ম্যারাডোনার হাতে উল্কি আঁকা। বাঁ পায়েও উল্কি। হাভানা চুরুট মুখে। চুরুট টানার ভঙ্গি দেখলে মনে হয় পৃথিবীর সব নিয়মশৃঙ্খলাকে বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছেন।
কিন্তু পায়ের সামনে একটা বল ঠেলে দিন, এই মানুষটাই তখন বলকে এমনভাবে বশ মানাবেন যে দেখে মনে হবে, পৃথিবীতে এর চেয়ে গোছালো কিছু আর হতে পারে না।
অথচ তাঁর ডান হাতের উল্কিতে শোভা পান চে, বাঁ পায়ের উল্কিতে কাস্ত্রো। কথিত সভ্য দুনিয়ার লাতিন অঞ্চলে তাঁদের চেয়ে বড় ‘বিপ্লবী’ আর কে! রক্তে এই নিয়ম ভাঙা আর পায়ে ড্রিবলিংয়ের নতুন সব নিয়ম গড়া মানুষটাই তো ম্যারাডোনা!
লোকে বলে, রক্তের টান এড়ানো যায় না। তেমনি বিপ্লবীরাও ‘কমাদান্তে’দের প্রতি টান এড়াতে পারেন না। ম্যারাডোনা কখনো সরাসরি বলেননি তিনি বামপন্থী, শুধু বলেছিলেন, ‘আমি ফিদেলিস্তা’।
কথাটা মতাদর্শের জায়গা থেকে এক ভুবনের বিপ্লবীর প্রতি আরেক ভুবনের বিপ্লবীর হৃদয় নিংড়ানো নৈবেদ্য। ম্যারাডোনার মৃত্যুতে এই অর্ঘ্য যেন আরও পূর্ণতা পেল। পিতৃসম ‘বন্ধু’ কিউবার অবিসংবাদিত নেতা কাস্ত্রো ও ম্যারাডোনার মৃত্যু যে একই দিনে—ডেটলাইন ২৫ নভেম্বর!
তারিখটা আরও চেনা লাগতে পারে। এদিন যে মৃত্যু ম্যারাডোনার জগতের আরেক ‘বিপ্লবী’র। আর্জেন্টাইনের মতো তাঁর জীবনও ক্ষয়ে গেছে প্রতিভা ও অনিয়ন্ত্রিত জীবনের যূপকাষ্ঠে। অনেকের চোখেই তিনি বিশ্বকাপে খেলতে না পারা সেরা ফুটবলার—জর্জ বেস্ট।
তাহলে কী বলবেন, বিপ্লবী—সে, যে জগতেরই হোক কমাদান্তে (কমান্ডার) কি কমাদান্তের প্রতি টান এড়াতে পারেন!
ম্যারাডোনা পারেননি বলেই ড্রাগের আসক্তি থেকে মুক্তি (!) পেতে ২০০০ সালে ছুটে গিয়েছিলেন কিউবায় কাস্ত্রোর আশ্রয়ে—ম্যারাডোনার চোখে যিনি তাঁর ‘দ্বিতীয় পিতা’ ও বন্ধু।
এই কাস্ত্রো আবার ম্যারাডোনার দেশের বিপ্লবী প্রবাদপুরুষ চে গুয়েভেরার বন্ধু ও সহযোদ্ধা। ম্যারাডোনা চে–কেও লালন করেছেন মনেপ্রাণে। মাটির পৃথিবী ছেড়ে ওই আকাশের ওপারে এখন নিশ্চয়ই চুটিয়ে আড্ডা জমেছে ত্রিরত্নের! ভুল হলো।
হুগো চাভেজও তো আছেন। চিরকালই নিয়ম ভাঙার অভ্যাসদুষ্ট ম্যারাডোনা হয়তো গিয়েই তাঁর ‘বন্ধু’দের বলছেন, স্বর্গের নিয়ম–টিয়ম মেনে চলো কীভাবে! চলো পাল্টে দিই।
বিপ্লবীরা প্রথাগত বিষয়–আশয় পাল্টে দিতে ভালোবাসেন। তার আগে মনে মনে মিলতে হয়। কাস্ত্রো চার বছর আগে অন্যলোকে চলে গেলেও তাঁর মতাদর্শ ধরে রেখেছিলেন ম্যারাডোনা।
কয়েক দিন আগেও সার্বিয়ান এক সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘বুয়েনস এইরেসে সবচেয়ে দরিদ্র অঞ্চলে আমার জন্ম। জায়গাটা এখনো দারিদ্র্যপীড়িত। বন্ধুরাও আছে আগের মতোই। শুধু রাজনীতিবিদ আর সরকারি লোকেরা দিন দিন ধনী হচ্ছে। ধনী হওয়ার সুযোগ আমারও ছিল। সে জন্য গরিবের কাছ থেকে চুরি করতে হতো।’
ম্যারাডোনার এই কথা উসকে দেয় লাতিন আমেরিকার বামপন্থীদের স্মৃতি।
ভেনেজুয়েলার বামপন্থী প্রেসিডেন্ট হুগো চাভেজকে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছেন তিনি। তৃতীয় বিশ্বের গরিব দেশগুলোর পক্ষ থেকে তিনি সমালোচনা করে গেছেন প্রথম বিশ্বের ধনী দেশগুলোর।
