বাহুল্য, ১৯টি আর্জেন্টাইন পতাকার আঁকার অর্ডার এলে আইসল্যান্ডের পতাকা আঁকার অর্ডার এল একটি।
আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে কয়েকজন আর্জেন্টাইন সাংবাদিকের সঙ্গে রসিকতা করে বলা হলো আজ তো মেসিরও হ্যাটট্রিক দেখব মনে হয়। ওঁরাও কম যান না, ‘না না, শুধু হ্যাটট্রিকে মেসির চার গোল দেখবেন।’ তিনের জবাব চার গোলে। আগের দিন সোচিতে স্পেনের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করে বিশ্বকাপ মাতিয়ে দিয়েছেন রোনালদো। রোনালদোর জবাব দিতে গেলে তো চার গোল মেসিকে করতেই হয়।
হায়, কী অদৃষ্ট কিংবা নিয়তি! মেসি গোল দূরে থাক, বার্সেলোনার অভ্যাসমতো এই প্রথম বিশ্বকাপে পেনাল্টি মিস করলেন। কেউ কেউ বলছিলেন, কতগুলো সেক্টরে আর লড়বে এলএম-টেন, আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ জেতানো, নিজেকে প্রমাণ করা, আবার রোনালদোর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা। মেসির ওপর অনন্ত চাপ।
কিন্তু দিন শেষে সত্যটা হলো, মেসিরা পারলেন না জয় দিয়ে বিশ্বকাপ শুরু করতে। আইসল্যান্ডের অতিরক্ষণাত্মক খেলা তো ছিলই। মেসি করলেন পেনাল্টি মিস। আর্জেন্টিনার খেলায় আরেকটি দুর্বলতাও কিন্তু ধরা পড়েছে, সে হলো মন্থর গতিতে গোল করার প্রক্রিয়াটা (বিল্ড আপ) শুরু করা। আইসল্যান্ডের মতো প্রতিপক্ষরা এ রকম রক্ষণাত্মক থাকবেই। দরকার দ্রুত ‘বিল্ড আপ’ খেলা। দুই উইং ব্যাক ধরে আক্রমণের ঝড় বইয়ে দেওয়া। রোনালদোরা আগের দিন যেমন খেলেছেন। তাই মাত্র ৩৭ শতাংশ বলের দখল রেখেও পাল্টা আক্রমণে পর্তুগাল ছিল ভয়ংকর। ভয়ংকর হয়ে মাঠে বিচরণ করেছিলেন রোনালদো। মেসি সেটি আজ পারেননি!