তখন গোটা বিশ্ব রোনালদোয় বুঁদ। ডাচ ক্লাব পিএসভি আইন্দহোভেনের হয়ে গোলের বন্যা ছুটিয়ে যাচ্ছেন ব্রাজিলিয়ান স্ট্রাইকার রোনালদো। স্বাভাবিকভাবেই, বিশ্বের বড় ক্লাবগুলোর নজরে এলেন তিনি। শেষমেশ রোনালদোকে পাওয়ার লড়াইয়ে জিতে যায় বার্সেলোনা। বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম খেলোয়াড়টা হয়ে গেলেন বার্সেলোনার। কাতালানরা রোনালদোকে ঘিরে ভবিষ্যতের পরিকল্পনা সাজিয়ে বিশ্ব ফুটবলে নিজেদের কর্তৃত্ব কায়েম করবে কী, উল্টো এক বছর পর বার্সেলোনাকে বিদায় জানিয়ে রোনালদো নাম লেখালেন ইন্টার মিলানে।
দলের সবচেয়ে প্রতিভাধর খেলোয়াড়কে কেন এভাবে হারিয়েছিল বার্সেলোনা? বছরের পর বছর ধরে এই নিয়ে অনেক কাহিনি প্রচলিত আছে। সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য কারণ, রোনালদো আর তাঁর মুখপাত্রকে চটিয়ে দিয়েছিল বার্সেলোনা। কথায় ও কাজে মিল ছিল না বার্সার কর্তাব্যক্তিদের। এবার সে কাহিনিটাই আরও বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেছেন রোনালদোর সেই সময়ের মুখপাত্র জিওভান্নি ব্রাঞ্চিনি।
এক বছরেই কাতালান সমর্থকদের মনের মণিকোঠায় জায়গা করে নিয়েছিলেন রোনালদো। একের পর এক দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে বাধ্য করেছিলেন তাঁকে ঘিরে আগামী দিনের স্বপ্ন দেখার জন্য। কিন্তু বার্সা কর্তাব্যক্তিরা সে আবেগের মূল্য দেননি। স্কাই স্পোর্টস ডকুমেন্টারিতে এই কথাগুলোই আরও খোলাসা করে বলেছেন ব্রাঞ্চিনি, ‘বার্সেলোনার উকিল, সভাপতি হোয়ান গাসপার্তের সঙ্গে বহুদিন ধরে আলোচনা চলল আমাদের। ওর চুক্তির শর্তগুলোকে পাত্তা দিতে চায়নি। কিন্তু আমাদের কাছে ওই শর্তগুলোই গুরুত্বপূর্ণ ছিল অনেক।’
কিন্তু কী সেই শর্ত? ব্রাঞ্চিনির কথা শুনে বোঝা যায়, রোনালদো চুক্তির মধ্যে ইমেজ স্বত্বের বাড়তি কোনো ঝামেলা চাননি। চেয়েছিলেন সুন্দরমতো চুক্তিটা বাড়িয়ে নিতে। কিন্তু এই চুক্তি নবায়ন করতে গিয়েই ইমেজ স্বত্বের বিষয়গুলো নিয়ে রোনালদোকে চটিয়ে দেয় বার্সেলোনা, ‘বার্সেলোনার সঙ্গে চুক্তি নবায়ন করতে আমাদের কোনো আপত্তি ছিল না। কিন্তু ইমেজ স্বত্ব-সংক্রান্ত বাড়তি ঝামেলাগুলো চাইনি আমরা। আপনি যদি মনে করেন আপনি একটা টিভি চ্যানেলকে দিয়ে আমাদের চুক্তির পারিশ্রমিক দেবেন, আমাদের সমস্যা নেই যতক্ষণ তাঁরা আমাদের ট্যাক্স দিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু ইমেজ স্বত্বের বাড়তি যন্ত্রণায় আমরা পড়তে চাইনি। বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়কে যেন এসব উটকো ঝামেলায় পড়তে না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে চেয়েছি।’
তবে বার্সেলোনা যদি চুক্তি নবায়নের ব্যাপারে শতভাগ স্বচ্ছ থাকত, তাহলে রোনালদো সেই নতুন চুক্তিতে সই করতেন বলে জানিয়েছেন ব্রাঞ্চিনি, ‘একদিন রোনালদোকে ওর বার্সেলোনার হোটেল থেকে একরকম অপহরণ করে নিয়ে আসলাম। এরপর আমার বান্ধবী কার্লো পালাভিচিনোর বাসায় গেলাম। সেখানে আলোচনা হলো, বার্সেলোনা যদি আমাদের স্বচ্ছ চুক্তি দেয়, আমাদের সই করতে আপত্তি নেই। কিন্তু যদি না করে, সে ক্ষেত্রে অন্যান্য আগ্রহী ক্লাবের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে হবে। তখন রোনালদোকে দলে পাওয়ার জন্য বেশ কিছু ক্লাব আগ্রহী ছিল। যেমন ইন্টার মিলান, লাৎসিও ও রেঞ্জার্স।’
বার্সেলোনার সঙ্গে চুক্তির ব্যাপারে সবকিছু ঠিকঠাক হয়েও যায় রোনালদোর। সবচেয়ে বেশি আগ্রহী ক্লাব ইন্টারকে ফোন করে ব্রাঞ্চিনি জানিয়ে দেন, রোনালদো নীল-কালো জার্সি শিগগির গায়ে চাপাচ্ছেন না, ‘যখন আমরা বার্সেলোনার কোচদের সঙ্গে হাত মেলালাম, আমি তাঁদের কাছ থেকে অনুমতি চাইলাম একটা ফোন কল করার জন্য। আমি তৎকালীন ইন্টার সভাপতি মাসিমো মোরাত্তিকে ফোন করে জানিয়ে দিলাম, চুক্তির ব্যাপারে বার্সেলোনার সঙ্গে আমরা একমত হয়েছি।’
কিন্তু বার্সেলোনা ঝামেলা বাধায় নতুন চুক্তির ব্যাপারটা ঘোষণা করতে গিয়ে, ‘চুক্তির ব্যাপারটা ঘোষণা করার জন্য বার্সেলোনা একটা সংবাদ সম্মেলন ডাকে। সেখানে তাঁরা যেসব কথা বলে, সেগুলোর সঙ্গে ওরা আমাদের যা যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তার মিল ছিল না। প্রথমে ভাবলাম হয়তো কোনো ভুল-বোঝাবুঝি হচ্ছে। তারপর আমি রেগে গেলাম অনেক। আমি আমার সঙ্গীদের দিকে তাকিয়ে বললাম, ভাইয়েরা, আমরা এখান থেকে চলে যাচ্ছি। আমাদের বুদ্ধিমত্তাকে যারা এভাবে অপমান করে, তাঁদের ক্লাবে এক মুহূর্ত থাকার আর মানে হয় না। আমরা রোনালদোকে এত বড় বিপদের মুখে ঠেলে দিতে পারি না!’
কে জানে, বার্সেলোনা রোনালদো ও তাঁর মুখপাত্রকে এভাবে চটিয়ে না দিলে হয়তো এক বছর নয়, আরও অনেক অনেক বছর নিজেদের ক্লাবে সে সময়ে বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়টিকে ধরে রাখতে পারত কাতালানরা। রোনালদোও হয়তো ক্যারিয়ারের আরেক বাঁকে রিয়াল মাদ্রিদে যোগ দিয়ে সেখানকার কিংবদন্তি হতেন না। নিজেদের খেলোয়াড়কে বার্সেলোনার চটিয়ে দেওয়ার তালিকায় তাহলে শুধু মেসি নন, রোনালদোও আছেন!