অবামেয়াং বার্সার প্রথম ও চতুর্থ গোলটি করেছেন
অবামেয়াং বার্সার প্রথম ও চতুর্থ গোলটি করেছেন

রিয়ালের ভাগ্য ভালো যে বার্সা ৪ গোলের বেশি দিতে পারেনি

করিম বেনজেমা নেই, লেফটব্যাক ফারলাঁ মেন্দি নেই। রিয়াল মাদ্রিদকে যে ভুগতে হবে, জানা ছিল। তাই বলে এতটা! ভোগান্তি নয়, লজ্জাই সঙ্গী হলো রিয়ালের।

লজ্জাটা শুধু এই নয় যে, সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে আজ চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বার্সেলোনার কাছে ৪-০ গোলে হেরেছে রিয়াল। হয়তো আরও বড় লজ্জা এই যে, বার্সেলোনা আরও অন্তত চার-পাঁচটি গোল করতে পারেনি।

পয়েন্ট তালিকার হিসাবে এ জয়টা বার্সেলোনার অনেক কাজে এসেছে। ২৮ ম্যাচে ৫৪ পয়েন্ট নিয়ে তিন নম্বরে উঠে এসেছে জাভির দল, সেরা চারে থেকে আগামী মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগে জায়গা করে নেওয়ার স্বপ্ন আরও উজ্জ্বল হয়েছে তাদের। অন্যদিকে এ ম্যাচে জয়-হারে লিগের পয়েন্ট তালিকায় রিয়ালের অবস্থানে কোনো নড়চড় হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। ২৯ ম্যাচে ৬৬ পয়েন্ট নিয়ে শীর্ষেই আছে রিয়াল, দুইয়ে থাকা সেভাইয়ার চেয়ে এখনো এগিয়ে ৯ পয়েন্টে।

কিন্তু এ ম্যাচ তো শুধু ৩ পয়েন্টের নয়। শুধু পয়েন্ট তালিকায় হিসাবের নয়। এ যে এল ক্লাসিকো! তর্কসাপেক্ষে ক্লাব ফুটবলের সবচেয়ে বড় ম্যাচ। আর সে ম্যাচে রিয়ালের প্রদর্শনীতে পরিষ্কার, কোচিংয়ে মাত্র বছর তিনেক পথচলা, ইউরোপের ফুটবলে মাত্র মাস চারেকই কোচিং করানো জাভিই আজ বার্নাব্যুতে ফুটবলের পাঠ শেখালেন তিন দশকের কোচিং ক্যারিয়ারে ঋদ্ধ, তিনটি চ্যাম্পিয়নস লিগসহ ২১ শিরোপায় সমৃদ্ধ আনচেলত্তিকে।

বার্সার সামনে আজ পাত্তাই পায়নি রিয়াল

টানা পাঁচটি ক্লাসিকোতে জেতা রিয়ালই যে আজ নিজেদের মাঠে বার্সার কাছে এমন লজ্জা পেল, সেটির বিশ্লেষণে সবচেয়ে বড় প্রশ্নটা হয়তো নিজেকেই করবেন আনচেলত্তি। তাঁর একের পর এক হতবুদ্ধি করে দেওয়া সিদ্ধান্তই যে ম্যাচে বার্সার দাপটের পথ আরও সহজ করে দিয়েছে!

বেনজেমা-মেন্দি না থাকায় দলের খোলনলচেই বদলে ফেলেছেন আনচেলত্তি। ৪-৩-৩ ছক বদলে দল সাজিয়েছেন ৪-১-৪-১ ছকে, সবার সামনে রেখেছেন তরুণ ব্রাজিলিয়ান প্লেমেকার রদ্রিগোকে। দুই উইংয়ে ভিনিসিয়ুস জুনিয়র আর ফেদে ভালভার্দেকে। একেবারেই তরুণ ফরোয়ার্ড লাইনের অনভিজ্ঞতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে, তবে উলটো দিকে বার্সেলোনার এক অবামেয়াংকে বাদ দিলে দেম্বেলে-ফেরান-পেদ্রিদের আক্রমণও তো অতটা অভিজ্ঞ নয়! যুক্তিটা তাই হয়তো ধোপে টিকবে না।

