কোপা আমেরিকা ফাইনালের আগে আর্জেন্টিনা রক্ষণভাগ নিয়ে কত জল্পনা–কল্পনা, কত আলোচনা! ব্রাজিলের রক্ষণভাগে কে কে খেলবেন মোটামুটি নিশ্চিত হলেও আর্জেন্টিনার রক্ষণভাগে কে খেলবেন—স্বয়ং আর্জেন্টিনার কোচ লিওনেল স্কালোনিও বোধ হয় ম্যাচের কয়েক ঘণ্টা আগেও জানতেন না। সংশয়-দ্বিধা ছিলই।
আর্জেন্টিনার রক্ষণভাগ নিয়ে এই দ্বিধার প্রমাণ মিল মূল একাদশ দেখে। সেমিফাইনালে যে চারজন খেলেছিলেন রক্ষণভাগে, তাঁদের মধ্যে তিনজনই ফাইনালে বসে রইলেন বেঞ্চে। নতুন তিনজনকে নামানো হলো। রাইটব্যাক হিসেবে আগের ম্যাচে খেলা উদিনেসের নাহুয়েল মলিনা জায়গা পাননি, তাঁর জায়গায় নামানো হয় রিভারপ্লেটের গঞ্জালো মন্তিয়েলকে। যে মন্তিয়েলের খেলারই কথা ছিল না, যে মন্তিয়েলকে বলা হচ্ছিল আর্জেন্টিনার রক্ষণভাগে অন্যতম দুর্বলতা—সে খেলোয়াড়টাই নিন্দুকদের মুখ থামাতে সময় নিলেন নব্বই মিনিট।
মন্তিয়েলকে যে আর্জেন্টিনা রক্ষণভাগের অন্যতম দুর্বল দিক বলা হতো, এর কারণও ছিল। অবশ্য এতে মন্তিয়েলের একার দোষ নেই। সেই ২০১৪ বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলা সাবেক ম্যানচেস্টার সিটির রাইটব্যাক পাবলো জাবালেতা যাওয়ার পর থেকে হাপিত্যেশ হয়ে একজন রাইটব্যাক খুঁজছে ‘আলবিসেলেস্তে’রা। এ কয় বছরে একে একে জায়গা পেয়েছেন গ্যাব্রিয়েল মের্কাদো, হুয়ান ফয়থ, রেনজো সারাভিয়া এবং আরও অনেকে! কোপার জন্য দলে নেওয়া হয়েছিল মন্তিয়েল আর মলিনাকে। দুজনের কেউ জায়গাটা নিজের করে নিতে পারেননি।
এমনকি সেমিফাইনালে তাকিয়ে দেখুন, কলম্বিয়ার তরুণ লেফট উইঙ্গার লুইস দিয়াজকে সামলাতে রীতিমতো খাবি খেতে হয়েছে মলিনা-মন্তিয়েলকে। সে ম্যাচে প্রথমে নেমেছিলেন মলিনা, এতই বাজে খেলেছেন যে দ্বিতীয়ার্ধে তাঁকে উঠিয়ে মন্তিয়েলকে নামানো হয়েছিল। তখন মন্তিয়েলও তেমন ভালো খেলেননি। ফাইনালে মন্তিয়েলের মূল একাদশে জায়গা পাওয়ার এটাই মূল কারণ। দিয়াজকেই যেখানে সামলাতে এমন সমস্যা, নেইমারকে সামলাতে না জানি কত কষ্ট করতে হয় মন্তিয়েলকে!
ভয়টা তাই ছিলই। সেই ভয়টা আরও বাড়ল ম্যাচের তিন মিনিটে। ব্রাজিলের মিডফিল্ডার ফ্রেদের একটা বাজে ট্যাকলে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন তিনি। এ যেন মারাকানায় চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীকে উষ্ণ অভ্যর্থনা! অভ্যর্থনা পেয়ে মন্তিয়েল একটু হলেও কি মানসিকভাবে ধাক্কা খেয়েছিলেন? হবে হয়তো। অমন লাথির পর কারও মনোবল ভেঙে যাওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু মন্তিয়েল এই দিন অন্য লক্ষ্য নিয়ে নেমেছিলেন! নেমেছিলেন যেকোনো মূল্যে শিরোপাটা নিজেদের করে নেওয়ার জন্য। নেমেছিলেন ১৯৯৩ সালের পর দেশের ট্রফি–খরা কাটানোর উদ্দেশ্যে, নেমেছিলেন দেশের সবচেয়ে বড় ফুটবল তারকার সবচেয়ে প্রার্থিত শিরোপা উপহার দিতে।
মন্তিয়েল উঠলেন। প্রথমে কিছুক্ষণ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটলেও পরে আস্তে আস্তে নিজের কাজ শুরু করলেন। নেইমার, রিচার্লিসন, ফিরমিনো, এভারটন, গ্যাব্রিয়েল, ভিনিসিয়ুসের মতো খেলোয়াড়েরা একে একে বাধা পড়লেন মন্তিয়েল-দেয়ালে। ৪৩ মিনিটে রিচার্লিসনের দুর্দান্ত এক গোলমুখি ক্রস হেডে ক্লিয়ার করলেন। ম্যাচের একদম শেষদিকে নেইমারের সঙ্গে ‘যুদ্ধে’ জড়িয়ে পড়ে গেলেন মাঠে। দুই দিন আগে কলম্বিয়ার লেফটব্যাক ফ্রাঙ্ক ফাবরার কড়া ট্যাকলে পা থেক রক্ত ঝরেছিল মেসির। চুয়ে চুয়ে বেয়ে পড়ে রক্তে মোজা লাল হয়ে গিয়েছিল। এবার ফাইনালে মন্তিয়েলই যেন মেসি হয়ে গেলেন!
মন্তিয়েলের এই রক্তমাখা ছবি মনে করিয়ে দেয় আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি ম্যারাডোনার দলের প্রতি এমন অসাধারণ নিবেদন। ১৯৯০ ইতালি বিশ্বকাপে ব্রাজিলের বিপক্ষে ম্যাচে ঠিক এভাবেই চোট পেয়েছিলেন ম্যারাডোনা। রক্তমাখা পা নিয়েও শেষ পর্যন্ত খেলেছিলেন আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক। সে ম্যাচে জিতেছিল আর্জেন্টিনা। মন্তিয়েলও দলকে জিতিয়েই মাঠ ছাড়লেন।
বল স্পর্শ করেছেন ৫৩ বার, ১০টার মধ্যে ৯য়টা ডুয়েলেই সফল হয়েছেন, সবচেয়ে বেশি সাতটি ট্যাকল করেছেন, বল ক্লিয়ারও করেছেন সবার চেয়ে বেশি—চারবার। একটা শট ব্লক করেছেন, নেইমাররা একবারের জন্যেও ড্রিবল করে মন্তিয়েলকে পেরোতে পারেননি।
এই তথ্যগুলোর হিসাব পাওয়া গেলেও একটা জিনিসের হিসাব হয়তো কোনো ওয়েবসাইটই বের করতে পারবে না। সেটা হলো মন্তিয়েলের বুকভরা সাহসের হিসাব। যে ডিফেন্ডার ব্রাজিলের মারাকানায় গিয়ে নেইমারদের এভাবে চুপ করিয়ে দিয়ে আসতে পারেন, তাঁর সাহস কি কোনো নিক্তি দিয়ে মাপা যায়?