আন্তর্জাতিক ফুটবলে নিজেদের অনেক বদভ্যাসই বিপদের কারণ হয় বাংলাদেশের ফুটবলারদের
আন্তর্জাতিক ফুটবলে নিজেদের অনেক বদভ্যাসই বিপদের কারণ হয় বাংলাদেশের ফুটবলারদের

রেফারিং কেন বাংলাদেশের বিপক্ষে যায়

কাল নেপালের বিপক্ষে বাঁচা-মরার ম্যাচে বিতর্কিত এক পেনাল্টিতে স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে বাংলাদেশের। দীর্ঘ ১৬ বছর পর সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে খেলার যে সুযোগ এসেছিল, সেটি শেষ পর্যন্ত ধরা দেয়নি জামাল ভূঁইয়াদের হাতে। শুরুতেই এগিয়ে যাওয়ার পর অভাবনীয় সব ঘটনা শেষ করে দিয়েছে সব সম্ভাবনা। ম্যাচের ৭৯ মিনিটে গোলকিপার আনিসুর রহমানের লাল কার্ড, এরপর ৮৬ মিনিটে বিতর্কিত পেনাল্টি। বাংলাদেশের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের সমাপ্তি ঘটেছে কান্না আর হতাশায়।

ম্যাচ শেষে কোচ অস্কার ব্রুজোন কোনো রাখঢাক না করেই নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন রেফারিং নিয়ে। তিনি মনে করেন, নেপালের বিপক্ষে ম্যাচে রেফারির ‘অবিচারের’ শিকার বাংলাদেশ। তিনি এর আগে ভারত ও মালদ্বীপ ম্যাচের পরও রেফারিং নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। বলেছিলেন, সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে ‘বাজে রেফারিংয়ের’ লক্ষ্যবস্তু হয়েছে বাংলাদেশ।

রেফারিং নিয়ে বাংলাদেশের অভিযোগ নতুন কিছু নয়। আন্তর্জাতিক ফুটবলে খুব কমই এমন হয়েছে যে রেফারির ‘ফিফটি-ফিফটি’ সিদ্ধান্তগুলো বাংলাদেশের পক্ষে এসেছে। কেবল জাতীয় দলই নয়, আন্তর্জাতিক ক্লাব ফুটবলেও একই ব্যাপার ঘটছে। এই তো কিছুদিন আগেই মালেতেই এএফসি কাপে ভারতের এটিকে মোহনবাগানের বিপক্ষে বাংলাদেশের চ্যাম্পিয়ন বসুন্ধরা কিংসের ম্যাচে রেফারির বেশ কিছু সিদ্ধান্ত বসুন্ধরার বিপক্ষে গেছে। কাল ব্রুজোন ম্যাচ শেষের সংবাদ সম্মেলনে তুলেছেন সে কথাও।

রেফারির কাছ থেকে সুবিধা আদায় করে নেওয়াও ফুটবল–পাঠের অংশ

রেফারিরা যেহেতু রক্তমাংসে গড়া মানুষ, ফুটবল মাঠে তাঁদের সব সিদ্ধান্তই নির্ভুল হবে, ভাবনাটা বাস্তবসম্মত নয়। রেফারিংয়ে ভুল হবে, কোনো দল সুবিধা পাবে, কোনো দল নিজেরা ‘অবিচারের’ শিকার হয়েছে বলে মনে করবে। এটাই ফুটবল। দুনিয়ার সর্বোচ্চ পর্যায়েও রেফারিং নিয়ে অভিযোগ অহরহ। বিশ্বকাপ, ইউরোর মতো আসরেও রেফারিং নিয়ে ক্ষোভ থেকে যায়। কিন্তু এরপরও অনেক কিছুই আলোচনা ও বিশ্লেষণের দাবি রাখে। কাল নেপালের বিপক্ষে ম্যাচ কিংবা এবারের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ এমন কিছু বিশ্লেষণ দাবি করছে।

