ডিয়েগো ম্যারাডোনার বার্সেলোনা অধ্যায় নিয়ে আলোচনা খুব কম হয়। নাপোলিকে বিশ্বের প্রতিটি কোনায় পৌঁছে দেওয়ার কীর্তির আড়ালেই থাকে কিংবদন্তির বার্সেলোনা-অধ্যায়। প্রথম বার্সেলোনা খেলোয়াড় হিসেবে রিয়াল মাদ্রিদের মাঠে রিয়ালেরই সমর্থকদের করতালি আদায় করে নিয়েছিলেন। অ্যাথলেটিক বিলবাওয়ের বিপক্ষে ক্যারিয়ার হুমকির মুখে ফেলে দেওয়া এক ট্যাকলের শিকার হয়েছিলেন। সেই বিলবাওর বিপক্ষেই পরে স্পেনের রাজার সামনে ভয়ংকর এক মারামারির সূত্রপাত করে ক্লাবের বিরাগভাজন হয়েছিলেন। ব্যস, ম্যারাডোনার বার্সেলোনার অধ্যায়ের গল্পের সারসংক্ষেপ যেন এটুকুই।
ম্যারাডোনাকে কীভাবে বার্সেলোনা পেয়েছিল, কীভাবে ১৯৮২ বিশ্বকাপের আগেই তাঁর সঙ্গে চুক্তি করে রেখেছিল বার্সেলোনা, সে গল্প হয়তো অনেকের অজানা। মেসির মতোই ম্যারাডোনাকে বার্সেলোনায় নেওয়ার কৃতিত্বটা এজেন্ট জোসেপ মারিয়া মিনগেয়ার। ২০১৮ সালে স্প্যানিশ পত্রিকা স্পোর্তে ম্যারাডোনাকে বার্সেলোনায় নেওয়ার গল্পটা করেছিলেন মিনগেয়া। ম্যারাডোনার মৃত্যুর পর তাঁর কলামটা আবার ছাপিয়েছে স্পোর্ত। এখানে হুবহু সেটা তুলে দেওয়া হলো।
ডিয়েগোকে একদম কম বয়সে খুঁজে পেয়েছিলাম আমি, সেটাও ভাগ্যক্রমে। সে এতটাই ভালো ছিল যে আমি বার্সেলোনাকে বলেছিলাম ওকে নিয়ে নিতে। সরাসরি তাদের মহাব্যবস্থাপক হাউমে রোসেলকেই (২০১০-১৪ সালে বার্সেলোনা সভাপতি সান্দ্রো রোসেলের বাবা) বলেছিলাম। সে সময় বার্সেলোনার সভাপতি ছিলেন অগুস্তি মন্তাল কস্তা। তিনি এ প্রস্তাব বাতিল করে দেন। সে সময় মাত্র এক লাখ ডলার খরচ হতো, কিন্তু ম্যারাডোনার বয়স তখন মাত্র ১৬ বছর। আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে ওই মুহূর্তে এত বড় ঝুঁকি নিতে রাজি হয়নি তারা।
এটা ১৯৭৭ সালের ঘটনা। দুই বছর পর অবশেষে আলোচনা আবার শুরু হলো। দীর্ঘ আলোচনার পর ১৯৮০-তে এসে সব ঠিক হলো। কিন্তু ১৫ বা ২০ দিন পর আর্জেন্টিনা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের (এএফএ) সভাপতি হুলিও গ্রন্দোনা আমাকে ফোন করলেন। আমাকে জানালেন এই দলবদল নিয়ে একটা ঝামেলা হচ্ছে। আমাকে আর্জেন্টিনায় গিয়ে সমাজকল্যাণমন্ত্রী অ্যাডমিরাল লাকোস্তের সঙ্গে কথা বলতে বলা হলো। ১৯৭৮ বিশ্বকাপ সফলভাবে আয়োজন করতে পারায় তিনি এ দায়িত্ব (মন্ত্রিত্ব) পেয়েছিলেন। সেবার মেনোত্তির অধীনে স্বাগতিক আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ জেতায় সেটাও একটা প্রভাব রেখেছিল। ম্যারাডোনাকে সেবার দলে রাখা হয়নি বয়স কম বলে। তাঁর জায়গায় সুযোগ মিলেছিল কেম্পেসের (১৯৭৮ বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় ও সর্বোচ্চ গোলদাতা)।