তবে আনচেলত্তির কৌশলও যে টিকল না, সেটিই রিয়ালের যত হতাশার কারণ। তরুণ ফরোয়ার্ড লাইন নিয়ে উচ্চাভিলাসী কৌশলে গিয়েছিলেন রিয়াল কোচ, বার্সেলোনাকে তাদেরই কৌশলে আটকানোর চিন্তা ছিল তাঁর। কিন্তু প্রতিপক্ষের বক্সের সামনেই বল কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা (হাই প্রেসিং) করতে গিয়ে নিজেদের রক্ষণরেখাও যে আরও ওপরে তুলে আনতে হতো (হাইলাইন ডিফেন্স), সেটি বুঝি হিসেবে ছিল না রিয়াল কোচের! না হলে রক্ষণরেখাটা এত নিচে রাখবে কেন রিয়াল। এর মধ্যে আবার ভালভার্দেকে দিয়ে রেখেছিলেন বার্সার প্রাণভোমরা হয়ে ওঠা পেদ্রিকে চোখে চোখে রাখার দায়িত্ব।

তাতে মাঝমাঠ যে গড়ের মাঠ হয়ে গেল। এত ফাঁকা জায়গায় রিয়ালের খেলোয়াড়দের মাঝে ‘পকেট’ খুঁজে নিতে মোটেও বেগ পেতে হয়নি বার্সার মিডফিল্ডার পেদ্রি-ডি ইয়ং কিংবা নিচে নেমে এসে মাঝমাঠ আর আক্রমণভাগের সমন্বয় গড়ার দায়িত্বে থাকা ফেরান তোরেসকে। অন্যদিকে রক্ষণের সময়ে বার্সার চার খেলোয়াড়ের দুটি রেখার মধ্যে দূরত্ব হয়তো ১৫-২০ মিটারের বেশি ছিল না। ম্যাচটা হয়তো সেখানেই হেরে গেছে রিয়াল!

দুই দলের খেলোয়াড়দের গড় অবস্থানই বলে দেয়, বার্সা কতটা গোছানো ছিল, আর রিয়াল কতটা ছন্নছাড়া

আগের ১১ ম্যাচে অপরাজিত বার্সা একেবারে পেপ গার্দিওলার ২০১১ সালের বার্সার মতো যে খেলেছে, তা নয়। তবে যা খেলেছে, নিজেরাই দরজা খুলে রাখা রিয়ালকে নিয়ে ছেলেখেলা করতে অতটুকুই যথেষ্ট ছিল।

প্রথম দুটি গোল অবশ্য টিকিটাকায় নয়, ক্রস আর হেডে পেয়েছে বার্সা। ২৯ মিনিটে নাচো ফার্নান্দেজকে ড্রিবলে ঘোল খাইয়ে ডানদিক থেকে বক্সে ক্রস ফেললেন দেম্বেলে, অত উঁচুতে থাকা বল রিয়াল সেন্টারব্যাক আলাবা হেড না করে কেন যেন পায়ে ঠেকাতে চাইলেন। হলো না। তাঁর পেছনেই থাকা পিয়ের এমেরিক অবামেয়াংয়ের হেড জড়িয়ে গেল জালে।

অবশ্য অবামেয়াং যে গোল করার মতো এত সময় পর্যন্ত মাঠে ছিলেন, আরও আগেই লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়তে হয়নি তাঁকে, এ নিয়েই ঘোর আপত্তি থাকবে রিয়ালের। ১১ মিনিটেই বলের দখলে গিয়ে রিয়াল মিডফিল্ডার টনি ক্রুসের পা মাড়িয়ে দেন অবামেয়াং, কিন্তু রেফারি লাল কার্ড তো দূরের কথা, হলুদ কার্ডও দেননি!

অবামেয়াংয়ের হেডের নয় মিনিট পর আবার হেড, আবার বল রিয়ালের জালে। এবারও ক্রস দেম্বেলের, তবে কর্নার থেকে। বলে মাথা ছোঁয়ানো খেলোয়াড়ও এবার ‘অবা’ নন, রোনাল্ড আরাউহো। বিরতিতে ২-০ গোলে এগিয়ে বার্সা। অবশ্য তার আগেই অবামেয়াং ও ফেরান তোরেস দারুণ দুটি সুযোগ বল বাইরে না মারলে বিরতিতেই গোলের সংখ্যা চার হয়ে যায় বার্সার।

ফেরান তোরেস একটি সুযোগ কাজে লাগিয়েছেন, হারিয়েছেন আরও কয়েকটি

সেটি যাতে না হয়, সে জন্য বিরতির সময়ে দুই বদল আনলেন আনচেলত্তি। ক্রুসের বদলে নামলেন কামাভিঙ্গা, আর রাইটব্যাক কারভাহালের বদলে স্ট্রাইকার মারিয়ানো দিয়াজ। চারজনের বদলে রক্ষণটা হয়ে গেল তিনজনের। গোল না খেয়ে আক্রমণাত্মক হতে কৌশলটা নিয়েছিলেন আনচেলত্তি, উলটো রিয়ালের গোলমুখ যেন আরও হা হয়ে গেল।

বিরতির পর প্রথম মিনিটেই অবামেয়াংয়ের চোখধাঁধানো থ্রু গোলের সুবর্ণ সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিল ফেরান তোরেসের জন্য। কিন্তু জানুয়ারিতে বার্সায় যোগ দেওয়ার পর থেকে এক গোল করার বিপরীতে তিন-চারটি মিস করার ধারা বজায় রাখা তোরেস রিয়াল গোলকিপারকে একা পেয়ে, অনেক সময় পেয়েও বল মারলেন অনেক বাইরে!