কাল ম্যাচের ৮৬ মিনিটে নেপালকে উজবেকিস্তানের রেফারি যে পেনাল্টিটি ‘উপহার’ দিয়েছেন, সেটি যেকোনো বিচারেই বিতর্কিত। তাজ তামাংয়ের ক্রস বাংলাদেশের গোলমুখে উড়ে এলে অঞ্জন বিষ্টা হেড করতে লাফিয়েছিলেন। বাংলাদেশের দুই রক্ষণসেনা বিশ্বনাথ ঘোষ ও সাদউদ্দিন অঞ্জনকে হেডে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। এ সময় অঞ্জন মাঠে পড়ে যান। রেফারি বেশ দূর থেকেই অঞ্জনের সেই পড়ে যাওয়ার পেছনে সাদ বা বিশ্বনাথের দায় খুঁজে পান। বাঁশি বাজান পেনাল্টির।

রেফারি খুব সম্ভবত ভেবেছিলেন, অঞ্জন যখন হেড করার জন্য লাফিয়েছিলেন, তখন বিশ্বনাথ বা সাদ তাঁকে ধাক্কা দিয়েছেন। সিদ্ধান্তটির পর ক্ষোভে ফেটে পড়েছিলেন বাংলাদেশের খেলোয়াড়েরা। এমনকি ম্যাচ শেষ হওয়ার পর খেলোয়াড় ও কর্মকর্তাদের হাতে রেফারির নাজেহাল হওয়ার শঙ্কাও জেগেছিল। মালদ্বীপের পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা রেফারিকে কর্ডন করেই মাঠ থেকে বের করে নিয়ে যান। পুলিশ রেফারিকে কর্ডন করে মাঠ থেকে বের করে নিয়ে যাচ্ছে, এটা বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবলের নিয়মিত ঘটনা হলেও আন্তর্জাতিক ফুটবলে খুব বেশি দেখা যায় না।

ঘরোয়া ফুটবলের নমনীয় রেফারিং ক্ষতি করছে ফুটবলারদের

ম্যাচ শেষে রাগ আর হতাশায় কাঁদছিলেন বাংলাদেশ দলের অনেকেই। কিন্তু এমন রেফারির এমন বিতর্কিত সিদ্ধান্তের শিকার হওয়ার পরও কিছু জায়গায় আত্মবিশ্লেষণ ও আত্মসমালোচনার ব্যাপারটা থাকেই। কান্না আর হতাশার মধ্যেও বাংলাদেশের ফুটবল ও ফুটবল-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা সেই আত্মসমালোচনা করবেন। সেই আত্মসমালোচনার আয়নায় নিজেদের ভুলত্রুটিগুলো পর্যালোচনা করবেন, এমনটাই প্রত্যাশা।

এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, বাজে রেফারিংয়ের শিকার হওয়ার পর সেই আত্মসমালোচনা আসলে কী! ভিডিওতে বাংলাদেশের যেকোনো ম্যাচ নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখতে বসলেই সেই ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে যাবে। প্রতিটি ম্যাচেই বাংলাদেশের ফুটবলাররা অপ্রয়োজনীয় কিছু কাজ করেন, যেটি আন্তর্জাতিক ফুটবলে খেলতে নামলেই নগ্নভাবে প্রকাশিত হয়। মালদ্বীপের বিপক্ষে এবারের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের ম্যাচে বাংলাদেশ পুরো ম্যাচে ফাউল করেছে ৩০টি। প্রায় প্রতিটি ম্যাচেই ফাউলের সংখ্যা কমবেশি এমনই। প্রতিটি ম্যাচেই একাধিক ফুটবলার বিনা কারণে ফাউল করে হলুদ কার্ড দেখেন। লাল কার্ড যেখানে বিরল ব্যাপার হওয়ার কথা, সেখানে সাফে দুটি ম্যাচে ১০ জনের দল নিয়ে ম্যাচের একটা বড় অংশ খেলতে হয়েছে বাংলাদেশ দলকে।