লাকোস্তে কথা বলার জন্য যে আয়োজন করেছিলেন, তার সঙ্গে গা-ছমছম করা কোনো চলচ্চিত্রেরই মিল পাওয়া যাবে। পরে জেনেছিলাম, আমাকে যেখানে নেওয়া হয়েছিল, স্বৈরাচার সরকারের অধীনে বহু লোককে সেখানে নিয়ে গায়েব করে দেওয়া হয়েছিল। এক সৈন্য আমাকে নিতে এসেছিল। আমি এক অন্ধকার সুড়ঙ্গে ঢুকলাম। একদম শেষ প্রান্তে ছোট্ট একটা আলো দেখা যাচ্ছিল। সেখানেই ছিলেন অ্যাডমিরাল। ওনার মনোভাব আমার কাছে একদম পরিষ্কার করে দিয়েছিলেন, ‘তুমি এখন ডিয়েগোকে নিতে পারবে না। তোমাদের বিশ্বকাপে (স্পেনের ১৯৮২ বিশ্বকাপ) ওকে দরকার আমাদের।’ ব্যস, ওখানেই সব শেষ। ডিয়েগোর আর দল বদলানো হলো না।
আমাদের আবার অপেক্ষায় থাকতে হলো এবং ব্যাপারটা দিন দিন আরও জটিল হয়ে উঠেছিল। আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্স ম্যারাডোনাকে বোকা জুনিয়র্সে ধারে পাঠিয়েছিল, বোকা জুনিয়র্স পরে তাকে পাকাপাকিভাবে কিনে নেবে, এই শর্ত দিয়ে। কিন্তু বোকা (ম্যারাডোনার দলবদল থেকে) একটা পয়সাও পাক, এটা তারা চায়নি। চুক্তির দর-কষাকষিগুলো জুনিয়র্সের দ্বিতীয় সভাপতি করছিলেন। তাঁর সঙ্গেই আমার কাজ করতে হচ্ছিল—কমিশনার দমিঙ্গো তেসোনে। প্রথমবার যখন আমাদের দেখা হলো, উনি পকেট থেকে একটা পিস্তল বের করলেন আর সেটা টেবিলের ওপর রাখলেন। আমি তো চমকে গেলাম, চিন্তায়ও পড়ে গেলাম। উনি মাফ চেয়ে বললেন, ‘আশা করি এটা আপনাকে অস্বস্তিতে ফেলছে না। এটার ওজন অনেক তো... (তাই বের করা)।’
ওভাবেই, টেবিলে পিস্তল থাকা অবস্থাতেই ম্যারাডোনার বার্সেলোনায় যাওয়ার চুক্তিটা করেছি আমি। কিন্তু নুনেজ (জোসেপ লুইস নুনেজ, সে সময়কার বার্সেলোনা সভাপতি), গাসপার্ত (হুয়ান গাসপার্ত, বার্সার পরবর্তী সভাপতি) আর্জেন্টিনায় যাওয়ার পরও সে চুক্তি বাতিল হয়ে যায়। সবাই আবার বার্সেলোনায় ফিরে আসি। কিন্তু অবশেষে আমি সফল হয়েছি। বার্সেলোনাতেই চুক্তিটা স্বাক্ষর করা হয়। বার্সেলোনা সে সময়কার বিশ্ব রেকর্ড ১২০ কোটি পেসেতা (৭২ লাখ ইউরোতে) নিয়ে আসে ম্যারাডোনাকে।