২০০৯ সালে ঢাকায় প্রথম প্রতিযোগিতামূলক ফুটবলে আবির্ভাব। শুরুতেই দুর্দান্ত পারফরম্যান্স। সিটিসেল স্কুল ফুটবলের চূড়ান্ত পর্বটা হয়ে উঠেছিল রুবেলময়। ৪ ম্যাচে সর্বোচ্চ ১৪ গোল, টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়। সব পুরস্কার নিয়ে গেলেন বাড়িতে। তবে গোবিন্দগঞ্জ বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের হয়ে সেমিফাইনালে বিদায় নেওয়ার অতৃপ্তিটা থেকে যায় রুবেল মিয়ার মনে।
পরের বছর দিল্লিতে অনূর্ধ্ব-১৭ সুব্রত কাপের বাংলাদেশ দলে ডাক পেয়েও ছেলেটি ক্যাম্পে আসতে চাইছিল না। এলাকার ‘রাজ্জাক স্যার’ জোর করে নিয়ে আসেন। এখন বুঝতে পারেন স্যার ভালোই করেছিলেন। কিছুদিন আগেই না-ফেরার দেশে পাড়ি দেওয়া এই শিক্ষকের কাছে তাঁর অশেষ ঋণ।
এই সেই রুবেল মিয়া, যিনি এখন দারুণ সব গোল করে চট্টগ্রাম আবাহনীর জার্সিতে উজ্জ্বল। এতটাই যে, যুবদলের হয়ে যুক্তরাষ্ট্র সফর, এএফসি অনূর্ধ্ব-১৯ ফুটবলে ইরাকের বিপক্ষে ইরাকের মাঠে বাংলাদেশের জয়সূচক গোলটাও পেছনের পাতায়।
এখন তাঁর খেলা দেখতে গ্রামে টিভির সামনে ভিড় জমে। উচ্ছ্বসিত হন সবাই, ‘ওই যে দেখ দেখ...আমাদের রুবেল...!’ রুবেল গোল করলে মিষ্টি খাওয়াও শুরু হয়ে যায়। যেমন হলো পরশু রাতে।
বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের ওই সন্ধ্যাটা অমন মাতিয়ে দেওয়া রুবেলের সময়ও কাটছে মিষ্টিমধুর। ঢাকা মোহামেডানের বিপক্ষে দুটি গোল। গাইবান্ধার বুনাতলা রতনপুর গ্রামের ২২ বছরের তরুণ নিজেকে চেনালেন আরেকবার। অবিরাম ফোন পাচ্ছেন প্রিয়জনদের। জীবনে বদলের হাওয়া। মাঠে যেমন বদলে গেছে রুবেলের পজিশন। ৫ ফুট ৫ ইঞ্চি উচ্চতা। তাই ঢাকায় এলে কোচ গোলাম জিলানি স্ট্রাইকার থেকে উইঙ্গার বানিয়ে দেন। তত দিনে নামও গেছে বদলে! ‘সিটিসেল স্কুল ফুটবল খেলতে এলে স্যাররা ভুল করে রুবেল হোসেনের জায়গায় লিখে দেন রুবেল মিয়া, সেই থেকে আমি রুবেল মিয়া, এখন তো পাসপোর্টেও মিয়া’—মজা করে বলেন রুবেল।
কিন্তু নামে কী আসে যায়! আর এখানেই রুবেলের তৃপ্তি। চট্টগ্রামের হালিশহরে কে ব্লকের এক আবাসিক ভবনে চট্টগ্রাম আবাহনীর ক্যাম্প, ওখানেই সবার শুভেচ্ছা পেতে পেতে রুবেল কাল দুপুরে ফিরে যান ছোটবেলায়। তাঁর গায়ে এখনো গ্রামের গন্ধ। রতনপুরের ছেলেটির মুখে এখনো গ্রামের কথাটাই আগে আসে, ‘আমাকে নিয়ে গ্রামে অনেক আশা। আমি তা পূরণ করব।’
