এত দিন তাঁরা নীরবে গোল করে মাঠ ছাড়তেন। হালি হালি গোল খাওয়া ছিল নিয়তি। কিন্তু সেই নিয়তির লিখন পাল্টে এবার রূপকথাই লিখলেন উত্তর বারিধারার ফুটবলাররা। গতকাল শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্রকে ১-০ গোলে হারিয়ে সাড়া ফেলে দিয়েছেন প্রিমিয়ার ফুটবল লিগের প্রথম দিনেই।
ক্লাবটির ইতিহাসে এর আগে বড় দলের বিপক্ষে জয় ছিল মাত্র দুটি। দুই বছর আগে প্রিমিয়ার লিগে আবির্ভাবেই ব্রাদার্সকে ৩-২ ও আর বিজেএমসিকে ৩-০ গোলে হারিয়েছিল তারা। ওই বছর লিগ থেকে অবনমিত হয়ে গিয়েছিল তারা। তবে ফিরে আসতে সময় নেয়নি। এক মৌসুম পরই ফিরে প্রথম ম্যাচে শেখ রাসেলের বিপক্ষে জয়। বারিধারার ফুটবলাররা এখন পারলে আকাশেই ওড়েন!
চট্টগ্রাম এমএ আজিজ স্টেডিয়ামে গতকাল তাঁদের আনন্দের সব বাঁধই যেন ভেঙে গিয়েছিল। রাতে হোটেলে ফিরেও তা অব্যাহত থাকল। সবাই মজা করলেন নিজেদের মধ্যে। ঢাকা থেকে ক্লাবের শীর্ষ কর্মকর্তাদের ফোন এল। ক্লাবের গভর্নিং বডির সভাপতি ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ওয়াকিল আহমেদ ভীষণ খুশি। ক্ষণে ক্ষণে খোঁজ নিচ্ছেন খেলোয়াড়দের। অভিনন্দন জোয়ারে ভাসছেন ফুটবলাররা। এক লাখ টাকা পুরস্কার পেল গোটা দল।
তবে ওই পুরস্কারের চেয়েও বড় পুরস্কারটি মিলল আজ সকালে, যখন কর্মকর্তারা বললেন, ‘চল তোমাদের পতেঙ্গা বিচ থেকে ঘুরিয়ে আনি।’ গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যে পতেঙ্গা গিয়ে খেলোয়াড়দের আনন্দ দেখে কে! জোয়ারের কারণে পানিতে খুব বেশি সময় থাকা সম্ভব হয়নি, তা ছাড়া কোচও চাইছিলেন না ওখানে বেশি সময় থেকে খেলোয়াড়দের ঠান্ডা লেগে যাক। তাই আধা ঘণ্টার মধ্যেই ফিরে আসতে হলো সদরঘাটের এক মাঝারি মানের হোটেলে।
অধিনায়ক সোহেল রানা এতেই ভীষণ খুশি, ‘দারুণ একটা সময় কাটালাম আমরা। পতেঙ্গা বিচে যাব, এটা তো ভাবাই যায়নি। সবাই মিলে যাওয়ার মজাই আসলে আলাদা।’ শেখ রাসেলের বিপক্ষে পেনাল্টিতে থেকে গোল করে জয়ের নায়ক ডিফেন্ডার খালেকুজ্জামানের কাছেও সময়টা ধরা থাকল জীবনের অন্যতম সেরা মুহূর্ত হিসেবে, ‘জীবনে আসলে এত আনন্দের সময় কমই এসেছে।’
উত্তর বারিধারা প্রিমিয়ারের নিচের দিকের দল বলে খেলোয়াড়েরা আনন্দ করার উপলক্ষ বলতে গেলে পান-ই না। ছোট বাজেটের হওয়ায় চাকচিক্য নেই। কোনো রকমে খেলে সময়টা পার করাই লক্ষ্য থাকে। ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম যদিও বললেন, ‘এবার আমাদের বাজেট দেড় কোটি টাকা। কিন্তু অনেকেরই ধারণা, বাজেট আরও কম। বাজেট যা–ই হোক, বারিধারার কালাচাঁদপুর স্কুলের পাশে ক্লাবের নিজম্ব মাঠ, নিজস্ব ভবন আছে এই দলের। চারতলা ওই ভবনে দুটি ফ্লোরে খেলোয়াড়েরা থাকেন। চারতলায় অফিস ও ডাইনিং। নিচতলায় হলরুম। নিজস্ব জিম থাকায় সারা বছরই অনুশীলন করা যায়। ঢাকা মোহামেডানের মতো দল আজও একটা নিজস্ব মাঠ নিতে পারল না। অথচ বারিধারায় দলের নিজস্ব ওই মাঠ খেলোয়াড়দের কাছে বিরাট এক পাওয়া।
হোটেল লবিতে বসে ক্লাব সম্পাদক জানালেন, ১৯৯৫ সালে স্থানীয় কিছু উৎসাহী মানুষের হাত ধরে এলাকাভিত্তিক দলটির পথচলা শুরু। ধাপে ধাপে দেশের শীর্ষ লিগে উঠে আসা। তবে তাদের স্বপ্নযাত্রা এখানেই থেমে থাকবে না। ২৮ জুলাই শেখ জামালের বিপক্ষে পরের ম্যাচেও প্রথম ম্যাচের চমক ধরে রাখার আকাঙ্ক্ষা দেখা গেল খেলোয়াড়-কর্মকর্তা—সবার মধ্যেই। সোহেল রানা, খালেকুজ্জামানরা বলেন, এটা খুবই সম্ভব। কারণ, এই খেলোয়াড়েরা একসঙ্গে প্রায় চার বছর ধরে খেলছেন। সবার মধ্যেই ভালো একটা বোঝাপড়া তৈরি হয়েছে।
সেটির কল্যাণেই বারিধারার ফুটবলারদের পৃথিবীটাই যেন বদলে গেছে। শেখ রাসেলের বিপক্ষে ম্যাচটি ক্লাবে বড় পর্দায় দেখানো হয়েছে। জয়ের পর ঢাকায় মিষ্টি বিতরণ, আনন্দ মিছিল হওয়ার খবর শুনে খেলোয়াড়দের চোখমুখ চিকচিক করে। হঠাৎই যেমন যেন সব আলাদা লাগে। গোলরক্ষক রাজীব বলছিলেন, ‘আমার কাছে গোটা ব্যাপারটা দারুণ লাগছে। নিজেকে তারকা তারকা মনে হয়।’ হ্যাঁ, তারকা তো বটেই। এত বড় রূপকথার জন্ম দেওয়া নায়কেরা নিজেদের নায়ক ভাববেন এটাই তো স্বাভাবিক।