>ক্লাব ফুটবলের সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ দ্বৈরথের নাম বলতে বললে কোন ম্যাচটা আপনার চোখের সামনে ভাসবে? রিয়াল মাদ্রিদ-বার্সেলোনা, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড-লিভারপুল, এসি মিলান-ইন্টার মিলান, এই তো? কিন্তু যদি বলা হয় বোকা জুনিয়র্স-রিভার প্লেট দ্বৈরথের উত্তেজনার তুলনায় এসব নস্যি! মানবেন তো?
দক্ষিণ আমেরিকার কাছে ফুটবলের ঋণ অনেক। বিশেষ করে ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনা ফুটবলকে যা যা দিয়েছে, সেসব মেপে দেখানো সম্ভব নয়।
ফুটবলের অর্জনের ভান্ডারটা সমৃদ্ধ করেছে উরুগুয়ে, কলম্বিয়া, প্যারাগুয়ে, চিলি কিংবা মেক্সিকোর মতো দেশগুলোও। আর্জেন্টিনার বিষয়ে আলাদা করে বললে বলা যায় ম্যারাডোনা, মেসি, বাতিস্তুতা থেকে শুরু করে কেম্পেস, তেভেজ, রিকেলমে, প্যাসারেলা, ভালদানো, আগুয়েরো, জানেত্তি। আর্জেন্টিনার ঘরোয়া ফুটবল যে কত তারকা বানিয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। আর এসব তারকার আঁতুড়ঘর কিন্তু বোকা জুনিয়র্স, রিভার প্লেট, ইন্দিপেন্দিয়েন্তে, এস্তুদিয়েন্তেসের মতো আর্জেন্টাইন ক্লাবগুলো। এসব ক্লাব ঘিরে সমর্থকদের যে পরিমাণ উত্তেজনা আর আবেগ, তার সঙ্গে ইউরোপের ক্লাবগুলো হয়তো পাল্লা দিয়ে পারবে না; তা ব্যবসায়িক দিক থেকে ইউরোপের ক্লাবগুলো যতই জাঁকজমকপূর্ণ হোক না কেন।
আর্জেন্টিনার ক্লাব পরিমণ্ডলে সবচেয়ে বড় দুই ক্লাব বোকা জুনিয়র্স আর রিভার প্লেটের কথাই ধরুন। রাজধানী বুয়েনস এইরসের এ দুই ক্লাবের মধ্যে খেলা হলে পুরো দেশটাই যেন দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। ঝগড়াঝাঁটি, মারামারি, তর্ক-বিতর্ক, বৈরী সমর্থকদের হামলা—এসব তো স্বাভাবিক ঘটনা। এই দুই দল দক্ষিণ আমেরিকান ক্লাব ফুটবলের সবচেয়ে বড় টুর্নামেন্টে কোপা লিবার্তোদোরেসের ফাইনালে মুখোমুখি হলে অবস্থাটা কী হবে, তা চিন্তা করতেই কেমন যেন লাগে।
আজ বাংলাদেশ সময় রাত দুইটায় এই দ্বৈরথই মাঠে গড়াবে। কোপা লিবার্তোদোরেসের ফাইনালে মুখোমুখি হবে আর্জেন্টিনার দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাব—বোকা জুনিয়র্স ও রিভার প্লেট।
দক্ষিণ আমেরিকার ‘চ্যাম্পিয়নস লিগ’ খ্যাত কোপা লিবার্তোদোরেস দুই লেগের এই ফাইনালে গোটা আর্জেন্টিনা স্থবির হয়ে যাবে ১৮০ মিনিটের জন্য। রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনায় কাটবে ম্যাচের প্রতিটি ক্ষণ। ফাইনালের প্রথম লেগ গড়াবে বোকা জুনিয়র্সের মাঠ লা বোম্বানেরায়, ফিরতি লেগ ২৫ নভেম্বর রিভার প্লেটের স্টেডিয়াম লা মনুমেন্টালে।
ঠিক কী রকম উত্তেজনাপূর্ণ ম্যাচ এটা? কয়েকটা উদাহরণ দেওয়া যায়। এক জরিপে দেখা গেছে, আর্জেন্টিনার সবচেয়ে বেশি সমর্থনপুষ্ট দল এই দুই ক্লাব। পুরো জনসংখ্যার ৪৬ শতাংশ সমর্থন করে বোকা জুনিয়র্সকে আর ২৪ শতাংশ রিভার প্লেটকে। অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশই এই দুই দলের কাউকে না কাউকে সমর্থন করে। ব্যাপারটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। ঘরোয়া লিগের সবচেয়ে বেশি শিরোপা এই দুই দলেরই।
বোকা-রিভার প্লেট দ্বৈরথে এত বেশি সংঘর্ষ হয় যে এখন বোকা জুনিয়র্সের মাঠে খেলা হলে রিভার প্লেটের সমর্থকেরা দেখতে যেতে পারেন না। রিভার প্লেটের মাঠে খেলা হলে একই নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য হয় বোকা জুনিয়র্স–সমর্থকদের ক্ষেত্রেও। শেষবার এই দুই দল কোপা লিবার্তোদোরেসে মুখোমুখি হয়েছিল ২০১৫ সালে। পুরো ৯০ মিনিট খেলাই হতে পারেনি বিশৃঙ্খলার কারণে!
সেবার বোকা–সমর্থকদের হামলায় হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল বেশ কিছু রিভার প্লেটের খেলোয়াড়কে। মরিচের স্প্রে দিয়ে হামলা করা হয়েছিল খেলোয়াড়দের। ম্যাচটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়, পরের রাউন্ডে উঠে যায় রিভার প্লেট। সেবার শিরোপা জিতে বোকা–সমর্থকদের হামলার জবাবটা মাঠেই দিয়েছিল দলটি। উত্তেজনার মাত্রা কোন পর্যায়ের, সেটাই যেন এ বছর আরেকবার জানান দিল দুই দলের দুই সমর্থক। কোন দল ভালো, এই বিতর্কে আর্জেন্টিনার এক লোক তাঁর শ্যালকের বাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে! বাড়ি পোড়ানো তো ভালো, বুয়েনস এইরসে গেলে বোঝা যায় চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দলের সমর্থকের ভবলীলা সাঙ্গ করতেও হাত কাঁপে না আর্জেন্টাইনদের!
ইউরোপের সবচেয়ে বড় দ্বৈরথ নিঃসন্দেহে রিয়াল মাদ্রিদ আর বার্সেলোনার ম্যাচ। কিন্তু এই ক্লাব দুটি আলাদা শহরে হওয়ার কারণে এদের মধ্যে ম্যাচ হলে উত্তেজনার মাত্রাটা একটু কম হওয়ার অবকাশ থেকেই যায়। এসি মিলান-ইন্টার মিলানের সেই আগের জৌলুশ আর নেই। গত দুই দশকে লিভারপুলের লিগ শিরোপা জিততে না পারার ব্যর্থতাও ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড-লিভারপুল দ্বৈরথের রং কেড়ে নিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে ধনকুবেরদের অর্থে ফুলেফেঁপে ওঠা চেলসি ও ম্যানচেস্টার সিটি সেরা সময় কাটলেও ঐতিহাসিকভাবে সফল দল না হওয়ার কারণে ইউনাইটেড বা লিভারপুলের সঙ্গে ম্যাচে দলটির সমর্থকদের পাগলামো অতটা দেখা যায় না।
বোকা জুনিয়র্স-রিভার প্লেট আগুনে ম্যাচে কিন্তু ফুলকির কোনো ঘাটতি নেই।