তাঁরা দুজনই নৈশপ্রহরী। পঞ্চাশ পেরোনো বয়স। ডিয়েগো ম্যারাডোনার মারা যাওয়ার খবরটা যখন শুনেছেন, দুজন একই জায়গায় ছিলেন। খবর শুনে একজন বলে ওঠেন, ‘মানুষটা অতিরিক্ত মাদক নিয়ে নিজেকে শেষ করে দিল...।’ প্রথমজনকে ওখানেই থামিয়ে দ্বিতীয়জনের কথা, ‘মাদক নিক বা যা–ই করুক, বিশ্বের সেরা ফুটবলার তো তিনিই ছিলেন। কী ভালো ফুটবল যে খেলতেন ম্যারাডোনা!’ প্রথমজন এবার আর আপত্তি করলেন না। হ্যাঁ–সূচক মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, ‘ঠিক, এমন ফুটবলার আর আসবে না পৃথিবীতে।’
ম্যারাডোনার জীবনচক্রে তাকালে তাঁর দুই রকম ছবিই দেখতে পাবেন, যে ছবিটা দেখালেন ঢাকার ওই দুই নৈশপ্রহরী। ম্যারাডোনার পায়ে যখন বল থাকত, ফুটবল মাঠে ফোটাতেন বর্ণিল সব ফুল। ফুটবলের সঙ্গে, বিশ্বজোড়া ফুটবলপ্রেমীদের সঙ্গে কখনোই তিনি প্রতারণা করেননি। মাঠের সবুজে সব সময়ই নিজেকে উজাড় করে দিয়ে বিলিয়েছেন অমীয় আনন্দ। ১৯৮২ থেকে ১৯৯৪—চারটি বিশ্বকাপ খেলেছেন। যখনই মাঠে নেমেছেন, রচনা করেছেন ফুটবলের একেকটি অমরাবতী।
ক্লাব ফুটবলেও কম বর্ণাঢ্য ছিল না ম্যারডোনার ক্যারিয়ার। আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্স, বোকা জুনিয়র্স, বার্সেলোনা, নাপোলি, সেভিয়া—যখন যেখানে খেলেছেন, পসরা সাজিয়েছেন সৃজনশীল ফুটবলের। ঝাঁকড়া চুলের মহান ফুটবলারের ক্যারিয়ার হিমালয় স্পর্শ করেছিল আশির দশকের শেষ দিকে। ১৯৮৬ সালে আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ জিতিয়েছেন অধিনায়ক হিসেবে। ১৯৮৭ ও ১৯৯০ সালে নাপোলিকে জিতিয়েছেন সিরি ‘আ’ শিরোপা। ১৯৮৯ সালে ইতালির ক্লাবটির হয়ে জিতেছেন উয়েফা কাপ।
শুধু শিরোপা জেতানোতেই লুকিয়ে নেই ম্যারাডোনার মাহাত্ম্য। একা একটি দলকে কীভাবে বিশ্বকাপের মতো একটি টুর্নামেন্ট জেতানো যায়, কীভাবে মৌসুমের শুরু থেকে শেষ অবধি একটি দলকে টেনে নিয়ে লিগ শিরোপা জেতানো যায়—এসব দেখিয়েছেন ম্যারাডোনাই। শুরুটা করেছিলেন আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্সের বলবয় হিসেবে। ১২ বছরের ম্যারাডোনা সেখানে ম্যাচ বিরতিতে বল নিয়ে বিভিন্ন কারিকুরি দেখাতেন। সেসব দেখে মুগ্ধ আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্সের কোচ তাঁকে বড়দের দলে নেওয়ার ব্যবস্থা করেন। ১৯৭৬ সালে ১৬ বছর বয়সে বড়দের দলে অভিষেক হয় তাঁর।
