>এনগোলা কান্তেকে মনে আছে? সেই যে বিশ্বকাপ ফাইনালের পর ফ্রান্স দলের সতীর্থদের কাছ থেকে ট্রফিটা নিতে লজ্জা পাচ্ছিলেন! সেই সহজ-সরল কান্তেকে মেসি-রোনালদোরা ‘আদর্শ’ বানাতে পারেন। কেন?
রাশিয়া বিশ্বকাপের কথা নিশ্চয় সবাই ভুলে বসেননি। ক্রোয়েশিয়াকে ৪-২ গোলে হারানোর পর বিশ্বকাপের ট্রফিটা নিয়ে ফরাসি ফুটবলারদের দৌড়াদৌড়িও মনে থাকার কথা। তবে এর মাঝে এনগোলো কান্তেকে কারও চোখে পড়ার কথা নয়। পরে অলিভার জিরু কারণটাও জানিয়েছেন। নিপাট ভদ্রলোক কান্তে সতীর্থদের কাছ থেকে ট্রফিটা চেয়ে নিতে লজ্জা পাচ্ছিলেন! স্টিফেন এনজোনজি ব্যাপারটা খেয়াল না করলে এবং অন্যদের ট্রফিটা কান্তের হাতে দিতে না বললে বিশ্বকাপ হাতে কান্তের ছবি দেখার সুযোগ হতো না কারও। এতটাই সরল, লাজুক, সাদাসিধে ও নিষ্পাপ এই ফ্রেঞ্চ মিডফিল্ডার।
কান্তের এমন সারল্যের গল্প অনেক আছে। ফ্রান্স থেকে ইংল্যান্ডে আসার পর প্রথম গাড়ি কিনতে বাধ্য হন কান্তে। প্রথমে নিজে হেঁটে বা দৌড়েই অনুশীলনেই যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সবার পরামর্শে (পড়ুন জোরাজুরিতে) গাড়ি কিনতে বাধ্য হন। সেখানেও সবাইকে বিস্মিত করেছেন। অন্যান্য ফুটবলাররা যেখানে স্পোর্টস কার কিনে সবাইকে চমক দেখাতে ব্যস্ত, সেখানে কান্তে কিনেছিলেন একটি মিনি কুপার। কারণ এই ক্ষুদ্রাকার সাশ্রয়ী গাড়িটা চালাতে সহজ! দুটি প্রিমিয়ার লিগ ও এফএ কাপ জেতার পরও গাড়িটা বদলায়নি কান্তের। এখনো এই মিডফিল্ডারকে মিনি কুপারে চড়তে দেখেন সবাই।
২৭ বছর বয়সী এই মিডফিল্ডারের সারল্যের এমন গল্পগুলোকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে ফুটবল লিকস। জার্মান পত্রিকা ডার স্পেইগেল কদিন আগেই ফুটবল লিকসের তথ্য জানিয়েছে সবাইকে। এতে ফুটবলের যত কলঙ্ক, দাগ আছে অধিকাংশই বের হয়ে এসেছে। নতুন এক বিদ্রোহী লিগ খেলার প্রস্তাবও বেড়িয়ে এসেছে। কদিন আগেই এই স্পেইগেল রোনালদোর বিপক্ষে ধর্ষণের অভিযোগ এনেছিল অন্যান্য ফুটবলারের লুকানো সব লজ্জাও বেরিয়ে আসছে ফুটবল লিকসে। কান্তেই একমাত্র ফুটবলার, ফুটবল লিকসের তথ্য যাকে আরও মহিমান্বিত করেছে। সেটা হলো, করের হাত থেকে বাঁচার সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়ার পরও কান্তে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। নিজের আয় থেকে কর দিতে কোনো আপত্তি নেই তাঁর।