কাল তপু বর্মণ নেপালের বিপক্ষে ম্যাচের শুরুতেই নিজেদের বিপৎসীমার মধ্যেই খুব বাজে একটা ফাউল করেছিলেন। বিপজ্জনক পরিস্থিতি ছিল, এটা মেনে নিলেও তিনি যেভাবে প্রতিপক্ষের ফরোয়ার্ডকে ঘাড় ধরে টেনে ফেলে দিলেন, সেটি খুবই দৃষ্টিকটু। বিপৎসীমার অনেক দূরে যেখানে বড় কোনো বিপদের আশঙ্কা নেই, সেখানেও বাংলাদেশের ফুটবলাররা ফাউল করেন। অনেক সময় সাধারণ ট্যাকলিংয়ের সময়ও বলে না মেরে বাংলাদেশি ফুটবলাররা প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের বুটে চার্জ করেন। বল দখলের লড়াইয়ে পেছন থেকে ধাক্কা দেওয়া, লাথি মারা—এগুলো খুবই নিয়মিত ঘটনা। একজন রেফারি অনেক সময় ম্যাচের শুরুতেই দুই দলের ২২ ফুটবলার সম্পর্কে খসড়া ধারণা মাথায় নিয়ে ফেলেন। খেলোয়াড়দের প্রবণতার দিকে নজর রাখা শুরু করেন। ম্যাচের বাকি অংশেও সিদ্ধান্তগুলো সেই প্রবণতার বিচারেই নিয়ে থাকেন তিনি। রক্ত-মাংসে গড়া একজন মানুষ এটাই করবেন। পৃথিবীর সেরা রেফারিরাও এভাবেই সিদ্ধান্ত নেন।

রেফারির কাছ থেকে নিয়মের মধ্যে থেকে সুবিধা আদায়ও শিখতে হবে বাংলাদেশের ফুটবলারদের

এখন কোনো দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে যদি জায়গা-অজায়গায় ফাউল করার প্রবণতা থাকে, তাহলে রেফারি বিভ্রান্ত হতে বাধ্য। কালকের ম্যাচেও নেপালের বিপক্ষে বাংলাদেশের ফুটবলাররা একই কাজ করেছেন। সেটিরই কি খেসারত দিতে হলো দলকে!

বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবলে রেফারিং খুবই নমনীয়, এটি দীর্ঘদিন ধরেই হয়ে আসছে। বড় ক্লাবগুলোর বিপক্ষে ছোট দলের ম্যাচে রেফারিরা কী এক অজানা শঙ্কায় মিইয়ে থাকেন। অনেক বড় ফাউল কিংবা অপরাধ করেও অনেক সময় খেলোয়াড়েরা পার পেয়ে যান। আন্তর্জাতিক ফুটবলে যে ধরনের ফাউলে লাল কার্ড দেখতে হয়, সেটি ঘরোয়া ফুটবলে করেও বেঁচে যান খেলোয়াড়েরা। দিনের পর দিন এমনভাবে খেলতে খেলতে একটা সাধারণ প্রবণতা তৈরি হয়ে যায় তাঁদের মধ্যে। আন্তর্জাতিক ফুটবলে ওই একই ফাউলেই হলুদ কার্ড, এমনকি লাল কার্ডও দেখেন তাঁরা। আত্মবিশ্লেষণটা করতে হবে, এ জায়গাতেই। খেলোয়াড়দের মাঠের আচার-আচরণ এমন হতে হবে, তাঁরা যেন রেফারিদের শ্রদ্ধাটা অর্জন করতে পারেন।

‘ফুটবল এডুকেশন’ বলে একটা ব্যাপার আছে। সেই ‘এডুকেশন’ মানে বই মুখস্থ করা নয়। সেটি হচ্ছে ফুটবলের মৌলিক বিষয়গুলোর পাঠ। মাঠের কোন জায়গায় কী করতে হবে, কোন পরিস্থিতিতে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের কীভাবে ট্যাকল করতে হবে, প্রতিপক্ষকে কীভাবে বিরক্ত করে সুবিধা আদায় করে নিতে হবে, এসবের শিক্ষার বড় অভাব বাংলাদেশের ফুটবলারদের মধ্যে। অনেক সময় নিয়মের মধ্যে থেকে, কৌশলে রেফারিংয়ের সুবিধা আদায় করে নেওয়াও সেই ফুটবল-পাঠের একটা বড় অধ্যায়। আমাদের উপমহাদেশে যে দলগুলো উন্নতি করছে—ভারত, মালদ্বীপ, নেপাল—সব দলের খেলোয়াড়েরাই সেগুলো করেন।

নেপাল ম্যাচ কাঁদিয়েছে। স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় জর্জরিত করেছে। দীর্ঘদিন পর ফুটবলে সাফল্য হাতছানি দিয়েও দূরে সরে গেছে। বাজে রেফারিং ভুগিয়েছে। এ সবকিছুর মধ্যেও আত্মসমালোচনাটাও জরুরি। নয়তো একই ব্যাপার ঘটতেই থাকবে বছরের পর বছর ধরে।