তার পরের মিনিটেই অবশ্য প্রায়শ্চিত্য! ম্যাচের ফল নিয়ে ভাবনা সম্ভবত সেখানেই শেষ। রিয়ালের বক্সের একটু ওপরে বল কেড়ে নেয় বার্সা, বক্সে বল পান অবামেয়াং। সামনে ডিফেন্ডার জায়গা না দেওয়ায় শট নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছিলেন না, কিন্তু উলটো পাশে ফেরান তোরেসকে উঠতে দেখে সেদিকে ব্যাক ফ্লিক করে পাস বাড়িয়ে দেন অবা। ফেরানের প্রথম স্পর্শের বাঁকানো শটে বল জালে।

৩-০ থেকে ৪-০ হয়ে গেল চোখের পলকেই। যদিও এই গোলেও ঘোর আপত্তি থাকবে রিয়ালের। ভিএআর আসার পর তাহলে লাইনসম্যানের আর কাজ কী থাকল, এই প্রশ্নটাও উঠে যাবে আরেকবার। রক্ষণ থেকে পিকের আড়াআড়ি হলিউড পাস ধরে প্রথম স্পর্শেই অবামেয়াংয়ের দিকে দারুণ থ্রু বাড়ান ফেরান তোরেস। অবামেয়াংয়ের পায়ে বল যেতেই লাইনসম্যান পতাকা তুলে দেন। রিয়ালের ডিফেন্ডার এদের মিলিতাও সেদিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন। ভুলটা করে ফেললেন!

রেফারি বাঁশি বাজাননি দেখে অবামেয়াং এগিয়ে যান, অন্যদিক থেকে এগিয়ে আসা রিয়াল গোলকিপার কোর্তোয়ার মাথার ওপর দারুণ চিপে বল জালেও জড়িয়ে দেন। এরপর অফসাইড ভেবে গোলের উদ্‌যাপন করেননি। কিন্তু ভিএআর জানাল, লাইনসম্যান ভুল করেছেন, অফসাইড ছিলেন না অবামেয়াং। গোল! কিন্তু রিয়াল তা মানতে চাইবে কেন। রেফারির সঙ্গে বেশ তর্ক জুড়ে দিলেন মদরিচরা, কিন্তু লাভ হলো না।

৫৮ মিনিটে নিজের প্রথম ক্লাসিকোতে হ্যাটট্রিকই পূর্ণ করে ফেলতে পারতেন অবামেয়াং। কিন্তু বাঁ দিক থেকে জর্দি আলবার ক্রসে পা ছোঁয়ালেও বলটা পোস্টে রাখতে পারেননি জানুয়ারিতে বার্সায় যোগ দেওয়া গ্যাবনিজ স্ট্রাইকার।

ম্যাচ নিয়ে উত্তেজনা ততক্ষণে শেষ। ততক্ষণে আসেনসিও, ভাসকেজদের নামিয়ে দেওয়া রিয়াল কিছু আক্রমণ করেছে বটে। কিন্তু তাতে লাভ হয়নি। রিয়ালের দিনটাই তেমন ছিল না।

বেনজেমা পাশে না থাকলে ছন্নছাড়া ভিনিসিয়ুস ম্যাচজুড়ে কখনো ঝগড়া করেছেন, তো কখনো পেনাল্টি আদায়ে ডাইভ দিয়েছেন। মাঝমাঠে মদরিচের জাদুর রাস্তা বন্ধ করে রেখেছে আনচেলত্তির কৌশলই, পায়ে বলই তো সেভাবে পাননি মদরিচ।

বল যে ৬০ শতাংশ সময় বার্সার পায়েই ছিল। শটেও ১০-৪ ব্যবধানে এগিয়ে বার্সা। বলের দখলটাকে গোলে পরিণত করার প্রমাণ রাখা বার্সা বুঝিয়ে দিল, জাভির অধীনে উন্নতির যে গান এতদিন গাইছিল তারা, সেটির সুর স্পেন ছাড়িয়ে ইউরোপে পৌঁছে যাওয়া সময়ের ব্যাপার।