লেস্টারসিটিকে প্রিমিয়ার লিগ জেতানোর পরের বছরই চেলসি কান্তেকে নিয়ে এসেছে লন্ডনে। এই দলবদলের আগে জার্সিতে (দেশ) একটি প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করা হয়েছিল কান্তের নামে। যেটার মাধ্যমে কান্তের ছবি স্বত্বের অর্থ জমা হবে। ফলে ইংল্যান্ডের উচ্চ কর থেকে বেঁচে যাবেন কান্তে। কর থেকে বাঁচতে ফুটবলারদের এমন কিছু করা নতুন কিছু নয়। শীর্ষ পর্যায়ের লিগের ফুটবলারদের ক্ষেত্রে এটা অনেকটাই ‘ওপেন সিক্রেট।’ কিন্তু কান্তে সেটা মানতে রাজি হননি। ক্লাবের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়েছেন। ফ্রেঞ্চ ওয়েবসাইট মিডিয়া পার্টের সূত্র জানিয়েছে, ‘এনগোলো এটা মানেনি। সে শুধু স্বাভাবিক বেতন পেলেই খুশি।’
এ প্রসঙ্গেই আসে লিওনেল মেসি ও ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর নাম। অফশোর অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে নিজেদের ছবি স্বত্বের অর্থ অন্য প্রতিষ্ঠানে পাঠিয়েছেন এ দুজন। এভাবে স্পেনকে প্রাপ্ত কর থেকে ফাঁকি দিয়েছেন দুজন। মেসি ও তাঁর বাবাকে এ জন্য শাস্তি পেতে হয়েছে। ৪.১ মিলিয়ন ইউরো কর ফাঁকির দায়ে মেসিকে ২১ মাসের স্থগিত জেল দিয়েছেন আদালত। তাঁর বাবা হোর্হে পেয়েছেন ১৫ মাসের স্থগিত জেল। জুভেন্টাসে যাওয়ার আগে রোনালদোকেও ফাঁকি দেওয়া কর এবং সে সূত্রে ওঠা জরিমানা দিয়েই যেতে হয়েছে। অর্থটাও প্রায় ১২ মিলিয়নের কাছাকাছি।
এ দুজনই শুধু নয়। রিয়াল মাদ্রিদ ও বার্সেলোনায় খেলেছেন কিংবা খেলছেন এমন অধিকাংশ তারকাই কদিন পর পর ছবি স্বত্বের মামলায় জরিমানা দিয়ে খবর হচ্ছেন। এ তালিকায় আছেন অনেক কোচও। এমন অবস্থায় ফুটবল লিকস, যাদের গল্পগুলো সাধারণত আমাদের মতো সাধারণ দর্শকদের হতাশায় ডোবায়, তাদেরই কান্তে সংক্রান্ত এ খবর আশা বাড়ায়। ফুটবলীয় কীর্তিতে রোনালদো কিংবা মেসির ধারেকাছেও হয়তো যেতে পারবেন না কান্তে। কিন্তু এ যুগের ফুটবলের আদর্শ হওয়া উচিত এই ক্ষুদ্রাকৃতির কান্তেই। কারণ, ভালোবাসার ফুটবলকে কলঙ্ক থেকে রক্ষা করতে এমন চরিত্রেরই দরকার মাঠে, ডাগ আউটে, ফিফা ও উয়েফার মতো প্রশাসনে।
এ যুগে ফুটবলার মানেই যেন ইনস্টাগ্রাম ও টুইটারে পার্টির ছবি দেওয়া। ঝকঝকে স্পোর্টস কার কিনে সবাইকে দেখানো, অতিরিক্ত পান করে গাড়ি চালিয়ে টিকিট পাওয়া। নিজেকে সবার সামনে বড় দেখানোই এখন উদ্দেশ্য। এর মাঝে কান্তে যেন নির্মল বাতাস। নিজেকে আড়াল করতে চাওয়া, এখনো মাটির মানুষ হয়ে ভক্তদের আবদার মেটানো, তাদের সঙ্গে ভিডিও গেম খেলতে যাওয়া। দুটো প্রিমিয়ার লিগ ও একটি বিশ্বকাপ জিতেও এখনো এতটা স্বাভাবিক আচরণ করে কান্তে জানিয়ে দিচ্ছেন, ফুটবল শেষ পর্যন্ত একটি খেলাই। নিজেদের মহাতারকা মনে করা অনেক ফুটবলারই হয়তো সেটা ভুলে গেছেন।