>আন্তর্জাতিক ফুটবলে কখনোই সফল ছিল না বাংলাদেশ। ব্যর্থতার বোঝা বইতে বইতে এক সময় দেশের ফুটবলের প্রতিই আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে এ দেশের ফুটবলপ্রেমীরা। আন্তর্জাতিক ফুটবলে যেখানে হারই নিত্যসঙ্গী, সেখানে অতীতে এমন কিছু ম্যাচ আছে, যেগুলো আফসোসে পোড়ায় সবাইকে। এশিয়ার শীর্ষ দেশগুলোর বিপক্ষে এ ম্যাচগুলোর ফল আসতে পারত বাংলাদেশের পক্ষেও
‘ফুটবলের সোনালি সময়’—কথাটাই এখন বহু ব্যবহারে ক্লিশে। আন্তর্জাতিক ফুটবলে কখনোই আহামরি কোনো ফল ছিল না বাংলাদেশের। দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের দেশগুলোকে নিয়ে আয়োজিত সাফ গেমস ফুটবলের সোনা জিততেই বাংলাদেশের লেগে গেছে ১৫ বছর আর আটটি আসর। এশিয়ান কাপ বা বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের ম্যাচগুলোতে এশিয়ার শীর্ষ দলগুলোর বিপক্ষে হারই হয়েছে নিত্যসঙ্গী। তারপরেও অতীতে কিছু ম্যাচ বাংলাদেশের ফুটবলাররা খেলেছিলেন নিজেদের অন্য উচ্চতায় তুলে ধরে। এশিয়ার শক্তিশালী দেশগুলোর বিপক্ষে এমন অনেক ম্যাচই আছে, যেগুলোতে ভাগ্য একটু সহায় হলেই জিতে যেতে পারত লাল-সবুজ বাহিনী। ম্যাচগুলো জিততে পারলে কে জানে এ দেশের ফুটবল ইতিহাসই হয়তো অন্যভাবে লেখা হতো। ফুটবলপ্রেমীরা পেতেন গর্ব করার উপকরণ। বাংলাদেশের ফুটবলে চিরকালীন আক্ষেপ হয়ে আছে এমন কয়েকটি ম্যাচের কাহিনি এখানে তুলে ধরা হলো...
প্রতিপক্ষ উত্তর কোরিয়া, ১৯৮০ এশিয়ান কাপ, কুয়েত
১৯৮০ সালে প্রথমবারের মতো ও এখনো পর্যন্ত শেষবার এশিয়ান কাপ ফুটবলের চূড়ান্তপর্বে নিজেদের জায়গা করে নিয়েছিল বাংলাদেশ। এশিয়ার শীর্ষ দলগুলোর বিপক্ষে সেবারের এশিয়ান কাপ অভিযাত্রা জয় ছাড়াই শেষ করেছিল কাজী সালাউদ্দিনদের বাংলাদেশ। উপরন্তু ইরান ও চীনের বিপক্ষে বড় ব্যবধানেও হার সঙ্গী হয়েছিল। নিজেদের গ্রুপে উত্তর কোরিয়ার বিপক্ষে ম্যাচটি দুর্দান্ত খেলেও ৩-২ গোলে হারতে হয় বাংলাদেশকে। গোলরক্ষক ওয়াহিদুজ্জামান পিন্টু ও রক্ষণের মিলিত ভুলে ম্যাচের ৪৪ ও ৪৫ মিনিটে পরপর দুটি গোল হজম করে বাংলাদেশ। একপর্যায়ে দেশের ফুটবলের দুই সেরা তারকার সমন্বয়ে ম্যাচে সমতায়ও ফেরা হয়েছিল। ৬০ মিনিটে পেনাল্টি থেকে গোল করেন কাজী সালাউদ্দিন। ৮৮ মিনিটে দুর্দান্ত এক গোল করে আশরাফউদ্দিন চুন্নু খেলাটাকে ড্রয়ের দিকেই নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু যোগ করা সময়ে আবারও রক্ষণের ভুল। এরপর সঙ্গী আফসোস!