বিপ্লবীরা যেমন ভেবে থাকেন আরকি—‘রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি।’ রবি ঠাকুরের এই লাইনে হেঁটেই ম্যারাডোনার বন্ধুত্ব হয়েছিল কাস্ত্রোর সঙ্গে।
নিজের আত্মজীবনী তিনি যে কজন মানুষকে উৎসর্গ করেছিলেন, কাস্ত্রো ছিলেন তাঁদের অন্যতম। দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ম্যারাডোনা বলে গেছেন, আমি ফিদেলিস্তা ও চাভিস্তা—ফিদেল ও চাভেজ যা করে আমার কাছে সেগুলোই সঠিক।
আর্জেন্টাইন কিংবদন্তির এই ঠিক–বেঠিকের দুনিয়ায় ফিদেলের জায়গাটা বরাবরই একটু আলাদা। ১৯৫৯ সালে স্বৈরাচারী বাতিস্তা সরকারকে উৎখাত করেছিলেন গেরিলাযোদ্ধা কাস্ত্রো ও চে গুয়েভারা।
ম্যারাডোনার জীবনে দুজনের প্রভাবই অসামান্য। চে–র আদর্শ মনে লালন করে তিনি প্রাণ খুলে মিশেছেন কাস্ত্রোর সঙ্গে। ঠিক যেভাবে ভালোবেসেছিলেন বলকে, কাস্ত্রোকেও ম্যারাডোনার এ স্বার্থহীন ভালোবাসার শুরু ১৯৮৬ বিশ্বকাপ জয়ের পর। সেই বিশ্বকাপ জিতে ম্যারাডোনা অমরত্বের পাতায় নাম লেখানোর পরের বছর গিয়েছিলেন হাভানা চুরুটের দেশে।
কাস্ত্রোর গেরিলাযুদ্ধ, বিপ্লব আর অসামান্য সব গল্প শুনেছিলেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো। কিউবা–বিপ্লবের সেসব দাহকালের গান ভীষণভাবে দাগ কেটেছিল ম্যারাডোনার মনে।
এরপর বহুবার গেছেন কিউবায়। প্রতিবারই কিছু না কিছু উপহার নিয়ে গেছেন প্রিয় বন্ধুর জন্য। বেশির ভাগ সময়েই উপহার দিয়েছেন নিজের জার্সি—যেন বোঝাতে চেয়েছিলেন, বন্ধু বল পায়ে এক ‘বিপ্লবী’র উর্দিও পরে দেখো কেমন লাগে!
জীবন বাঁচিয়ে বন্ধুর এই ভালোবাসা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন ফিদেল কাস্ত্রো।
কুড়ি বছর আগের সেই সময়ে আর্জেন্টাইন সংবাদমাধ্যমে ফলাও করা ছাপা হয়েছিল অন্য এক ম্যারাডোনার ছবি। বেঢপ ফোলা শরীর, ফ্যাকাশে হয়ে আসা চুলের রং।
বোঝাই যাচ্ছিল, কোকেন ছাড়াও অন্যান্য মাদকের নেশায় কিংবদন্তির জীবন যায় যায়! প্রমাদ গুনলেন কাস্ত্রো। ম্যারাডোনাকে উড়িয়ে আনলেন কিউবায়। দেশের সেরা চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে রাখলেন ‘লা পেদ্রেরা’ হাসপাতালে। তাতে ধীরে ধীরে সুস্থতার মুখও দেখতে শুরু করলেন ম্যারাডোনা।
সে সময় তাঁর পাশে থাকা ঘনিষ্ঠরা পরে সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, কাস্ত্রোই ম্যারাডোনার জীবন বাঁচিয়েছেন। কিন্তু বিপ্লবীরা তো আর পরের কথায় চলেন না। তাঁরা চলেন খরস্রোতা নদীর মতো আপন বেগে।
সিআইএ কাস্ত্রোকে বহুবার হত্যার চেষ্টা করেছে। কাস্ত্রো বারবার বেঁচে গেলেও কখনো পাত্তা দেননি। ম্যারাডোনাও তেমনি মাদক ছেড়ে আবার ঘুরেফিরে মাদকেই ডুবে ফুটো পয়সা দাম দেননি নিজের জীবনকে।
বিপ্লবীদের জন্য তাহলে ওই কথাটাই চিরসত্য। আর্জেন্টিনার রাস্তায় বেশ কয়েক বছর আগে এক ব্যানারে কথাটা দেখেছিলেন পেপ গার্দিওলা, ‘নিজের জীবন নিয়ে তুমি কী করলে, তা আমরা ভাবি না, ডিয়েগো। তুমি আমাদের জীবনকে কীভাবে রাঙালে, সেটা আমরা মনে রাখি।’