একই গ্রামের ছেলে জাতীয় দলের স্ট্রাইকার নাবিব নেওয়াজ জীবনকে ছাপিয়ে গেছেন রুবেল। গত ৭ মে স্বাধীনতা কাপের ফাইনালে রুবেলের সেই বাইসাইকেল কিকের গোলটি তো সাম্প্রতিক সময়ের সেরা। ওই গোল রোনালদো বা মেসি করলে সারা দিন টিভিতে দেখা যেত। চলতি মৌসুমে এ পর্যন্ত তাঁর করা পাঁচ গোলের তিনটিই প্রিমিয়ার লিগের প্রথম দুটি ম্যাচে। এই গোলগুলোর কথাও বলছেন সবাই।
২০১৩-১৪ মৌসুমে ব্রাদার্সের জার্সিতে প্রিমিয়ার লিগে অভিষেক, প্রথম একাদশে নিয়মিত সুযোগ পেয়ে গোল পাঁচটি। পরের মৌসুম অর্থাৎ গতবার ‘ভুল করে’ তারকাবহুল শেখ জামালে গিয়ে ছন্দপতন। বদলি হিসেবে কয়েকটি ম্যাচ খেলে গোল মাত্র একটি।
রুবেল আবার সুযোগ পেয়ে নিখুঁত সব শট নিচ্ছেন পোস্টে। নিরন্তর অনুশীলনই এর রহস্য। বাংলাদেশের ফুটবলারদের মধ্যে যেটির বড়ই অভাব। নেইমার-ভক্ত রুবেলকে দেখে অবাক চট্টগ্রাম আবাহনীর কোচ জোসেফ পাভলিক। ক্যাম্পের নিচতলায় সোফায় বসে একটি শব্দেই বর্ণনা করলেন শিষ্যকে, ‘ফ্যান্টাস্টিক।’
চট্টগ্রাম আবাহনীর সিনিয়র খেলোয়াড় জাহিদও মেতে ওঠেন প্রশংসায়, ‘ওর কাছে খেলাই সব। চুপচাপ, ভদ্র। ও বড় খেলোয়াড় হতে পারবে।’
হালের তরুণেরা বেশির ভাগই খেলার বাইরের বিষয় নিয়ে মেতে থাকে, রুবেল ব্যতিক্রম। কিন্তু নিজেকে এতটা ওপরে তুলে এনেও তাঁর মন খারাপ। মাত্র ৪ বছর বয়সে হারান বাবাকে। বিজিবির সৈনিক বাবার পোস্টিং ছিল রাঙামাটিতে। মায়ের কাছে শুনেছেন, ‘হঠাৎ একদিন বাড়িতে বাবার লাশ এল। বলা হয়েছে, বাবা হার্ট অ্যাটাক করেছেন, কিন্তু তাঁর শরীরে নাকি গুলির দাগ ছিল।’ রুবেলের চোখ ছলছল করে।
মা, দুই ভাই আর একমাত্র বোনের গল্প করেন। এঁরা সবাই বাড়ির ছোটজন রুবেলের সব আবদার মিটিয়েছেন। বল, বুট সব দিয়েছেন। সিঙ্গাপুরে থাকা দুই ভাই আর্থিক অভাব বুঝতে দেননি। এখন তো নিজেই সচ্ছল, ১৮ লাখ টাকায় চট্টগ্রাম আবাহনীর সঙ্গে চুক্তি, ১৬ লাখই নাকি পেয়ে গেছেন।
মায়ের তাই আনন্দের শেষ নেই। তবে রুবেলের ফুটবলভ্রমণটা সবে শুরু। ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে গোয়ায় প্রীতি ম্যাচে জাতীয় দলের স্কোয়াড ছিলেন। এখনো অভিষেক হয়নি। যেভাবে খেলছেন এবার টম সেন্টফিটের হাত ধরে হয়েও যেতে পারে। যদি হয়, অন্যলোকে থাকা বাবার জন্য সেটি হবে রুবেলের বড় এক উপহার!