প্রতিপক্ষ সিরিয়া, ১৯৮০ এশিয়ান কাপ, কুয়েত
সেটি ছিল বাংলাদেশের দ্বিতীয় ম্যাচ। উত্তর কোরিয়ার বিপক্ষে ম্যাচটির তিন দিন পর অনুষ্ঠিত এ খেলাতেও দুর্দান্ত ছিল বাংলাদেশ। ম্যাচের ৭ মিনিটের সময় সিরিয়ান স্ট্রাইকার কেশেক গোল করে দলকে এগিয়ে দেন। এরপরের গল্পটা নিজেদের করতে পারতেন সালাউদ্দিনরা। কিন্তু গোল করার ব্যর্থতায় শেষ পর্যন্ত হারই হয় সঙ্গী।
প্রতিপক্ষ চীন, ১৯৮২ এশিয়ান গেমস, দিল্লি
এ ম্যাচ নিয়ে একদমই আশাবাদী ছিলেন না সেবার বাংলাদেশের জার্মান কোচ গেরহার্ড স্মিথ। চীন তখন এশিয়ান সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ। আশির দশকের শুরুতে চীন খেলছিল নিজেদের সেরা ফুটবল। দিল্লির নেহরু স্টেডিয়ামে এ ম্যাচটা কিন্তু দুর্দান্তই খেলেছিল বাংলাদেশ। ২৩ মিনিটে গোল খেয়ে পিছিয়ে গেলেও বাকিটা সময় চীনকে যথেষ্ট ব্যতিব্যস্ত রাখা গিয়েছিল। তরুণ গোলরক্ষক মোহাম্মদ মহসিন খেলেছিলেন জীবনের অন্যতম সেরা ম্যাচ। আশিস ভদ্র, বাদল রায়রা গোলের সুযোগও পেয়েছিলেন। কিন্তু ঠিক জায়গাটাতেই যে আমাদের ফুটবলের চিরন্তন দুর্বলতা।
প্রতিপক্ষ সিরিয়া, ১৯৮৪ এশিয়ান কাপ বাছাই, জাকার্তা
সিরিয়ার বিপক্ষে আরও একটি দুর্দান্ত ম্যাচ। জাকার্তার সেনায়ান স্টেডিয়ামে খেলাটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৮৪ সালের ১১ আগস্ট। ম্যাচের ৬ মিনিটে ওয়াহেদ আবু এল-সিলের গোলে ১-০-তে এগিয়ে যায় সিরিয়া। ৪৪ মিনিট গোল শোধ করে দেন জসিমউদ্দিন জোসি। এ অবস্থায় খেলা এগিয়ে চলছিল সমানে-সমান। আসলাম, ওয়াসিম নষ্ট করেন দুটি সহজ সুযোগ। খেলাটি যখন ড্রয়ের দিকে এগোচ্ছে তখন মারওয়ান মাদারাতি গোল করে সিরিয়াকে এগিয়ে নেন ২-১-এ। এরপর আর খেলায় ফেরার সময় কোথায়?
প্রতিপক্ষ ইরান, ১৯৮৯ বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব, ঢাকা
ম্যাচের শুরুতেই পেনাল্টি পেয়েছিল বাংলাদেশ। একটা সংঘবদ্ধ আক্রমণ থেকে ইরানের বক্সে বল পেয়ে গিয়েছিলেন শেখ মোহাম্মদ আসলাম। তাঁকে ফাউল করায় সেই পেনাল্টি। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের (তখন ঢাকা জাতীয় স্টেডিয়াম) ৩০ হাজার দর্শক যখন ‘গোওওওল’ বলে চিৎকার করার জন্য অধীন ঠিক তখনই রুম্মান বিন ওয়ালি সাব্বিরের নেওয়া পেনাল্টিটি লাগল ক্রসবারে। ইরানের গোলরক্ষক আহমেদ রেজা আবেদ জাদেহ (১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপে ইরানের গোলরক্ষক) পুরোপুরি পরাস্ত ছিলেন। কিন্তু ক্রসবারই ইরানের গোলরক্ষকের ভূমিকা পালন করে সেদিন। এই ম্যাচে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ হেরেছিল ২-১ গোলে। দ্বিতীয়ার্ধে আসলাম দুরন্ত হেডের গোল করেছিলেন। এখনো অনেকের আফসোস, সাব্বির যদি পেনাল্টিটি কাজে লাগাতে পারতেন!