চার বছর আগে কাস্ত্রোর মৃত্যুর সময় ম্যারাডোনা ছিলেন ক্রোয়েশিয়ায়। উপভোগ করছিলেন একটি টেনিস টুর্নামেন্ট। কাস্ত্রোর মৃত্যুসংবাদ শুনে ম্যারাডোনার প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল, ‘কান্নার বাঁধ ভেঙে গিয়েছিল। বাবার মৃত্যুর পর এই কষ্টটাই সবচেয়ে গভীর। বন্ধুকে দাহ করতে আমি কিউবা যাব।’
বন্ধুর প্রতি ম্যারাডোনার এই আবেগ কতটা অকৃত্রিম, কতটা নিরেট ছিল, তা বোঝা যায় তাঁর আরেকটি কথায়।
কিউবায় চিকিৎসা নিতে চার বছর ছিলেন ম্যারাডোনা। সেসব দিন স্মরণ করে ম্যারাডোনা বলেছিলেন, ‘তিনি আমার জন্য কিউবার দরজা খুলে দিয়েছিলেন, যখন আর্জেন্টিনার ক্লিনিকগুলো দরজা বন্ধ করে দিচ্ছিল, নিজেদের হাতে ম্যারাডোনার মৃত্যু তারা চায়নি।’
কাস্ত্রো ম্যারাডোনার জন্য শুধু চিকিৎসার দ্বার খোলেননি। হৃদয়ের দ্বারও খুলে দিয়েছিলেন। কিউবার সেসব দিনে দুজন একসঙ্গে হাঁটতে বের হতেন সকালে।
তখন খেলাধুলা ও রাজনীতি নিয়ে যুক্তিতর্ক, আলোচনা জমে উঠত দুজনের। এমনকি ২০০৫ সালেও এক টিভি অনুষ্ঠানে কাস্ত্রোকে ডেকে এনে পশ্চিমা দেশগুলোর মুণ্ডুপাত করেছিলেন দুজন।
ম্যারাডোনা নিজেও টিভি অনুষ্ঠানে অতিথি হয়ে গেছেন। সঞ্চালক ছিলেন চাভেজ। কিংবদন্তি সেখানে সোজাসাপ্টা বলেছিলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র থেকে যা যা আসে, আমি সব ঘৃণা করি। নিজের সর্বশক্তি দিয়ে ঘৃণা করি।’
ম্যারাডোনা যে বামপন্থীদের সঙ্গে মেশার পর থেকে এমন হয়ে গিয়েছিলেন, তা নয়। ১৯৮৬ বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডকে হারানো তাঁর জন্য ছিল ‘দেশের হয়ে যুদ্ধজয়’।
তার চার বছর আগে ফকল্যান্ড দ্বীপ নিয়ে যুদ্ধ বেধেছিল ইংল্যান্ড–আর্জেন্টিনার। নিজের আত্মজীবনী ‘আই অ্যাম ডিয়েগো’তে ম্যারাডোনা লিখে গেছেন, ‘আর্জেন্টাইনদের সেখানে পাখির মতো মারা হয়েছে। এটা (ম্যাচ) ছিল প্রতিশোধ। আমরা এভাবে মালভিনাস (ফকল্যান্ড) ফিরে পেতে চেয়েছি। জাতীয় পতাকার জন্য খেলেছি।’
কাস্ত্রো, চে, চাভেজও লড়েছেন দেশের মানুষের জন্য, পতাকার জন্য। ম্যারাডোনার লড়াই অন্য রকম। প্রথম তিনজনকে কখনো খেলার মাঠে লড়তে হয়নি।
ম্যারাডোনাকে লড়তে হয়েছে টাচলাইনের ভেতরে–বাইরে, এমনকি নিজের জীবনের সঙ্গেও। এক অর্থে তাই ম্যারাডোনাও সত্যিকারের বিপ্লবী।
তাঁর বন্ধুরা লাতিন আমেরিকায় বহু নিপীড়িত–শোষিত মানুষদের মুক্তির দুয়ার খুলেছেন, ম্যারাডোনাও কথা বলেছেন গোটা বিশ্বের হয়ে—মাঠ ও মাঠের বাইরে।
আর তাই কিংবদন্তি অন্যলোকে পা রাখার পর কাস্ত্রো, চে, চাভেজরা হয়তো তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছেন, ‘বন্ধু, কী খবর বলো!’
রোগ–শোক, অন্যায়–অবিচারের পৃথিবীতে যুদ্ধ শেষ না করেই চলে যাওয়া ম্যারাডোনা হয়তো শুকনো মুখে জবাব দিয়েছেন, ‘আস্তা লা ভিকতোরিয়া সিয়েম্প্রে’—চূড়ান্ত বিজয় না হওয়া পর্যন্ত লড়াই করো, কথাটা বুঝিয়ে দিয়ে এসেছি।
সমস্বরে হয়তো এরপর চারটি কণ্ঠের আওয়াজ শোনা যাবে, ‘বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক!’