আর্জেন্টিনো জুনিয়র্সে অভিষেক বদলি হিসেবে। মাঠে নামানোর সময় কোচ ম্যারাডোনাকে বলে দিয়েছিলেন, ‘ডিয়েগো তুমি যেটা করে দেখাতে চাও, সেটা দেখাও। ড্রিবল করো, প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়কে কাটাও!’ ম্যারাডোনা সেদিন শুধু একজনকে নয়, অনেক খেলোয়াড়কেই তাঁর মায়াবী ড্রিবলে মোহিত করেছিলেন। বুয়েনস এইরেসের লানুসের এক বস্তির ছেলের কাছে অভিষেকের সেই দিনটিকে মনে হয়েছিল স্বর্গ ছোঁয়ার দিন। ফুটবলপ্রেমীদের কাছে দেবতার আসনে বসা ম্যারাডোনা। আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্স থেকে ১৯৮১ সালে নাম লেখান বোকা জুনিয়র্সে। সেখান থেকে বার্সেলোনা হয়ে ১৯৮৪ সালে গায়ে তোলেন নাপোলির জার্সি।
কিন্তু এমন কালজয়ী ফুটবলারের জীবনের অন্য পিঠটা কেমন ছিল? এক বাক্যে উত্তর—মাদকের বিষাক্ত কাঁটায় ভরা। সেই জীবনে কখনো কখনো নরকযন্ত্রণাও সইতে হয়েছে ম্যারাডোনাকে। গায়ে বিঁধেছে নিন্দার কাঁটা। অনেকে মনে করেন নাপোলিতে যাওয়ার পরই এই কালো অধ্যায়টা যোগ হয়েছে ম্যারাডোনার জীবনে। কিন্তু আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন, কোকেনে আসক্তি তাঁর আরও আগে থেকেই ছিল।
১৯৯১ সালে কোকেন নেওয়ার অপরাধে ১৫ মাস নিষিদ্ধ ছিলেন ফুটবলে। ফিরে এসে আবার খেলেছেন ১৯৯৪ বিশ্বকাপে। কিন্তু ডোপ টেস্টে পজিটিভ হয়ে মাঝপথেই ফিরে যেতে হয়েছে দেশে। ম্যারাডোনার ১৯৯৪ বিশ্বকাপের ‘অকালমৃত্যু’ মেনে নিতে পারেনি অনেকেই। বাংলাদেশেও এ নিয়ে প্রতিবাদ মিছিল–সমাবেশ হয়েছিল। তবে কোনো কিছুই আর ম্যারাডোনাকে আর্জেন্টিনার জার্সিতে খেলোয়াড় হিসেবে মাঠে ফেরাতে পারেনি। ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচটা তিনি খেলেছেন বোকা জুনিয়র্সের হয়ে, ১৯৯৭ সালে।
খেলোয়াড়ি জীবনকে বিদায় জানানোর পর মাঠে ফিরেছেন কোচ হয়ে। ২০১০ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার ডাগআউটে ছিলেন ম্যারাডোনা। কিন্তু মাদকের কালো থাবা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারেননি কখনোই। অতিরিক্ত কোকেন সেবনের কারণে ২০০৪ সালে একবার মৃত্যুর কিনারে চলে গিয়েছিলেন। মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছে গিয়েছিলেন ২০০৭ সালেও। দুবারই ঈশ্বরের কাছে হাঁটু গেড়ে ম্যারাডোনার জীবন ভিক্ষা চেয়েছেন বিশ্বজোড়া ফুটবলপ্রেমীরা।
ম্যারাডোনা ফিরে এলেও মাদকের অতলে হারিয়ে যাওয়া থেকে তাঁকে কেউ আটকাতে পারেননি। কিন্তু ফুটবল পায়ে এগোতে থাকা ম্যারাডোনাকেও তো কেউ থামাতে পারতেন না সহজে! এমন একজনকে ফুটবলারকে কোন চোখে দেখবেন? তাঁকে রাখবেনই–বা কোথায়? উত্তরটা দিয়ে দিলেন ওই দুই নৈশপ্রহরীই—যিনি যা–ই বলুন, ম্যারাডোনা তাঁর জীবনে যত যা–ই করুন; তাঁর চেয়ে বড় কোনো ফুটবলার ছিলেন না, নেই আর আসবেনও না।