প্রতিপক্ষ ইরান, ১৯৮৯ বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব, তেহরান
এটি ছিল বাংলাদেশের অ্যাওয়ে ম্যাচ। তেহরানের আজাদি স্টেডিয়ামের ৭০ হাজার দর্শকের সামনে সেদিন কী খেলাটাই না খেলেছিল বাংলাদেশ। তীব্র লড়াইয়ে যোগ করা সময় পর্যন্ত ম্যাচের স্কোরলাইন ছিল গোলশূন্য। একেবারে অন্তিম মুহূর্তে একটি কর্নার থেকে কায়সার হামিদ, মোনেম মুন্নাদের গড়া রক্ষণে ফাটল ধরান ইরানি স্ট্রাইকার গেহেরগান। তাঁর হেড গোলরক্ষক মহসিনকে নড়ার সুযোগ না দিয়েই জালে জড়ায়।
প্রতিপক্ষ আরব আমিরাত, ১৯৯৩ বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব, ইয়োকোহামা
১৯৯০ সালে বিশ্বকাপ ফুটবলের চূড়ান্তপর্বে খেলেছিল সংযুক্ত আরব আমিরাত। ১৯৯৪ বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে খেলেছিলেন আমিরাতের হয়ে বিশ্বকাপ খেলা খেলোয়াড়েরাই। তাদের বিপক্ষেই ১৯৯৩ সালের ১৫ এপ্রিল ১-০ গোলে হেরেছিল বাংলাদেশ। জাপানের ইয়োকোহামার সেই ম্যাচে রুমি-সাব্বিররা বারবারই কাঁপন ধরিয়েছেন আমিরাতের রক্ষণ-দুর্গে। গোলরক্ষক মহসিন ছিলেন দুর্দান্ত। ঠেকিয়েছিলেন একটি পেনাল্টি। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। পেনাল্টি গোলেই আমিরাতের কাছে হার মানতে হয় সেদিন।
প্রতিপক্ষ লেবানন, ২০১৪ বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব, ঢাকা
এটি বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসের সেরা ম্যাচই। শক্তিশালী লেবাননকে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে সে ম্যাচে ২-০ গোলে হারিয়ে দিয়েছিল জাহিদ হাসান এমিলি-মিঠুন চৌধুরীদের বাংলাদেশ। তবে ম্যাচটিতে জিতলেও বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে সেদিন উপস্থিত হাজার বিশেক দর্শক মাঠ ছেড়েছিলেন বিমর্ষ মুখে, আক্ষেপ করতে করতেই। একটা বড় সুযোগ নষ্ট করারই আক্ষেপটাই সেদিন বড় হয়ে উঠেছিল লেবাননের বিপক্ষে জয়ের চেয়ে। অ্যাওয়ে ম্যাচে বৈরুতে বাংলাদেশ হেরেছিল ৪-০ গোল। হোমে ২-০ গোলে জয়। বৈরুতের ম্যাচটা ভালো খেললেই হয়তো দেশের ফুটবল অন্য উচ্চতায় নিজেদের দেখত। লেবাননকে পার করতে পারলে বাংলাদেশ সেবার লড়ত এশিয়ার শীর্ষ ১৫ দলের একটি হয়ে। একটি জয়ও যে আফসোসের কারণ হতে পারে, ২০১১ সালে খুব ভালো করেই তা বুঝেছিলেন ঢাকার দর্শকেরা।